চীনের পর কাঁপছে কোরিয়া-ইরান

50

মরণব্যাধি করোনা ভাইরাস চীন থেকে দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ছে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। ইউরোপেও সংক্রমণ ঘটছে আশঙ্কাজনক হারে। চীনের পর এবার করোনা আতঙ্কে কাঁপছে দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান ও ইতালি। দক্ষিণ কোরিয়া সরকার সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করেছে। ইরানে মৃতের সংখ্যা বেড়ে আটজনে পৌঁছেছে। ফলে চীনের মূল ভূখন্ডের বাইরে ইরানেই সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটেছে করোনায়। ইরানের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে তুরস্ক, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান। করোনা ঠেকাতে ইতালির দশটি শহর অবরুদ্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইন বলেছেন, তার দেশ কঠিন সংকটের মুখোমুখি। করোনা মোকাবিলায় সামনের কিছুদিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খবর অনলাইন বার্তাসংস্থার
দেশটিতে করোনায় ছয়জনের মৃত্যু এবং ৬০২ জন আক্রান্ত হয়েছেন। করোনা ভাইরাসে চীনের বাইরে এখন দক্ষিণ কোরিয়াতেই সবচেয়ে বেশি লোক আক্রান্ত হয়েছেন। গত রবিবার সকাল পর্যন্ত দেশটিতে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫৫৬ জন। এরপর আরও ৪৬ জন এ ভাইরাসে আক্রান্ত বলে শনাক্ত হয়। আক্রান্তদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি একটি গির্জা থেকে সংক্রমিত হয়েছেন।
জনসমাগম এড়িয়ে চলতে জনগণকে আহব্বান জানিয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী চুং সিয়ে-কুন। নতুন আক্রান্তদের অনেকেই দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় শহর দায়েগুর একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী ও একটি হাসপাতালের সঙ্গে সম্পৃক্ত। দায়েগু ও পার্শ্ববর্তী চেয়ংদো শহরকে ‘বিশেষ এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এ দুটি শহরের মানুষ আর ঘর থেকে বের হচ্ছেন না।
এদিকে, দক্ষিণ কোরিয়ার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় গুমি এলাকায় স্যামসাংয়ের একটি মোবাইল ফোন তৈরির কারখানায় করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর সেই কমপ্লেক্সের সব কারখানা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বের শীর্ষ স্মার্টফোন নির্মাতা স্যামসাংয়ের ওই কারখানায় স্থানীয় বাজারের জন্য উচ্চমূল্যের মোবাইল ফোন তৈরি করা হয়। আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য স্যামসাংয়ের বেশিরভাগ স্মার্টফোন তৈরি হয় ভারত ও ভিয়েতনামে।
ইতালিতে শনিবার পর্যন্ত করোনা শনাক্ত হয় ১৮ জনের। গতকাল তা এক লাফে বেড়ে দাঁড়ায় ৪৩ জনে। করোনা আতঙ্কে ইতালির দশটি শহর বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। এতে অর্ধলাখ মানুষ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। সেখানে বাতিল করা হয়েছে বিখ্যাত ভেনিস কার্নিভাল। ইতোমধ্যে ওই উৎসবে যোগ দিতে হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়েছিলেন। দেশটিতে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন অন্তত ১৩৩ জন। এর মধ্যে লম্বার্ডি এলাকায়ই আক্রান্ত হয়েছেন ৮৯ জন। ইউরোপের মধ্যে ইতালিতেই এখন সর্বোচ্চসংখ্যক করোনা ভাইরাস আক্রান্ত লোক শনাক্ত হলো। করোনা আক্রান্ত এক প্রবীণ নারী গতকাল মারা গেছেন। এ নিয়ে ইতালিতে করোনা থেকে সৃষ্ট কভিড-১৯ রোগে তিনজনের মৃত্যু হলো। করোনা আতঙ্কে ভেনিসের স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য উন্মুক্ত সরকারি স্থান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
ফ্রান্সের অর্থমন্ত্রী বলেছেন, করোনা ভাইরাসের কারণে তার দেশে পর্যটন খাতে বড় ধাক্কা লেগেছে। সেখানে পর্যটকের সংখ্যা ৪০ ভাগ কমে গেছে। ফ্রান্সে প্রতিবছর ২৭ লাখ চীনা নাগরিক ভ্রমণে যান।
ইরানে নতুন করে আরও ১৫ জনের দেহে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়েছে। ফলে ৪৩ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। কওম শহর থেকে মানুষের চলাচলের মধ্য দিয়ে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে তেহরান, বাবোল, আরাক, ইসফাহান এবং অন্যান্য শহরে। এমন অবস্থায় গতকাল থেকে দেশটির অন্তত ১৪টি প্রদেশে বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তুরস্ক ও পাকিস্তান ইরানের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে আর আফগানিস্তান দেশটির সঙ্গে স্থল ও আকাশপথ বন্ধ করে দিয়েছে। জর্ডানে চীন, ইরান ও দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে ফের সতর্কবার্তা দিয়েছে। এবার সংস্থাটি চিন্তায় পড়েছে আফ্রিাকার দেশগুলো নিয়ে। দুর্বল স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে দারিদ্র্যপীড়িত আফ্রিকান দেশগুলোতে এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি হবে আরও ভয়াবহ। সংস্থাটি আরও বলেছে, চীনের সঙ্গে স্পষ্ট যোগাযোগ নেই, এমন সব জায়গায় ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া নিয়ে তারা যথেষ্ট উদ্বিগ্ন।
দ. কোরিয়ায় শঙ্কায় বাংলাদেশিরা : দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষের মধ্যে করোনা ভাইরাস আতঙ্ক কতটা জেঁকে বসেছে তা আক্রান্ত শহরগুলোর রাস্তায় বের হলেই বোঝা যায়। দেশটির দায়েগু শহর থেকে জিয়াউর রহমান বলেন, রাস্তাঘাটে কেউ নেই, একদমই ফাঁকা। শিশুরা নেই, বয়স্ক লোকদের কাউকেই রাস্তাঘাটে দেখা যাচ্ছে না। গত দুই দিন ধরে এমন অবস্থা দেখছি। তিনি দক্ষিণ কোরিয়ায় এই শহরে আছেন আট বছর ধরে, কাজ করেন একটি কারখানায়।
তিনি বলেন, দায়েগুতে চার হাজারের বেশি বাংলাদেশি রয়েছে এবং তাদের মধ্যে ফেসবুক বা অন্য উপায়ে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। যেসব কথাবার্তা শুনছি, তাতে বুঝতে পারছি যে বাংলাদেশিরা ভীষণভাবে আতঙ্কিত।
তিনি বলেন, একটা শপিং মলে গিয়েছিলাম বাজার করতে। খাদ্যদ্রব্য তেমন একটা নেই। ফলমূলের অভাব দেখা যাচ্ছে। মানুষ আগেই সব কিনে ফেলেছে। বেচাকেনা মোটামুটি শেষ। হ্যান্ডওয়াশ কিনতে গিয়েছিলাম, পাইনি।
ঘরে খাবার মজুদের প্রবণতা দেখা গেছে দক্ষিণ কোরিয়ায় অন্য বাংলাদেশিদের মধ্যেও। দেগু থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরের বুসান শহরে থাকেন এ জামান শাওন। তিনি দক্ষিণ কোরিয়ায় আছেন চার বছর ধরে।
শাওন বলছেন, তিনি নিজেও এক মাসের খাবার কিনে ঘরে জমিয়ে রেখেছেন এবং তার পরিচিত অন্য অনেকেই এটা করেছেন।
নারীদের চেয়ে পুরুষরা বেশি ঝুঁকিতে : করোনা নিয়ে বিশ্বব্যাপী উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ছে। তবে ভাইরাসটি একটি বিপন্ন গোষ্ঠীকে তেমন স্পর্শ করছে না। তারা হলো শিশু। অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে, মধ্যবয়সী ও বয়স্ক পুরুষরা এ ভাইরাসে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন।
চীনের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র প্রকাশিত তথ্যের বরাতে জানায়, দেশটিতে এখন পর্যন্ত নারী ও পুরুষ সমান সংখ্যায় করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। তবে পুরুষের মৃত্যুর হার ২ দশমিক ৮ শতাংশ এবং নারীদের ১ দশমিক ৭ শতাংশ। এর আগে সার্সে পুরুষদের চেয়ে নারীরা বেশি আক্রান্ত হলেও পুরুষদের মৃত্যুর হার শতকরা ৫০ ভাগ বেশি ছিল।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভাইরাসে পুরুষদের বেশি ঝুঁকির কারণ জৈবিক ও জীবনধারার সঙ্গে সংশ্নিষ্ট। সংক্রামক ব্যাধিতে পুরুষরা বেশি দুর্বল হয়ে পড়ে। ভাইরাসের সংক্রমণে পুরুষরা কেন বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ডে পৌঁছানো যায়নি। তবে জৈবিক কারণের মধ্যে নারীদের সেক্স হরমোন (দুটি এক্স ক্রোমোজম), সন্তানকে স্তন্যদানের মতো কিছু বিষয় এ ক্ষেত্রে রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে বলে মনে করা হয়।
জীবনধারার কারণেও পুরুষরা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। চীনের ৩১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ ধূমপায়ী। দেশটির অর্ধেক পুরুষই ধূমপান করে থাকে। তবে নারীদের ক্ষেত্রে এই হার মাত্র দুই শতাংশ। চীনে পুরুষদের মধ্যে নারীদের চেয়ে টাইপ টু ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের হারও বেশি। এ কারণেও করোনা সংক্রমণে পুরুষরা বেশি ঝুঁকিতে।