চিকিৎসকদের মানসিক চাপ, দায় কার ?

79

অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের চিকিৎসকরা রোগীর পেছনে সবচেয়ে কম সময় ব্যয় করার অভিযোগ আসে প্রায়ই। একজন রোগীর জন্য গড়ে ৪৮ সেকেন্ড সময় দেন তারা। এর পেছনে সমালোচকরা অর্থোপার্জনকেই বড় কারণ হিসেবে দেখেন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।
চিকিৎসা সাময়িকী ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে (বিএমজে) প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা বিশ্বেই রোগী দেখার সময়ের ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। বেশির ভাগ দেশেই রোগীরা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করতে সময় পান মাত্র কয়েক মিনিট। এর বিরূপ প্রভাব পড়ে রোগীর স্বাস্থ্যসেবার ওপর। প্রতিবেদনে এটাও বলা হয়েছে-অতিরিক্ত রোগীর ভিড়ে মানসিক চাপ পড়ে চিকিৎসকের ওপর।
আমাদের দেশে রোগীর তুলনায় চিকিৎসকের সংখ্যা অনেক কম। প্রত্যেক দেশে পরিকল্পনামাফিক হাসপাতাল থাকে, কিন্তু এদেশে সেটা নেই। ফলে একজন চিকিৎসককে দিনে ১৫০ থেকে ২৫০ জন রোগীও দেখতে হয়। এত বেশি রোগীকে সময় দিতে হলে স্বাভাবিকভাবেই সময় কমে আসবে। সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গেলেই মিলবে এর সত্যতা।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ বলছে, দেশের প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ১৭ শতাংশ কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত, যাদের ৯২ শতাংশ চিকিৎসা নেয় না। আর চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের গবেষণা বলছে, খোদ চিকিৎসকদের মধ্যে মানসিক রোগ সাধারণ মানুষের চেয়ে শতকরা ১০ থেকে ৩০ ভাগ বেশি। লন্ডনে শতকরা ১০ থেকে ২০ ভাগ চিকিৎসক বা চিকিৎসাবিদ্যার শিক্ষার্থী হতাশায় ভুগে আত্মহত্যার কথা ভাবেন। কানাডা ও সুইজারল্যান্ডে শতকরা ৮০ ভাগ চিকিৎসকই এই পেশার প্রতি বিতৃষ্ণা পোষণ করেন। নিউজিল্যাণ্ড চিকিৎসকদের মধ্যে বিষণ্নতা, উদ্বিগ্নতা ও ওষুধের অপব্যবহার সাধারণ মানুষের চেয়ে ৩ গুণ বেশি। এমনকি আমেরিকায়ও চিকিৎসকদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতার হার সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি। সামগ্রিকভাবে চিকিৎসকদের মধ্যে সমন্বয়ে বিপত্তি ও বিবাহ বিচ্ছেদ সাধারণ মানুষের তুলনায় অনেক গুণ বেশি।
দুই বছর আগে সরকারিভাবে সিদ্ধান্ত ছিল, ৩৯তম বিশেষ বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে ১০ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হবে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর গত ১৯ নভেম্বর ৪ হাজার ৪৪৩ জন চিকিৎসককে স্বাস্থ্য ক্যাডারে নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। আর অপেক্ষমাণ নন ক্যাডার থেকে চিকিৎসক নিয়োগের উদ্যোগ নিচ্ছে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। যারা নিয়োগ পাননি, তাদের মনের অবস্থা এখন কেমন-তা ভুক্তভোগীরাই জানেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে সবচেয়ে বেশি বেকার হলেন চিকিৎসক। অথচ দেশে চিকিৎসক হতেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়। বেকারদের মধ্যে চিকিৎসক-প্রকৌশলীদের হার ১৪ দশমিক ২৭ শতাংশ। এদের মধ্যে নারী চিকিৎসকদের অবস্থা আরও খারাপ। তাদের বেকারত্বের হার প্রায় ৩১ শতাংশ।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানাচ্ছে, দেশে চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত চিকিৎসক তৈরি হচ্ছে। আর এই অতিরিক্ত চিকিৎসকই একসময় স্বাস্থ্য খাতের বোঝায় পরিণত হবে। এমবিবিএস ও বিডিএস পাস করেও নিজ পেশায় কাজ মিলবে না। জীবিকার প্রয়োজনে তাদের অন্য পেশায় কাজ করতে হবে। যার নমুনা এখনই মিলছে।
বলা যায়, ইন্টার্ন (শিক্ষানবিশ) চিকিৎসকরাই সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা চালিয়ে নিচ্ছেন। এমবিবিএস পাস করা একজন চিকিৎসক হাসপাতালে প্রশিক্ষণ নিতে পালাক্রমে ২৪ ঘণ্টাই রোগীর চিকিৎসায় যুক্ত থাকেন। বহির্বিভাগ, জরুরি বিভাগ ও অন্তর্বিভাগে শত শত রোগী দেখতে হয়, রোগীর কথা শুনতে হয়, তাদের তথ্য লিখতে হয়, চিকিৎসা দিতে হয়। অধ্যাপকের জন্য নোট তৈরি করে রাখতে হয়। কিন্তু মাস শেষে মেলে মাত্র ১৫ হাজার টাকা। এক বছরে তারা ছুটি পাচ্ছেন ১৫ দিন। এর মধ্যে রাজনৈতিক দলের নেতা বা কর্মী, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ বিশেষ কিছু রোগীর স্বজনের চাপে চিকিৎসাসেবায় তাদেরও ভুল হচ্ছে। এতে তর্কাতর্কি-হাতাহাতি আর মারধরের ঘটনাও ঘটছে প্রায়ই।
এ অবস্থায় সরকারি চাকরিতে কর্মরত কোনো চিকিৎসক অফিস সময়ে ব্যক্তিগত চেম্বার করতে পারবেন না, ছুটির দিনে চিকিৎসকদের নিজ নিজ কর্মস্থলের জেলার বাইরে টাকার বিনিময়ে সেবা দিতে সরকারের অনুমতি লাগবে, চিকিৎসাসেবা বাবদ আদায়কৃত মূল্য বা ফি রসিদের মাধ্যমে আদায় করতে হবে-এমন কিছু বিধান রেখে ‘স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইন-২০১৯’ এর খসড়া চূড়ান্ত করেছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ।
প্রস্তাবিত আইনের ধারা ১২ (১) এবং ১২ (২) অনুযায়ী, সেবাগ্রহীতাদের ন্যূনতম বসার জায়গা রাখা, চেম্বারে চিকিৎসকের দক্ষতা অনুযায়ী ‘ন্যূনতম’ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামাদি রাখার কথা বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একজন রোগীর সঙ্গে একাধিক অভিভাবক আসেন-যাদের বসার জায়গা করে দেওয়াটা কষ্টকর। তাছাড়া অনেক নবীন চিকিৎসক ওষুধের দোকানে চেম্বার করেন, যেখানে সেবাগ্রহীতাদের বসার জায়গা তেমন থাকে না। এক্ষেত্রে আইনটি পাস হলে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে, যা গ্রহণযোগ্য নয়। আবার চিকিৎসকরা স্বাভাবিকভাবেই চেম্বারে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামাদি রাখেন। এখানে ‘ন্যূনতম’ শব্দটা বিভ্রান্তিকর। এ ধরনের সিদ্ধান্ত চিকিৎসকদের মানসিক চাপ বাড়াচ্ছে।
বিভিন্ন সূত্র জানাচ্ছে, চিকিৎসকদের মধ্যে যেসব মানসিক রোগ সাধারণ মানুষ থেকে বেশি দেখা যায়, তার মধ্যে আছে-বিষণœতা, উদ্বিগ্নতা, অতিরিক্ত ওষুধ গ্রহণে আসক্তি, মাদকাসক্তি, আত্মহত্যা, রোগীর ব্যবস্থাপত্রে অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় নির্দেশিকা ইত্যাদি। চিকিৎসাবিদ্যার শিক্ষার্থীদের মধ্যেও আত্মহত্যার পরিকল্পনা, আত্মহত্যা বা আত্মহত্যার হার সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক বেশি। যদিও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ বিষয়টি নিয়ে কোনো গবেষণা হয়নি।
এমন মানসিক চাপ থেকে বাঁচতে চট্টগ্রামের সদ্যসাবেক সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী ও বান্দরবানের সিভিল সার্জন অং সুই প্রু মারমা স¤প্রতি ‘মধু হই হই আঁরে বিষ খাওয়াইলা’ গান গেয়ে নেট জগতে রীতিমতো ভাইরাল হয়েছেন। এটা স্বীকারও করেছেন ডা. আজিজুর। হবিগঞ্জে সিভিল সার্জনদের সম্মেলন শেষে ফেরার পথে কুমিল্লায় গাড়িতে চিরকুমারদের এই গানের ভিডিওটি ধারণ করেছিলেন চাঁদপুরের সিভিল সার্জন ডা. শাখাওয়াত উল্লাহ। আরেকটি ভিডিওতে একটি কিডস সুইমিংপুলে নাচতে-গাইতে দেখা যায় ডা. আজিজুরকে। তবে সুস্থধারার আচরণের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাকে এভাবে নাচ-গানের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ না করতে নিষেধ করা হয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে।
ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী নয়ন চন্দ্র নাথের ডান হাতের দুটি আঙ্গুল যুক্ত ছিল জন্ম থেকেই। পঞ্চম বর্ষের পেশাগত পরীক্ষার তিনটিতে অংশও নিয়েছেন। বাকি ছিল আরও তিনটি। চেয়েছিলেন সার্জারির চিকিৎসক হবেন। কিন্তু সর্বনাশা আঙ্গুল পরীক্ষার হলে তাকে যেতে দেয়নি। করাত কলে কাঠের সঙ্গে গলায় রশি দিয়েই ঝুলে পড়লেন অভিমানী নয়ন। যে ছেলেটা সার্জারির চিকিৎসক হতে চেয়েছিলেন, তিনিই পড়লেন সার্জারির কবলে; লাশ কাটা ঘরে। সমস্যায় জর্জরিত জনমানুষ তাদের ক্ষোভের প্রকাশ ঘটান চিকিৎসকদের ওপর। অনেক ক্ষেত্রে ক্ষোভের যৌক্তিক কারণ থাকলেও, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় চিকিৎসকরা সরাসরি দায়ী নন। দায় চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের। আর হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার সঙ্গে চিকিৎসকদের সংশ্লিষ্টতা থাকে খুবই কম।
বাংলাদেশে আড়াই হাজার মানুষের জন্যে একজন চিকিৎসক। আট হাজার মানুষের জন্যে একজন নার্স। এমন পরিস্থিতিতে উন্নত দেশের মতো সন্তুষ্টি আশা করা যায় না। চিকিৎসক ও রোগী প্রতিপক্ষ নন। দু-একজনের দায়িত্বে অবহেলা বা এ ধরনের কাজের জন্য একটি পেশার মানুষকে দায়ী করা চলে না। চিকিৎসকদের ওপর নাগরিকদের যে অসন্তুষ্টি, তা সহসা মিটবে না। কারণ, এখানে চাহিদা ও যোগানের মধ্যে কাজ করছে বিশাল ভারসাম্যহীনতা।

লেখক : সাংবাদিক