চীনে মুসলিম স্কুলের আবারও গোপন নথি ফাঁস

215

দিদারুল ইসলাম কাদেরী

মানবতা ও সভ্যতার এই আধুনিক বিশ্বে স্বাধীন রাষ্ট্রে যুগেযুেগ পরাধীন জাতিগুলোর অন্যতম চীনের উইগু জাতি। বহুকাল ধরে তারা আরকান, কাশ্মির ও ফিলিন্তিন জাতির মত স্বাধীন রাষ্ট্রে নির্যাতিত, নিপীড়িত পরাধীন জাতি। অনেক উত্থান পতনের পর উইগুরা তাদের মাতৃভ‚মির শিক্ষা-সংস্কৃতি, মাটি ও মানুষের স্বাধিকার রক্ষায় বিশ্বের পরাশক্তি চীনের সাথে লড়ে আসছে। দ্বীর্ঘ পরিক্রমার পর সর্বশেষ বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে উইগুররা নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেও কিন্তু এই অঞ্চলটিকে ১৯৪৯ সালে চীনের নতুন কমিউনিস্ট সরকারের পুরো নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়। সেই থেকে আবারও নতুন করে স্বাধিকার-গণতন্ত্র ও আদিসত্তার নিয়ে চীনা সরকারের নির্যাতনের হয় এ জাতি! বিশ্ববাসির কাছে তারা বারবার এ জাতি নিধনের নির্যাতনের কথা অস্বিকার করে আসছে। এবারে মত চীন সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তারা বিপুল সংখ্যক উইগুর মুসলিমকে কতোগুলো বন্দী শিবিরের ভেতরে আটকে রেখেছে। গত অগাস্ট মাসে জাতিসংঘের একটি কমিটি জানতে পেরেছে যে ১০ লাখের মতো উইগুর মুসলিমকে পশ্চিমাঞ্চলীয় শিনজিয়াং অঞ্চলে কয়েকটি শিবিরে বন্দী করে রাখা হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো ভাষ্য, এসব ক্যাম্পে তাদেরকে ‘নতুন করে শিক্ষা’ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বেইজিং সরকারের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু একইসাথে শিনজিয়াং প্রদেশে বসবাসকারী লোকজনের ওপর চীন সরকারের নিপীড়নমূলক নজরদারির তথ্যপ্রমাণ ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এই নিপীড়নের শুরু অনেক আগ থেকে হলেও এটির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয় গত শতাব্দীতে। অনেক লম্বা ইতিকথা যদি দু’এক লাইনে বলি কত কয়েক বছরে নির্যাতনের সমীকরণ হল-সেখানকার আঞ্চলিক রাজধানী উরুমকিতে ২০০৯ সালের দাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছে কমপক্ষে ২০০ জন। তাদের বেশিরভাগই চীনা হান। তারপর থেকে সেখানে আরো কয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটেছে। হামলা হয়েছে পুলিশ স্টেশন এবং সরকারি ভবনেও। ২০১৪ সালে এরকম কিছু হামলায় নিহত হয়েছে ৯৬ জন। সরকারের পক্ষ থেকে এসব হামলার জন্যে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দায়ী করা হয়েছে। বেইজিং বলছে, শিনজিয়াং-এর বিচ্ছিন্নতাবাদীরা চীনের অন্যত্রও হামলা চালিয়েছে। সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে তারা তিয়েনানমেন স্কয়ারে গাড়ি দিয়েও হামলা করেছিল। ২০১৭ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে শিনজিয়াং-এ ছুরি দিয়ে চালানো হামলায় পাঁচজন নিহত হওয়ার পর সরকার সেখানে নতুন করে অভিযান চালাতে শুরু করে। এসময় সেখানকার কমিউনিস্ট পার্র্টির নেতাও তথাকথিত ‘সন্ত্রাসীদের’ বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। কিন্তু এই দুই এক লাইনের চিত্র ছাড়াও আরো বহু ধরনের মুমূর্ষু নির্যাতিত চিত্র বিশ্ববাসী থেকে তারা গোপন করেছে বারবার। মুসলিম জাতি নিধনের সকল প্রকার আধুনিক কলাকৌশল অনুসরণ করেছে এই তথ্যপ্রযুক্তির শক্তিশালী দেশ চীন। এই উইগুর জাতির উপর সকল ধরনের স্বাধীনতা খর্ব করেছে সন্ত্রাসের নামে চীন সরকার। মুসলমানদের ধর্মীয় সকল নিয়মকানুন ও আদেশ নিষেধে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে চীন সরকার। মুসলমানদের নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত, পোশাক, পর্দা, নারী ও ধর্মীয় শিক্ষাসহ যাবতীয় ধর্মীয় অনুশাসন চীন সরকার সরাসরি হস্তক্ষেপ করে মুসলিম জাতি নিধনে খুব সু²ভাবে কাজ করছে এই অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র চীন। স্বাধিকারকামী মানবতাবাদীরা মনে করছে চীন উইগু সম্প্রদায়ের উপর জাতি নিধনে মাতাল হয়ে উঠেছে। এই প্রদেশে সকল ধরনের ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখে চীনা সরকার। সরকারের অনুমতি ছাড়া কোন গণমাধ্যম কর্মী বা মানবাধিকার সংস্থার কর্মী তাদের তথাকথিত সাধারণ স্কুল নামে খ্যাত মুসলিম বন্দী শিবির বা কারাগারে যাওয়ার অনুমতি নেই। কোন গণমাধ্যম কর্মী তাদের অনুমতি ছাড়া নির্যাতিত সাধারণ স্কুলের ছাত্রদের কথা বলার অনুমতিও নাই। এভাবে বহু কলাকৌশল নিয়ে মুসলিম জাতি নিধনে কাজ করছে চীন সরকার। জাতি নিধনের এই নির্যাতিত চিত্রের কথা বিশ্বাবাসী যতবার দাবি করেছে ততবারেই চীন বরাবরের মত অস্বীকার করে আসলেও আবারও চীনে সংখ্যালঘু উইগুর স¤প্রদায়ের হাজার হাজার মুসলমানের ওপর নিপীড়ন ও নির্যাতনের নতুন দলিল ফাঁস হয়েছে। সেসব দলিলে দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় শিনজিয়াং অঞ্চলে তিন হাজারের বেশি নাগরিকের দৈনন্দিন জীবনের যাবতীয় খুঁটিনাটিসহ ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষণের প্রমাণ পাওয়া গেছে। ১৩৭ পৃষ্ঠার সে দলিলে প্রতিটি পৃষ্ঠায় ভিন্ন ভিন্ন কলাম এবং ছক কেটে ঐ মানুষেরা কতবার নামাজ পড়েন, কী পোশাক পরেন, কাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের আচার আচরণের বিস্তারিত লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। তবে, চীনের সরকার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে এগুলো দেশটির সন্ত্রাসবাদ এবং ধর্মীয় উগ্রপন্থা মোকাবেলায় নেয়া পদক্ষেপের অংশ। নতুন দলিলে সংখ্যালঘু উইগুর স¤প্রদায়ের ৩১১ জন মানুষের ব্যাপারে ব্যাপকভিত্তিক অনুসন্ধানের অর্থাৎ তাদের পূর্ব ইতিহাস, ধর্মীয় আচার পালনের দৈনন্দিন রুটিন, তাদের আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী এবং বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগের বিস্তারিত তথ্য রয়েছে এসব দলিলে। আমস্টারডামে নির্বাসিত উইগুর মুসলমান আসিয়ে আব্দুলাহেব রিপোর্টের শেষ কলামে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে, ঐ ব্যক্তিদের বন্দীশিবিরে আরো রাখা হবে নাকি তাদের ছেড়ে দেয়া হবে, অথবা আগে ছেড়ে দেয়া হয়েছে এমন কাউকে আবার বন্দি শিবিরে ফিরিয়ে আনতে হবে কিনা। নতুন এসব দলিলের মাধ্যমে ঐসব ক্যাম্পকে এতদিন সাধারণ স্কুল বলে চীন যে দাবি করে এসেছে তা ভিত্তিহীন হয়ে পড়ছে। প্রাপ্ত দলিল বিশ্লেষণ করে ড. জেনজ বলছেন, এসবের মাধ্যমে ওখানে চলা সিস্টেমের ব্যাপারে ধারণা যেমন পাওয়া যায়, তেমনি ক্যাম্পে থাকা মানুষের ‘আদর্শিক ও মনস্তাত্তি¡ক কাঠামো’ অনুযায়ী তাদের বিভক্ত করে পর্যালোচনা করার ব্যাপারেও ধারণা পাওয়া যায়। বোরকা পরা, পাসপোর্ট করতে চাওয়ায় ‘সংশোধন’ শিবিরে ৫৯৮ নম্বর সারিতে একটি কেস রয়েছে, যেখানে হেলচেম নামের ৩৮ বছর বয়সী একজন নারীকে রি-এডুকেশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে, কারণ তিনি কয়েক বছর আগে বোরকা পরতেন। এটি অতীতের ঘটনার কারণে এবং নিযম বহির্ভূত শাস্তির একটি উদাহরণ মাত্র। শিনজিয়াংয়ের একটি বন্দীশিবির অন্যদের মধ্যে কেউ আছেন, যারা কেবল পাসপোর্টের আবেদন করার কারণে সংশোধন’ শিবিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন, যার মাধ্যমে প্রমাণ হয় যে কেউ দেশের বাইরে বেড়াতে যেতে চাইলেও সেটাকে কর্তৃপক্ষ শিনজিয়াংয়ে উগ্রপন্থার ল²ণ হিসেবে বিবেচনা করে। ৬৬ নম্বর কলামে, মেমেত্তটি নামে ৩৪ বছর বয়সী একজন যুবক ঠিক এই কারণে বন্দি হয়েছেন, যদিও দলিলে উল্লেখ আছে তার কাছ থেকে, ‘বাস্তব কোন ঝুঁকি’ নেই। আবার ২৩৯ নম্বর সারণিতে দেখা যায়, নুরমেমেট নামে ২৮ বছর বয়সী একজনকে রি-এডুকেশন কার্যক্রমে পাঠানো হয়েছে, কারণ একটি ওয়েব লিংকে ক্লিক করার মাধ্যমে তিনি ‘অনিচ্ছাকৃতভাবে’ একটি বিদেশি ওয়েবসাইটে চলে গিয়েছিলেন। তার আচরণের নিয়েও কোন অভিযোগ নেই বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। যে ৩১১ জন ব্যক্তিকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, তারা সবাই শিনজিয়াংয়ের দক্ষিণে কারাকাক্স কাউন্টি নামে এক শহরের বাসিন্দা, যেখানকার ৯০ শতাংশ মানুষ উইগুর স¤প্রদায়ের। উইগুররা বেশির ভাগই মুসলমান, এবং তাদের মুখাবয়ব, ভাষা এবং সংস্কৃতির সঙ্গে চীনের প্রধান জাতিগোষ্ঠী অর্থাৎ যাদের হান চাইনিজ বলা হয়, তাদের চেয়ে বরং মধ্য এশিয়ার সাদৃশ্য বেশি। তালিকায় ৩১১ জন উইগুর মুসলমানের তথ্য রয়েছে সা¤প্রতিক কয়েক দশকে লক্ষ লক্ষ হান চাইনিজ শিনজিয়াংয়ে বসতি গড়ে তুলেছে। এরপর থেকে ক্রমে সেখানে এক ধরনের জাতিগত উত্তেজনা তৈরি এবং উইগুরদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড থেকে বাদ দেয়া হচ্ছে এমন আশংকা ক্রমে বাড়ছে। এ নিয়ে মাঝেমধ্যেই সেখানে বিক্ষোভ সংঘাতের ঘটনা ঘটে, বেইজিং এর পক্ষ থেকে যা কঠোরভাবে দমন করা হয়। এজন্যই ক্রমে উইগুর এবং শিনজিয়াংয়ের অন্য সংখ্যালঘু মুসলমান স¤প্রদায়সমূহ যেমন কাজাখ এবং কিরগিজ স¤প্রদায়ের লোকেরা সরকারের দমননীতির টার্গেটে পরিণত হয়েছেন, এবং তাদের বন্দি শিবিরে নেয়া হচ্ছে। নতুন প্রকাশিত দলিলসমূহকে ড. জেনজ নাম দিয়েছেন ‘কারাকাক্স তালিকা, তিনি বলছেন, এর মাধ্যমে এটাই প্রমাণিত হয় যে চীনের কর্তৃপক্ষ এখন যেকোন ভিন্নমতকেই আনুগত্যহীনতা মনে করছে। একটি বাজারে কয়েকজন মুসলিম আর সেই আনুগত্যহীনতা দূর করার জন্য সরকার উইগুারদের বাড়ি ঘর এবং অস্তরের ভেতরে পরিবর্তন আনতে চায়…। পরিশেষে এরপর বলি বিশ্ববাসী বা মানবতাবাদীরা কি পারবে চীনের এই নির্যাতিত উইগু জাতিকে মুক্তি দিতে? নাকি এই গোপন নথি সময়ে সময়ে ইতিহাসের পাতায় লিপিবন্ধ হবে?

লেখক : প্রধান রেডিক্যাল ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ