চীনের দ্বিতীয় বেল্ট রোড়, ফোরামের সফল সম্মেলন

65


গত ১৫ এপ্রিল চীনে দ্বিতীয় বেল্ট রোড ফোরামের সম্মেলন শুরু হয়, প্রায় ৩ দিনের মতো আলাপ আলোচনার পর অতি সাফল্যের সহিত তা সমাপ্ত হয়েছে। সম্মেলন শেষে চীন এক বিবৃতিতে জানিয়েছে যে সম্মেলনে আরও অনেক নতুন দেশের সাথে চীনের স্মারকলিপি স্বাক্ষরিত হয়েছে যার মধ্যে ইটালী, পেরু, বারবোডাস, লুক্সেমবার্গ এবং জামাইকাও রয়েছে। শ্রীলংকা, মালদ্বীপ এবং মালয়েশিয়া যে সব চীনা অবকাঠামো প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, দেশগুলিতে সরকার পরিবর্তনের সাথে এসব প্রকল্পগুলির বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে কিন্তু চীন সরকারের সাথে কোন সংঘাত ছাড়াই আলাপ আলোচনার মাধ্যমে পুনরায় আগের চুক্তি সংশোধিত বা নবায়ন করে এসব আপত্তির মীমাংসা করা হয়েছে। কোথাও কোন প্রকল্প এই পর্যন্ত বাতিল হয়ে যায় নাই এবং এ ব্যাপারে চীন সরকারের সাথে দীর্ঘ কোন মনোমালিন্যও সৃষ্টি হয়নি।
মালশিয়াকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজাক-এর আমলে চীনের সাথে নেয়া বিভিন্ন ব্যয়বহুল প্রকল্পে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে বলে নয়া প্রধানমন্ত্রী মাহাথিরের অভিযোগ। সবচাইতে আলোচিত অভিযোগ হলো ‘ইস্ট কোস্ট রেল প্রকল্প, প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের ইহা বড় প্রকল্প এবং এটা চীনের বেল্ট রোড মহা প্রকল্পের অংশও। মাহাথির ক্ষমতায় আসার পর বললেন এতবড় বিনিয়োগের শক্তি মালয়েশিয়ার নেই কিন্তু তিনি কোনদিন এই প্রকল্প অপ্রোয়জনীয় সে কথা বলেন নাই। এদিকে চীনা কোম্পানী প্রকল্পের কাজ অনেক আগেই শুরু করেছিল। মাহাথিরের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ৩ মাসের মধ্যে তিনি চীন সফর করেছিলেন এবং রেল প্রজেক্ট সম্পর্কে তিনি তখন বলেছিলেন যে এই প্রকল্পের খরচ বেশী যা মালয়শিয়ার সামর্থের বাইরে। তাই তখনকার মতো ইহা বাতিল করা হচ্ছে। তখনও তিনি বলেছিলেন চীনের সাথে মালয়েশিয়ার সম্পর্ক অটুট থাকবে। ইহাতে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিল এবং তাঁরা তখন থেকে ‘চীনের ঋণের ফাঁদের’ ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে তীব্র প্রচার শুরু করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ১২ই এপ্রিল মালয়েশিয়া সরকারীভাবে জানিয়েছেন যে তাঁরা রেল প্রজেক্ট বাস্তবায়নের জন্য আবার নুতুনভাবে চীনের চুক্তি স্বাক্ষর ইতিমধ্যেই করেছে, সে খবর আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মিডিয়াতেও এসেছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ার খবরে আরো জানা যায় যে এখন থেকে চীন আমেরিকার সয়াবিন তেলের উপরে নির্ভরশীলতা কমিয়ে মালয়েশিয়ার পাম-ওয়েলের একচেটিয়া ভোক্তা হবে। কাজেই পরিত্যক্ত চীনা রেল লিংক প্রকল্প নিয়ে চীনের সাথেই মাহাথির নিজেই চুক্তি করেছেন।
গত ২৫ এপ্রিল থেকে চীনে দ্বিতীয় বেল্ট রোড় অর্থাৎ বেল্ট রোড় ফোরামের সম্মেলন শুরু হয়েছিল। মাহাথির মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সে সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন এবং সেখানে তিনি বিশ্বের চার অতিথি বক্তার একজন হিসাবে ছিলেন। এপ্রিলের ২৫ তারিখে যে দ্বিতীয় বেল্ট রোড় ফোরামের সম্মেলন শুরু হয়েিিছল, শুধু সে সপ্তাহেই নতুন করে বিভিন্ন দেশের নতুন চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। শি জিন পিং বলেছেন তিনি চীনের পুরানো সিল্করোড উদ্যোগ নিয়ে চীনকে এশিয়া এবং ইউরোপের সাথে সংযোগ করার প্রয়াস চালাচ্ছেন তা হবে অতি উন্নতমানের উন্নয়ন।
সম্মেলনে শি. জিন পিং এবং চীনের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ বার বার আশ্বস্ত করেছেন যে বি আর আই কোনদিন অংশগ্রণকারীদের জন্য বোঝা হয়ে দাড়াবেনা। সম্মেলনে চীনের প্রেসিডেন্টের বক্তৃতার শেষে বলা হয়েছিল- ‘More and more friends and partners will join in Belt and Road co-operation. The co-operation will enjoy higher quality and brighter prospect.’ এই সম্মেলনে চীনের প্রেসিডেন্ট আপ্রাণ চেষ্টা করেছেণ এই উদ্যোগের বিরোধীরা যে অপ প্রচার চালাচ্ছেন সে বিষয়ে অংশগ্রহণকারীদের বার বার আশ্বস্ত করতে। সম্মেলন শেষে চীন এক বিবৃতিতে জানান চীন আরও অনেক নতুন দেশের সাথে বি. আর. আই. এ. অংশ গ্রহণকারী হিসাবে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। এই সব দেশ সমূহের মধ্যে ইটালী, পেরু, লুমেক্সবার্গ এবং জামাইকাও রয়েছে। অনুষ্ঠিত সম্মেলনে যে উদ্যোগ, উদ্দীপনা দেখা গেছে আমেরিকারসহ যেসব দেশ চীনের উদ্যোগকে ব্যর্থ করতে চায় তাঁরা ইতিমধ্যেই হতাশ হয়ে পড়েছেন। কারণ চীনে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে যে উদ্যোগ উদ্দীপনা দেখা গেছে তাতে মনে হয়না চীনের এই উদ্যোগের শত্রুরা কোন প্রকারের সফলতা অর্জন করতে পারবে না। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো তাদের হাতে চীনের এই পরিকল্পনার বিকল্প কোন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নাই। আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পরই সারা বিশ্বকে জানালেন, “America First” এই শ্লোগানকে বাস্তবায়িত করতে কি কারণে বিশ্বের সমস্ত দেশ উদ্যাম উদ্দীপনা নিয়ে মাঠে নেমে যাবে? ধৃষ্টতারও একটা পরিমাণ থাকা উচিত। যাই হউক, এই সম্মেলনে দেওয়া হিসাব অনুযায়ী চীনের এই রোড়, এবং বেল্ট প্রকল্পে (বি আর আই) সর্বমোট বিনিয়োগ করা হবে ৩.৬৭ ট্রিলিয়ন ডলার। চীনের প্রেসিডেন্ট সম্মেলনে সবাইকে আশ্বস্ত করেছেন চীন ঋণের ব্যাপারে এমন এক অবকাঠামো গড়ে তুলবেন যাতে ঋণ কোন দেশের জন্য বোঝায় পরিণত না হয়।
বিশ্বে এখনও অর্থনৈতিক এবং আব্রাহাম লিংকন ইত্যাদি প্রেসিডেন্টগণ সামরিক দিক দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সবচাইতে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। শুধু দাস প্রথার কথাটা ভাবলেই অবাক হতে হয়। আফ্রিকা থেকে আগত নিগ্রো ক্রীতদাসদেরকে মুক্ত করে তাদেরকে সমস্ত একীভূত করে নেওয়ার এই মহান কাজ শুধু আমেরিকানদের পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয় বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্প ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকে যে সব নীতি গ্রহণ করা হয়েছৈ তাতে বিশ্বের জনমত আমেরিকার বিরুদ্ধে দ্রুত চলে যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকার, এশিয়া এবং আফ্রিকাসহ বিশ্বের প্রায় অঞ্চলে আমেরিকার জনপ্রিয়তা দ্রুত কমে যাচ্ছে। বর্তমানে ডেমোক্রেটিক পার্টির সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরোধ তুঙ্গে চলছে। তার নিজের দল রিপাবলিকান পার্টিরও সব সদস্য প্রেসিডেন্টের আচর আচরণে সন্ত্রষ্ট নয়।
ডেমোক্রেটিকদের বিশ্বাস ট্রাম্পের আয় কর হিসাব এবং তাঁর অন্যান্য আর্থিক লেনদেনে অবিশ্বাস্য রকমের ফাঁকি রয়েছে। কাজেই তারা ইতিমধ্যে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে তাকে অভিশংসিত না করে একের পর এক মামলা দিয়ে তদন্তের ব্যবস্থা করলে সব ফাঁকি বেরিয়ে যাবে। এই লড়াইয়ে প্রাক্তন পর রাষ্ট্র সেক্রেটারী হিলারী ক্লিনটন ও যোগ দিয়েছেন। ঐদিকে সংবাদ মাধ্যমগুলি প্রেসিডেন্টের শপথ নেওয়ার পর থেকে এই পর্যন্ত ১০,০০০ হাজার মিথ্যা কথা বলার যে লিস্ট তৈয়ার করেছেন তা প্রতিদিনই মিডিয়ার মাধ্যমে একটি একটি করে প্রমাণ করার কাজ আরম্ভ করেছেন।
তোমার আসন হতে যেথায় তাদের দিলে ঠেলে
সেথায় শক্তিতে তব নির্বাসন দিলে অবহেলে।
চরণে দলিত হয়ে ধুলায় সে যায় বয়ে
সেই নিম্নে নেমে এসো, নহিলে না হিরে পরিত্রাণ
অপমান হতে হবে আজি তোরে সবার সমান।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
লেখক : কলামিস্ট