চীনে আটকা বাংলাদেশিদের ফেরাতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ

60

করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে চীনে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের কেউ ফিরতে চাইলে তাদের ফেরানোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এছাড়া চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাস কোনোভাবেই যেন বাংলাদেশে আসতে না পারে, সে বিষয়েও সতর্ক থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। গতকাল সোমবার সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী এই নির্দেশনা দেন বলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানান।
সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন- আরো সতর্ক থাকতে হবে, খেয়াল রাখতে হবে। চীন হয়ে যারা আসছেন, তাদেরকেও বিশেষভাকে দেখাশোনা করতে হবে।
এমন নির্দেশনা জারির খবর ফেসবুকের ভেরিফায়েড পাতায় লিখেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। এজন্য ইতিমধ্যেই সরকার চীন সরকারের সাথে আলোচনা শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
এদিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হচ্ছে, বেইজিংয়ের বাংলাদেশ দূতাবাসে একটি হটলাইন খোলা হয়েছে, যার নম্বর: +৮৬১৭৮০১১১৬০০৫
বিজ্ঞপ্তিতে উহান শহরে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের বিচলিত না হয়ে চীনের সরকারের নির্দেশনা মেনে চলবার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। গণপরিহন বন্ধ করে দেয়ায় উহানসহ চীনের কয়েকটি শহরে বাংলাদেশি নাগরিকদের আটকে পড়ার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের তরফ থেকে এসব উদ্যোগ নেবার খবর এলো।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, চীনে অবস্থানরত ২৪৫ জন বাংলাদেশি একটি উইচ্যাট গ্রæপের মাধ্যমে যুক্ত আছেন। এই গ্রæপে দূতাবাসের দুজন কর্মকর্তাও যুক্ত হয়েছেন এবং তারা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন।
উহান শহর থেকেই আলোচিত রহস্যময় করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। উহান শহরটিকে কার্যত এখন বন্ধ করে রেখেছে চীনের কর্তৃপক্ষ। সেখান থেকে কাউকে বের হতে দেয়া হচ্ছে না। কাউকে ঢুকতেও দেয়া হচ্ছে না। অথচ এই উহানের একটি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা রয়েছেন, যারা এখন সেখানে অবস্থান করছেন। খবর বিবিসি বাংলার
গত শনিবারই উহানে দুই সন্তান নিয়ে বসবাস করা শামিমা সুলতানা বলেছিলেন, বাংলাদেশে ফেরার সুযোগ থাকলে এক মুহূর্তও এখানে থাকতাম না।
গতকাল সোমবার ফেসবুক স্ট্যাটাসে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, বাংলাদেশের নাগরিক যারা চীন থেকে ফিরতে চাইবেন তাদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশনা দিয়েছেন।
তিনি লিখেছেন, আমরা চীন সরকারের সাথে এই বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছি। কি প্রক্রিয়ায় এটি করা হবে তা বাস্তবতার নিরিখে স্থানীয় প্রশাসনের সাথে সম্মতির ভিত্তিতে করা হবে।
তিনি আরো লিখেছেন, আমাদের দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তাই আমাদের মূল লক্ষ্য। এই বিষয়ে আজকের দিনের শেষে একটি প্রাথমিক নির্দেশনা জারি করা হবে যার মূল উদ্দেশ্য থাকবে আগ্রহীদের তালিকা প্রণয়ন।
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চীনে এ পর্যন্ত ৮০ জন মানুষ মারা গেছেন, অসুস্থ হয়েছেন তিন হাজারের বেশি মানুষ। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে দেশটিতে সরকারি ছুটি আরো তিনদিন বাজিয়ে দেয়া হয়েছে।
চীনের উহান এবং এর আশেপাশের কয়েকটি শহরে ইতিমধ্যে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এদিকে, চীনের কয়েকটি শহরে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কারণে সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
কেউ কেউ বাংলাদেশে ফিরে আসার আগ্রহ প্রকাশ করলেও, তাদের অনেকে জানিয়েছেন দেশটির সরকার সেখানকার সব ধরনের গণপরিবহনে চলাচল বন্ধ করে দেয়ায় এক রকম ঘরবন্দি অবস্থায় দিন কাটাতে হচ্ছে তাদের।
চীনে বসবাসরত প্রায় তিন হাজার বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যে প্রায় তিনশ জনের বসবাস উহান এবং এর আশেপাশের শহরগুলোয়।
চীনের বাংলাদেশ দূতাবাস জানিয়েছে, জরুরি প্রয়োজনে বাংলাদেশি নাগরিকদের যেকোনো সহায়তা চাওয়ার জন্য ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে দূতাবাসের এমন একটি হটলাইন নম্বরে যোগাযোগের অনুরোধ করা হয়েছে।
চীনে বাংলাদেশি দূতাবাসের ডেপুটি চিফ অফ মিশন মাসুদুর রহমান বলেছেন, আতঙ্ক দূর করতে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে দূতাবাস যৌথভাবে কাজ করছে। এছাড়া চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, কোন শিক্ষার্থীর যদি, জ্বর, ঠান্ডা, কাশি, সর্দি বা বুকে ব্যথা হয়- অর্থাৎ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ দেখা গেলে সাথে সাথে ডর্মেটরির সুপারভাইজারকে জানাতে হবে।
যদিও এখনো পর্যন্ত কোন বাংলাদেশির এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। চীনের বাংলাদেশ দূতাবাস অবশ্য এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে যোগাযোগ করে তাদের নানাবিধ সহায়তা দেয়ার আশ্বাস দিয়েছে।
উহানের একটি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাকিল আহমেদ বলেন, উহান শহরে বসবাসরত অন্যান্য শিক্ষার্থীরা শুরুতে ভাইরাসের আতঙ্কে থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে তাদেরকে সব ধরণের সহযোগিতা দেয়ার কথা আশ্বাস দেয়ায় উদ্বেগ কিছুটা কমেছে। কিন্তু চীনা সরকারের নির্দেশনা মানতে গিয়ে এক রকম আটক অবস্থায় সতর্ক হয়ে চলতে হচ্ছে তাদের।
তিনি বলেন, দূতাবাস থেকে আর ইউনিভার্সিটি থেকে সব সময় আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখছে। ইউনিভার্সিটি থেকে বলেছে যেন আমরা প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের না হই। সব সময় যেন মাস্ক পরি, তারা ওই মাস্ক দিয়েছে। বারবার হাত ধুতে বলেছে, প্রচুর পানি খেতে বলেছে। মানে যতভাবে সতর্ক থাকা প্রয়োজন – তারা রুমে রুমে এ সংক্রান্ত নোটিশ দিয়ে গেছে।
শিক্ষার্থীরা যেন তাদের প্রয়োজনীয় বাজার সেরে নিতে পারে এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটা বাস সপ্তাহে দুই দিন এই শিক্ষার্থীদের ডর্মেটরি থেকে পাশের সুপার শপে নিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছে।
এছাড়া কোন শিক্ষার্থীর যদি, জ্বর, ঠান্ডা, কাশি, সর্দি বা বুকে ব্যথা হয়- যেগুলো কিনা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ। তাহলে সাথে সাথে এই তথ্য ডর্মেটরির সুপারভাইজারকে জানানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সার্বক্ষণিক খোঁজ নেয়া হচ্ছে যে আমরা ঠিক আছি কিনা। তারপরও যদি কারও মধ্যে করোনা ভাইরাসের লক্ষণ দেখা যায় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অ্যাম্বুলেন্স করে আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করবে। আসলে সাবধানে থাকা আর নির্দেশনা মেনে চলা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই।
চীনে বসবাসরত প্রায় তিন হাজার বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যে প্রায় তিনশ জনের বসবাস উহান এবং এর আশেপাশের শহরগুলোয়। করোনা ভাইরাসের এই বিস্তারকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে মোকাবিলার কথা জানিয়েছে চীনের বাংলাদেশ দূতাবাস।
বর্তমান পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে উহানে বসবাসরত দুই শতাধিক বাংলাদেশি ইতোমধ্যে এক হয়ে তাদের সমস্যাগুলোর কথা দূতাবাসকে অবহিত করেছে।
দূতাবাসের পক্ষ থেকেও সব বাংলাদেশি নাগরিককে জরুরি প্রয়োজনে যেকোনো সহায়তা চাওয়ার জন্য সপ্তাহে ২৪ ঘণ্টার একটি হটলাইন নম্বরে যোগাযোগের জন্য বলেছে। বিশেষ করে কেউ অসুস্থ হলে দূতাবাসের পক্ষ থেকেই তাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া হবে। যদিও এখন পর্যন্ত কোন বাংলাদেশি বা বিদেশি নাগরিকের এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
মানুষের আতঙ্ক দূর করতে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে দূতাবাস যৌথভাবে কাজ করছে বলে জানান চীনে বাংলাদেশি দূতাবাসের ডেপুটি চিফ অফ মিশন মাসুদুর রহমান।
আমরা বুঝতে পারছি যে, উহানের বাংলাদেশিরা যে একপ্রকার আটক হয়ে অসহায় অবস্থায় আছে। চীনা সরকার এখনও যেহেতু কাউকে সরিয়ে নেয়ার কোন নির্দেশনা দেয়নি, তাই আমরা সেটা করতে পারছি না। এখন চীনা স্বাস্থ্যসেবা অধিদফতর বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে যে পরামর্শ দিচ্ছে সেগুলো মেনে চলতে বলছি।
এছাড়া আমরা যে হটলাইন নম্বর চালু করেছি, সেখানে প্রতিদিন প্রচুর ফোন আসে। কারো বাসায় বাজার নেই, সে কিভাবে যাবে। কিন্তু কেউ আক্রান্ত হয়েছে এমন খবর আমরা পাইনি।
তবে চীনা নববর্ষের কারণে দেশটির সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রæত ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারে এক ধরণের চ্যালেঞ্জের মুখে আছেন বাংলাদেশের দূতাবাস কর্মকর্তারা। এমন অবস্থায় চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, চীনে থাকা দূতাবাসগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে একজন কর্মকর্তাকে নিযুক্ত করেছে।
এই ভাইরাসকে ঘিরে বিদেশি নাগরিকরা তাদের আতঙ্ক বা অভিযোগগুলোর কথা তাদের দেশের দূতাবাসকে অবহিত করছেন। এবং দূতাবাস সেগুলো জানাচ্ছে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তাকে।
তিনি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান যেমন বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল বা স্বাস্থ্য সেবা অধিদফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছেন।