চিরবিদায়েও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা জুটেনি মুক্তিযোদ্ধার ভাগ্যে

229

বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম প্রতিবাদকারী মৌলভী ছৈয়দের বড়ভাই মুক্তিযোদ্ধা ডা. আশরাফ আলীকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দেয়া হয়নি। গতকাল সকাল ১১টায় জানাজার পূর্বনির্ধারিত সময়েও প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের কেউ উপস্থিত না হওয়ায় গার্ড অব অনার ছাড়াই এই মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ দাফন করা হয়। পরে বিলম্বিত সময়ে উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) আতিকুর রহমান সেখানে গেলে পরিবারের সদস্যরা আপত্তি তুলেন। এ সময় জানাজায় উপস্থিত লোকজনও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোমেনা আক্তার ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) আতিকুর রহমান মুক্তিযোদ্ধা আলী আশরাফের কবরে পুস্পস্তবক অর্পণ করেন।
এর আগে গত রবিবার দুপুরে মুক্তিযোদ্ধা ডা. আলী আশরাফ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। গতকাল সকাল ১১টায় জানাজা অনুষ্ঠিত হয় শেখেরখীল লালজীবনে হাছনির বাপের জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে। পরে মরদেহ ছোট ভাই মৌলভী ছৈয়দের কবরের পাশেই মুক্তিযোদ্ধা ডা. আশরাফ আলীর দাফন সম্পন্ন হয়।
গতকাল সকালে মুক্তিযুদ্ধের এই বীর সেনানীকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা না দেয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে স্থানীয় সাংবাদিকদের ডেকে জানানো হয়, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দাপ্তরিক কাজে ব্যস্ত থাকায় এসিল্যান্ডকে সেখানে যাওয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়। এসিল্যান্ড নির্ধারিত সময়ের আগেই সেখানের উদ্দেশ্যে বের হন। কিন্তু সড়কে প্রতিবন্ধকতার কারণে নির্ধারিত সময়ে জানাজায় পৌঁছাতে পারেননি। দেরিতে পৌঁছে গার্ড অব অনার দিতে চাইলেও একটি পক্ষ সেখানে উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয়।
এদিকে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটনে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) বদিউল আলমকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হযেছে। কমিটিকে দ্রুত প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ কামাল হোসেন পূর্বদেশকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা না দেয়ার বিষয়টি তদন্তে এডিএমকে প্রধান করে একটি কমিটি করা হয়েছে। উনি কালকেই (আজ) সেখানে যাবেন। পুরো বিষয়টি জেনেই উনাকে একটি প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ প্রতিবেদন পেলেই ভুল বুঝাবুঝিটা কোথায় হয়েছে জানা যাবে। এতে যদি কারো দোষ খুঁজে পাওয়া যায় তাহলে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
চট্টগ্রাম মহানগর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোজাফ্ফর আহমদ পূর্বদেশকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধে মৌলভী ছৈয়দের অবদান ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম প্রতিবাদকারী তিনি। উনার ভাই মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার পরেও এভাবে সম্মান না জানানোয় আমরা মুক্তিযোদ্ধারা বিব্রতবোধ করছি। এটা দুঃখজনক। আমি এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। ঘটনাটি শুনার পরপরই আমি ডিসি সাহেবের সাথে কথা বলেছি। উনি বিষয়টি তদন্ত করার কথা বলেছেন। ইতোমধ্যে একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে বলে জেনেছি।
চট্টগ্রাম জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের অর্থ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক পূর্বদেশকে বলেন, রনাঙ্গনে সামনের সারিতে থেকেই যুদ্ধ করেছিলেন মৌলভী ছৈয়দ ও ডা. আলী আশরাফ। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রথম প্রতিবাদ করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন মৌলভী ছৈয়দ। এই পরিবারটিকে সবসময় অবহেলা করা হয়েছে। কখনো তাদের ত্যাগের মূল্যায়ন হয়নি। মৃত্যুর পরেও ডা. আলী আশরাফকে রাষ্ট্রীয় শোক জানানো হয়নি। দেয়া হয়নি গার্ড অব অনার। এটা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য লজ্জাকর। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নাকি প্রশাসনের গাফিলতি তা তদন্তের দাবি জানাচ্ছি।
জানাজায় উপস্থিত থাকা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আব্দুল গফুর পূর্বদেশকে বলেন, জানাজা ছিল ১১টায়। পুলিশ ঠিক সময়ে আসলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কেউ না আসায় জানাজায় আসা মানুষ উত্তেজিত হয়ে পড়ে। পরে লাশ দাফন করে ফেলে। এরপরে এসিল্যান্ড আসলেও গার্ড অব অনার নিতে রাজি হয়নি পরিবার। এখানে প্রশাসনের গাফিলতি ছিল। জাতির একজন শ্রেষ্ঠ সন্তানের এমন বিদায় কাম্য নয়। উনি শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধা নন, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম প্রতিবাদকারী শহীদ মৌলভী ছৈয়দের বড় ভাই। আমরা এ ঘটনায় ব্যথিত, লজ্জিত, দুঃখিত। একজন মুক্তিযোদ্ধার সম্মানহানি মানেই পুরো জাতির সম্মানহানি। এ ঘটনা জাতির বিবেককে নাড়া দিয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধা ডা. আলী আশরাফের ছেলে দক্ষিণ জেলা কৃষক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জহির উদ্দিন বাবর বলেন, আওয়ামী লীগ আমার বাবা ও আমার পরিবারকে অসম্মান করেছে। কেউ প্রশাসনকে হয়রানি করবেন না। আমি আপনাদের কাছ থেকে ক্ষমা চাই। শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রেখে প্রশাসনকে পাঠিয়ে দেন। আর জীবনে মৌলভী ছৈয়দের পরিবার আওয়ামী লীগ করবে না। এ দেশের আওয়ামী লীগ সৃষ্টিতে ভূমিকা ছিল মৌলভী ছৈয়দের। অথচ আজ মৌলভী ছৈয়দের পরিবারকে লাঞ্ছিত বঞ্চিত করা হলো। আমাদের পরিবারের প্রতি দীর্ঘদিন ধরে যে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা দেখানো হচ্ছিল বাবার মৃত্যুতে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটানো হয়েছে।
বাঁশখালী থানার অফিসার ইনচার্জ মো. রেজাউল করিম মজুমদার পূর্বদেশকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা আলী আশরাফ সাহেবের মৃত্যুর বিষয়টি জানার পর জেলা পুলিশ থেকে টিম পাঠানো হয়েছিল। সেই টিমের সাথে বাঁশখালী থানার একটি টিমও সেখানে ছিল। তারা নির্ধারিত সময়েই জানাজায় গিয়েছিল। কিন্তু প্রশাসনিক কর্মকর্তা যেতে দেরি হওয়ায় পরিবারের সদস্যরা মরদেহ দাফন করে ফেলে।
এদিকে আজ দুপুরে উপজেলা সদরে মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের আহবায়ক ও দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ফয়সল জামিল চৌধুরী সাকি পূর্বদেশকে বলেন, আমরা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। এ নিয়ে আমরা মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করেছি। আগামীকাল (আজ) দুপুরে উপজেলা সদরে এ কর্মসূচি পালন করবো।