চিকিৎসকদের ওই প্রতিক্রিয়া গ্রহণযোগ্য নয় : প্রতিমন্ত্রী

35

নড়াইলের এমপি বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজাকে নিয়ে কয়েকজন চিকিৎসক সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে যেসব মন্তব্য করেছেন, তা কোনোভাবেই ‘গ্রহণযোগ্য নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. মুরাদ হাসান। গতকাল শুক্রবার চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘চিকিৎসকদের কাছে জাতির প্রত্যাশা অনেক’।
সংসদ সদস্য মাশরাফি গত ২৫ এপ্রিল আকস্মিকভাবে তার নির্বাচনী এলাকায় নড়াইল সদর হাসপাতাল পরিদর্শনে যান। হাজিরা খাতায় তিন চিকিৎসকের স্বাক্ষর না দেখে তিনি দু’জন চিকিৎসককে ফোন করে কথা বলেন। ওই কথোপকথনে মাশরাফির বক্তব্যের ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে চিকিৎসকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। অনেক চিকিৎসক ফেসবুকে মাশরাফির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
পরে ফেসবুকে কটুক্তি করা ছয় চিকিৎসককে কারণ দর্শাও নোটিস দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ওস প্রসঙ্গ টেনে প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান বলেন, মাশরাফিকে এদেশের মানুষ একজন ‘হিরো’, একজন দেশপ্রেমিক যোদ্ধা বলে মনে করে। শুধু একজন ভালো ক্রিকেটার হিসেবে না। মাশরাফির ভেতরে যে চেতনা, সাতবার অস্ত্রোপচারের পরেও সে যেভাবে অসম্ভব শারীরিক কষ্ট সহ্য করে খেলেন। এই যে ধৈর্য্য, সহ্য, দেশপ্রেম- সবকিছু মিলিয়ে মাশরাফি। তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নড়াইল থেকে মনোনয়ন দিয়েছেন। বিপুল ভোটে জিতেছেন। দেশের যে কোনো জায়গায় দাঁড়ালে নির্বাচিত হবেন’।
গতকাল শুক্রবার চট্টগ্রামের আড়াইশ শয্যার আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতাল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী। একইদিন বিকেল পৌনে চারটার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের অর্থোপেডিক্স বিভাগ, হৃদরোগ বিভাগ ও রেডিওথেরাপি বিভাগ ঘুরে দেখেন তিনি। এ সময় তিনি চিকিৎসাধীন রোগীদের সাথে কথা বলেন। পরবর্তীতে প্রতিমন্ত্রী চিকিৎসক নেতাদের সঙ্গে হাসপাতালের শাহ আলম বীর উত্তম মিলনায়তনে মতবিনিময় করেন। খবর বিডিনিউজের
সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মুর্তজা সম্পর্কে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, জেলা পর্যায়ের হাসপাতালের সভাপতি থাকেন সংসদ সদস্য। এলাকার হাসপাতালে সমস্যা থাকলে সেটা দেখভালের দায়িত্বও এমপির। উনি সভাপতি হিসেবে গিয়েছেন, রোগীদের কষ্টের কথা শুনেছেন। ডাক্তার সাহেবদেরকে ওই মুহূর্তে পান নাই। যাকে পান নাই নম্বর নিয়েছেন, কথা বলেছেন। কিছু কথার মধ্যে হয়তো একটু ক্ষোভ প্রকাশ হয়েছে; হতে পারে’।
যারা ‘অতি উৎসাহী হয়ে’ ওই ঘটনা ভিডিও করেছেন এবং পরে আবার ফেসবুকে ছেড়ে দিয়েছেন, তাদের ওই কাজ কোনোভাবেই কাঙ্খিত ছিল না বলে মন্তব্য করেন প্রতিমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘ডাক্তার সাহেবরা এ বিষয় নিয়ে তাকে (মাশরাফি) খুব বেশি রকম আক্রমণ করা, এটা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি শুধু একজন জাতীয় ক্রিকেট খেলোয়াড় না, মাননীয় সংসদ সদস্যও বটে। সংবিধানে তার মর্যাদা অনেক’।
চিকিৎসকদের উদ্দেশ্যে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। মানুষের সেবা করা আমাদের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য। হ্যঁঁ মাশরাফি ভাই বলেছে- আমাকে ওইভাবে বলতে হবে কেন? মাশরাফির সাথে তো আমাদের ডাক্তারদের কোনো ঝগড়া নাই, বিবাদ নাই। মাশরাফির মত মানুষ যদি একটা কথা বলেই ফেলে, যদি আমার কাছে ঠিক মনে নাও হয়। আমি কোনোদিনই ওইভাবে এটার প্রতিবাদ করতাম না’।
ডা. মুরাদ হাসান বলেন, ‘আমরা সেবা করব মানুষের। সেবা করতে গিয়ে যদি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অশ্লীল ভাষায় আক্রমণ করি, অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলি- এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটার জন্য তাদের শোকজ করা হয়েছে। সমাধান আমরা বের করব। তাদের সতর্ক হতে হবে, সংশোধন হতে হবে। সম্মানিত কোনো ব্যক্তিকে নিয়ে এভাবে কেন লিখবে? তাদের কাছে আমাদের অনেক প্রত্যাশা। একজন চিকিৎসক সবচেয়ে মেধাবী। তাদের কাছে জাতির প্রত্যাশা অনেক। তারা আরো অনেক ধৈর্য্যশীল সহ্যশীল হবেন- এটাই আমাদের আশা’।
বিকেলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শন শেষে ‘চমেক হাসপাতালের সক্ষমতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে’ বলে জানান স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. মুরাদ হাসান। তিনি বলেন, চমেক হাসপাতালে কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগ রয়েছে, সেখানে বাইপাস সার্জারি, এনজিওগ্রামের পাশাপাশি রিং পরানো হচ্ছে। ঢাকার বাইরে একমাত্র এ হাসপাতালে এসব সুবিধা রয়েছে। পাশাপশি এ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগটি অত্যন্ত আধুনিক। পর্যাপ্ত জনবলের পাশাপাশি অত্যাধুনিক সুযোগ সুবিধা রয়েছে বিভাগটিতে। ক্যান্সার বিভাগে রেডিওথেরাপি মেশিন রয়েছে। ব্র্যাকিথেরাপি সেবাও পাচ্ছেন রোগীরা। পাশাপাশি আরও কয়েকটি মেশিনের চাহিদা রয়েছে।
তিনি বলেন, চট্টগ্রামে একটি শিশু হাসপাতাল তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে জায়গা নির্ধারণ না হওয়ায় সেটির কাজ শুরু হচ্ছে না। এ হাসপাতালে শয্যা রয়েছে তেরশটি। অথচ রোগী ভর্তি থাকেন আড়াই থেকে তিন হাজার। সুতরাং সংকট থাকবে। তবে সংকট নিরসনে কাজ চলছে। অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু জায়গার সংকট রয়েছে। কিভাবে সহজে সংকট কাটিয়ে উঠা যায় সেটি নিয়ে পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসক সংকট নিয়ে সাংবাদিকরা প্রতিমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। উত্তর দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘জরুরি বিভাগে ২টা পর্যন্ত ডাক্তাররা বেশি থাকে। এরপর ডাক্তারদের সংখ্যা কমে যায়। সারাদেশের সকল হাসপাতালে সকাল ৮টা-৯টা থেকে সকল ডাক্তাররা দুইটা-আড়াইটা পর্যন্ত চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন। এরপর শিফটিং। এটা অনেকেই বোঝেন না। প্রত্যেক ডাক্তার যদি ২৪ ঘণ্টা ডিউটি করেন তাহলে তো তার পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব না’।
মুরাদ হাসান বলেন, দেশে যে ডাক্তারের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম, তা তিনিও স্বীকার করেন। ২৫০ শয্যার একটি হাসপাতারে যতজন ডাক্তার থাকা উচিৎ, বর্তমানে তা নেই। অতি সম্প্রতি ৪ হাজার ৭৯২ জন ডাক্তার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই উপজেলা, জেলা পর্যায়ে চাহিদা অনুযায়ী পদায়ন করব। আশা করি সংকট অনেকটাই কমে আসবে’।
জেনারেল হাসপাতালকে মেডিকেল কলেজে রূপান্তরের কোনো পরিকল্পনা আপাতত নেই জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এই হাসপাতালের আধুনিকায়ন কিভাবে করা যায়; অবকাঠামো, জনবল সংকট কিভাবে নিরসন করতে পারি- এটা এখন মূল লক্ষ্য ও চ্যালেঞ্জ’।
অন্যদের মধ্যে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী, জেনারেল হাসপাতালের তত্ত¡াবধায়ক অসীম কুমার নাথ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় চালু হলে এ অঞ্চলের চিকিৎসা সেবায় সংকট থাকবে না উল্লেখ করে ডা. মো. মুরাদ হাসান বলেন, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় চালু হলে সেখানে অত্যাধুনিক চিকিৎসাসেবা মিলবে। তখন সংকট থাকবে না। সারাদেশের চিকিৎসার সেবার মান উন্নয়নের জন্য সম্প্রতি পাঁচ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এসব চিকিৎসক যোগ দেয়ার পর দেশের চিকিৎসা সেবার গতি বাড়বে। পাশাপাশি জনবল সংকট নিরসনেরও কাজ চলছে।
এ সময় তিনি বলেন, প্রায় অভিযোগ শোনা যায়, চিকিৎসকরা কর্মস্থলে উপস্থিত থাকেন না। এজন্য বায়োমেট্রিক হাজিরা পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। তবে এটি চিকিৎসকদের অসম্মানিত করার জন্য নয়। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিংয়ের একটি উক্তিকে উদ্ধৃত করে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং বলেন, একজন ভালো চিকিৎসক হওয়ার আগে একজন ভালো মানুষ হতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি এ কথাটি হৃদয়ে ধারণ করি এবং আমাদের চিকিৎসক সমাজও এটি হৃদয়ে ধারণ করুক। দেশের সব চিকিৎসক খারাপ না, ভালো মানুষও আছেন’।
চিকিৎসকদের প্রতি স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘মানুষের জীবন বাঁচানো চিকিৎসকের দায়িত্ব। অন্য কোনো পেশায় জড়িতরা এ কাজ করেন না। মানুষ অসহায় হয়ে চিকিৎসকদের কাছে যান বাঁচার তাগিদে। এটি চিকিৎসকদের বুঝতে হবে’।
চমেক হাসাপাতাল পরিদর্শনকালে উপস্থিত ছিলেন চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহসেন উদ্দিন আহমদ, চমেক অধ্যক্ষ ডা. সেলিম মো. জাহাঙ্গীর, বিএমএ চট্টগ্রাম শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা. ফয়সল ইকবাল চৌধুরী প্রমুখ।