চিনের আগ্রাসী আচরণ ও লাদাখে সংঘর্ষ

35

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

বিশ্ব যখন অদৃশ্য আততায়ী করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিপর্যস্ত, তখন এদিকে চিন আরেক যুদ্ধের মহড়া দিচ্ছে। সুপার পাওয়ার হওয়ার উন্মত্ততায় চিন তার আশেপাশের দেশগুলোর জন্য এক মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। কখনো তাইওয়ানের আকাশে জঙ্গি বিমানের আনাগোনা, কখনো বা ভারতের হিমালয়সংলগ্ন বিতর্কিত লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল (এলএসি) এলাকায় ভারতীয় সৈন্যদের ওপর হামলা করে চিন শক্তির মহড়া দিচ্ছে। গত সোমবার সিকিম ও কাশ্মীরের গালওয়ান উপত্যকার উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের লাদাখ এলাকায় চিনা সৈন্যদের হামলায় ভারতের ২০ জন্য সৈন্য নিহত ও ৫৮জন আহত হয়েছে। এর মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার তারা ধরে নিয়ে যাওয়া ভারতীয় সৈন্যদের ফেরত দিয়েছে। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ ও সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত সীমান্ত বলে পরিচিত। এই সীমান্ত এলাকার চারটি পয়েন্টে চিন হাজার হাজার সৈন্য মোতায়েন করেছে।
১৯৬২ সালের অক্টোবর মাসব্যাপী চিন-ভারত যুদ্ধ এই ইস্যুতেই হয়েছিলো। বস্তুত ইতিহাসের নিষ্ঠুর পরিহাস এই যে, প্রায় একই সময়ে স্বাধীনতা লাভকারী প্রতিবেশি দুটি দেশ দেড় দশকেরও কম সময়ের ব্যবধানে পরস্পরের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলো। কমিউনিস্ট নেতা মাওসেতুং-এর নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালে আবির্ভূত নব্যচিনের অঙ্গীকার ছিলো সমাজতন্ত্রে উত্তরণ। পক্ষান্তরে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত ভারতের অঙ্গীকার সমাজতন্ত্র না হলেও দেশটির প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু সমাজতন্ত্রী হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। এতদসত্তে¡ও চিন এবং ভারতের মধ্যে যুদ্ধ ঠেকানো যায় নি। যুদ্ধজোটের বিরুদ্ধে একটি প্রবল প্রতিবাদ ঘোষিত হয়েছিলো বান্দুং-এ নির্জোট সম্মেলনে। ভারত তো নির্জোট সম্মেলনের প্রধান উদ্যোক্তাই ছিলো। চিনের সমর্থন ছিলো। তা’ সত্তে¡ও চিন বা ভারতকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হতে হয়েছিলো।
যুদ্ধে আক্রমণকারী ছিলো চিন; ভারতের যুদ্ধ এড়িয়ে যাবার কোন উপায় ছিলো না। কারণ আক্রান্ত হলে আত্মপক্ষ তো সমর্থন করতেই হয়। ৬২’র যুদ্ধে চিন ভারতের কিছু জায়গা দখল করে নিয়েছিলো, পরে যা’ ফেরত দিয়েছিলো। সেই থেকে চিন-ভারত সীমান্ত বিরোধের সূচনা। সেই থেকে বিশাল বিতর্কিত সীমান্ত জুড়ে চিন শুধু সৈন্য সমাবেশ করে আসছিলো।
২০১৮ সালে ভারতের পররাষ্ট্র বিষয়ক সংসদীয় কমিটি এলএসি এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে দেখতে পায়, ভারতীয় ভূখÐে স্থাপনা খুবই অপ্রতুল, অন্যদিকে সীমানার ওপারে চিন যানবাহন চলাচলের রাস্তাঘাট, রেললাইন, এমনকি বিমানবন্দরও তৈরি করে ফেলেছে। আর এলএসির ভারতীয় প্রান্তে চলাচলের ভালো রাস্তাও নেই।
চিনেরএই আগ্রাসনের আসল উদ্দেশ্য দু’টি। প্রথমত ভারতকে চাপে রাখা; ভারতের ওপর চিন এই চাপ সৃষ্টি করেই যাবে। ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য অরুণাচল প্রদেশকে চিন নিজেদের ভূখÐ বলে দাবি করে এবং এলাকাটিকে তারা ‘দক্ষিণ তিব্বত’ নামে অভিহিত করছে। চিন ঐ এলাকার মালিকানার দাবি ক্রমশ বাড়াতে থাকবে-অবস্থাদৃষ্টে এমনটাই মনে হচ্ছে। চিনের শক্তি প্রদর্শনের আরো বড় কারণ হলো বিশ্বকে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নিজেদের মোড়লিপনা জাহির করা। ভাবখানা এমন ট্রাম্পের ধমকের তারা থোড়াই কেয়ার করে। একই সঙ্গে ভারতকে চাপের মধ্যে রেখে এশিয়ার অন্য দেশগুলোকেও তারা ভয় দেখিয়ে চলেছে।
১৯৬২ সালের পর বহু বছর চিন-ভারত সংঘর্ষের ঘটনা আর ঘটেনি। যদিও প্রতি বছরই এলএসিতে অস্বস্তিকর ঘটনা ঘটেছে। ৭৬ সালের পর থেকে আবার কিছু কিছু হাতাহাতি ধস্তাধস্তি ও মারামারির ঘটনা ঘটে আসছে। ২০১৭ সালে সীমান্ত সংঘর্ষ হয়েছে। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে শান্তির জন্য বৈঠক হয়েছে। তারপরই এমাসে চিন হামলে পড়লো ভারতীয় সৈন্যদের ওপর।
চিন এখন গালওয়ান উপত্যকায় সার্বভৌমত্ব দাবি করছে চিন। যা আগে কখনো করে নি। এতে দু’দেশের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে আলোচনা সম্ভাবনা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ’৬২র অক্টোবর ঠিক এই জায়গাতেই চিন ৩৬জন ভারতীয় সৈন্যকে হত্যা করলে যুদ্ধ শুরু হয়। এখন চিন, ভারত এই বিরোধে দক্ষিণ এশীয় ক্ষুদ্র দেশগুলোর ওপর একটা চাপ সৃষ্টি হতে পারে এবং চিন ও ভারতের দুটি বলয়ের সৃষ্টি হতে পারে।
চিনের পরাশক্তি হওয়ার খায়েশ হয়েছে। সেই খায়েশ পূরণের জন্য তারা ভারতের সঙ্গে গায়ে পড়ে, পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া বাধাচ্ছে। এতে শুধু শান্তিই বিঘিœত হয়েছে। ভারত প্রত্যুত্তর দিলেই যুদ্ধ লেগে যাবে। কিন্তু সেই যুদ্ধ কারো কাম্য হতে পারে না।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, সিনিয়র সাংবাদিক