চীন-মার্কিন শত্রুতার কেন্দ্রে যে কোম্পানি

42

স্মার্টফোন কোম্পানি হুয়াওয়েকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের যে তীব্র বিবাদ চলছে তা গতকাল শুক্রবার নতুন মাত্রা পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বৈষম্যের অভিযোগ এনে হুয়াওয়ে যে মামলা করেছে- তার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে চীনা সরকার।
বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- হুয়াওয়ে ভেড়ার মত চুপচাপ হাঁড়িকাঠে মাথা পেতে দেবে না।
চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং-ই সংসদে বলেছেন, হুয়াওয়েকে সরকার সবরকমের সহযোগিতা করবে।
কিন্তু কি নিয়ে এই বিবাদ? আর এর প্রতিক্রিয়াই বা কি হবে? মাস তিনেক আগে মার্কিন অনুরোধে হুয়াওয়ের ঊর্ধ্বতন নির্বাহী মেং ওয়ানঝু-কে আটক করে কানাডার কর্তৃপক্ষ। মার্কিন সরকারও তাদের ফেডারেল এজেন্সিগুলোকে নির্দেশ দেয় যেন তারা হুয়াওয়ের কোনো সামগ্রী ব্যবহার না করে। আমেরিকায় হুয়াওয়ের পণ্য ও সেবা বিক্রির ওপরও নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। মার্কিন সরকার বলছে, জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কারণেই এসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
তাদের অভিযোগ, হুয়াওয়ের মাধ্যমে চীন প্রযুক্তি চুরি এবং গুপ্তচরবৃত্তি করছে। কানাডায় গ্রেফতার হওয়া মেং হচ্ছেন হুয়াওয়ের প্রতিষ্ঠাতা রেন জেনফেং এর মেয়ে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল- তিনি ইরানের ওপর আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে ফাঁকি দিয়ে হুয়াওয়ের ব্যবসা সম্পর্কে আমেরিকান ব্যাংকগুলোকে মিথ্যা বলেছিলেন। তবে মেং এবং হুয়াওয়ে উভয়েই ওই অভিযোগ অস্বীকার করেন। এর পর যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিরুদ্ধে আইনী প্রক্রিয়া শুরু করে হুয়াওয়ে।
হুয়াওয়ে হচ্ছে পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ স্মার্টফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। চীনের শেনঝেন শহরে এক চোখ-ধাঁধানো বহুতল ভবনে তাদের প্রধান দফতর। হুয়াওয়ে এখন বিশ্বজুড়ে মোবাইল ফোনের বাজারের ১৬ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। তারা নোকিয়া এবং এরিকসনকে পেছনে ফেলে দিয়েছে অনেক আগেই, আর এখন স্যামসাং আর এ্যাপলের পরেই তারা আছে তৃতীয় স্থানে।
হুয়াওয়েকে নিয়ে উদ্বেগের কেন্দ্রে রয়েছে তাদের নেক্সট-জেনারেশন ফাইভজি মোবাইল নেটওয়ার্ক। ফাইভজি মোবাইল ব্যবহারকারীদের জন্য অনেক বেশি উন্নত ইন্টারনেট সেবা এনে দেবে এবং ট্রাফিক লাইট, চালকবিহীন গাড়ি ইত্যাদির মতো যন্ত্রকে পরস্পর সংযুক্ত করে দেবে। খবর বিবিসি বাংলার
যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ বেশ কিছু দেশ টেলিকম কোম্পানিগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যাতে তারা হুয়াওয়ের সামগ্রী ব্যবহার না করে, কারণ এর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। কানাডা ও ইউরোপে এ বিষয়টি বিবেচনাধীন রয়েছে।
হুয়াওয়ের প্রতিষ্ঠাতা রেন ঝেংফেই একসময় চীনের পিপলস আর্মি অর্থাৎ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ছিলেন। এটা এবং হুয়াওয়ের ব্যবসার যে প্রসার হয়েছে তা নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। হুয়াওয়ের ব্যবসার প্রসার পশ্চিমা দেশগুলোতে এই আশংকা তৈরি করেছে যে তাদের প্রযুক্তি যেভাবে বিভিন্ন জায়গায় ঢুকে পড়েছে- তাতে তা চীনের গুপ্তচরবৃত্তির জন্য ব্যবহার করা হতে পারে।
মূল কথা হলো, যেহেতু অত্যাবশ্যকীয় যোগাযোগ নেটওয়ার্কের একাংশ হুয়াওয়ে নিয়ন্ত্রণ করে, তাই তার ক্ষমতা আছে গুপ্তচরবৃত্তি করার এবং ভবিষ্যতে কোনো বিবাদের সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত করার। এ কারণে হুয়াওয়ের সামগ্রী ব্যবহারকারী দেশগুলো এ ঝুঁকির ব্যাপারটি সতর্কতার সাথে বিবেচনা করে। তা ছাড়া ২০১৭ সালে চীনে যে জাতীয় নিরাপত্তা আইন পাস হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে যে জাতীয় গোয়েন্দা কার্যক্রমে চীনা কোম্পানিগুলোকে অবশ্যই সমর্থন ও সহযোগিতা দিতে হবে।
এর পরই বিভিন্ন দেশ তাদের ফাইভ জি নেটওয়ার্ক প্রযুক্তিতে হুয়াওয়ের যন্ত্রপাতি ব্যবহার বন্ধ করে দেয়। কানাডা ও ইউরোপের কোম্পানিগুলোও একই রকম পদক্ষেপের কথা বিবেচনা করছে। যুক্তরাজ্যে ব্রিটিশ টেলিকমও এর মধ্যেই ঘোষণা করেছে তাদের থ্রিজি, ফোরজি এবং ফাইভজি কার্যক্রমে হুয়াওয়ের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হবে না।
অনেকে মনে করেন, ফাইভজি নেটওয়ার্ক কায়েম হলে নিরাপত্তা নজরদারি কঠিন হয়ে পড়তে পারে। তবে হুয়াওয়ে এসব অভিযোগ স্বীকার করে না। তারা বলছে, কোম্পানি হিসেবে হুয়াওয়ের স্বচ্ছতা বিশ্বে সর্বোচ্চ, কিন্তু তাদের বাজারে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে এবং এ জন্যই বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে।
কিছু বিশ্লেষক বলেছেন, ফাইভজি নেটওয়ার্ক চালুর আগে এর কন্ট্রাক্ট পাবার জন্য মোবাইল কোম্পানিগুলোর মধ্যে পর্দার আড়ালে প্রতিযোগিতা চলছে। চীনা কর্তৃপক্ষ এখন এই বিবাদে হুয়াওয়ের পাশে দাঁড়িয়েছে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং-ই বলেন, যুক্তরাষ্ট্র হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে যে আইনী পদক্ষেপ নিয়েছে, তার পেছনে পরিকল্পিত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে। চীন বলছে, হুয়াওয়ের সমর্থনে প্রয়োজনীয় সব রকম পদক্ষেপ নেবে তারা (চীন সরকার)।