চাকরি করা হয়নি, চাপে পড়ে বিয়ে করতে হয়

34

সকালের নাস্তার পর্ব সেরে দুপুরের খাবার রাঁধা নিয়ে ব্যস্ত হালিমা (এখানে তার ছদ্ম নাম ব্যবহার করা হচ্ছে)। সারা দিনই তার কেটে যায় এই রান্না আর গৃহস্থালি কাজ নিয়ে। ঘরের কাজ করা অসম্মানের কিছু না, কিন্তু হালিমার ইচ্ছা ছিল অন্য। তার ইচ্ছা ছিল লেখাপড়া শেষ করে কাজ করা, উপার্জন করা।
তিনি বলেন, ‘আমার ইচ্ছা ছিল আমি পড়াশোনা কমপ্লিট করবো তারপর চাকরি করবো। কিন্তু আমার পরিবারের চাপে আমাকে বিয়ে করতে হয়। বিয়ের পর দেখছি, চাকরি করার স্বাধীনতা তো নেইই বরং সন্তান নেয়ার জন্য স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকের কাছ থেকে এক ধরণের চাপের মধ্যে থাকি’। হালিমা আরো জানান, ‘সন্তান নেয়ার বিষয়টি একটা মেয়ের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। কখন সে মানসিক এবং শারীরিকভাবে প্রস্তুত সেটা সেই মেয়েই বলতে পারে। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। শুধু আমার ক্ষেত্রে না, আমি দেখি আমার মত আরো মেয়েদের একই অবস্থা’।
হালিমার মতো এমন অনেক মেয়ে আছে- যাদের হয়তো পড়াশোনা শেষ করে নিজের একটা কিছু করার তীব্র ইচ্ছা আছে। কিন্তু অনেকেরই পরিবারের চাপে নিজের সেই আকাঙ্খাকে শেষ করে দিতে হয়। উপরন্তু যোগ হয় পরিবারে, অন্যদের নতুন নতুন চাহিদা মেনে নেওয়ার জন্য নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ।
বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে নারী বৈষম্যের মাপকাঠিতে বাংলাদেশের সার্বিক স্কোর এসেছে ৪৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ, যা খুবই নিচের দিকে। এতে আটটি সূচকে দেখানো হয়েছে বাংলাদেশের মেয়েদের পরিস্থিতি। সেখানে যেমন রয়েছে সম্পত্তির অধিকার, বিয়ে করা, বা সন্তান নেয়ার মতো বিষয়, তেমন রয়েছে যে কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি লাভের সুযোগের মতো দিকগুলো।
পড়াশোনা শেষ করে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন সিনথিয়া ইসলাম- চাকরির আশায়। কিন্তু কেন তিনি চাকরি পাননি- সেটা বর্ণনা করেন এভাবে- ‘আমি পড়াশোনা শেষ করে একটি কল সেন্টারে ট্রেনিং নেই। সেন্টারের নামটা আমি বলতে চাচ্ছি না। তারা বলেছিল ট্রেনিং শেষ হওয়ার পর বিভিন্ন স্থানে তারা চাকরির জন্য আমাদের সিভি পাঠাবে। যেটা দেখা গেল, আমাদের মেয়েদের কাছে চাকরির অফার আসতো। আমরা ইন্টারভিউ দিতাম। তারা বলতো নাইট শিফট করতে হবে। সেটাতেও রাজি ছিলাম। নাইট শিফট করতেও আমাদের কোনো অসুবিধা ছিল না। কিন্তু দেখা গেল- আমাদের ব্যাচের অধিকাংশ ছেলের চাকরি হলো, কিন্তু মেয়েদের হলো না। ট্রেনিং এর সময় আমরা মেয়েরা বেশি ছিলাম এবং আমাদের পারফরমেন্স ভালো ছিল। যেসব ছেলেরা চাকরি পেয়েছে তাদের কাছ থেকে জেনেছি, চাকরিদাতারা মেয়েদের নিতে ভরসা পায় না। এটা তো অবশ্যই একটা বড় জেন্ডার ডিসক্রিমিনেশন’।
পশ্চিম রাজাবাজারে কর্মজীবী নারীদের নিয়ে গড়া একটি প্রতিষ্ঠান। ভবনের চারতলায় অফিসের একটি রুমে নানা পেশার কর্মজীবী মেয়েদের প্রশিক্ষণ চলছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান রোকেয়া রফিক, যিনি একজন সমাজকর্মী এবং চাকুরিদাতা। ‘কেন মেয়েদের সার্বিকভাবে বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে’- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ‘আমি চাকুরিদাতা হিসেবে আমার সহকর্মীদের কাছ থেকে শুনেছি, ..‘আরে এই মেয়েটাকে নিলে তো কিছুদিন পর বিয়ে করবে, তারপর বাচ্চা…নানা রকমের ঝামেলা। তার চেয়ে একটা ছেলেকে নিয়োগ দেয়া ভালো’- এই ধরণের কথা। নারীর সেই পরিবেশ নেই কাজ করার। এর উপর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তার কাজকে স্বীকৃতি দিতে চান না তার নিজের প্রতিষ্ঠান। তার সফলতা আনার জন্য, কর্মক্ষম করার জন্য যে সুযোগ সৃষ্টি বা চেষ্টা নেয়া দরকার সেটা নেয়া হয় না’।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রায় তিন বছর হলো কাজ করছেন একজন নারী। তার অফিসে কথা বলার পরিবেশ না থাকায়, আমরা একটা রেস্টুরেন্টে বসে কথা বললাম। মেয়েটির চোখে-মুখে ইতোমধ্যে হতাশার ছাপ স্পষ্ট। কারণ তার অফিসে বেতন এবং পদোন্নতির ক্ষেত্রে তিনি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বলে মনে করছেন। মেয়েটি জানান, ‘আমি আড়াই বছর সাংবাদিকতা করে যখন নতুন একটা প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করলাম আমার বেতন তখন সাড়ে ১৩ হাজার টাকা, কিন্তু একটা ছেলে যার পড়াশোনা শেষ হয়নি, একেবারেই অনভিজ্ঞ, সে একই সময়ে ঢুকলো, তার বেতন হলো ১৬ হাজার টাকা’। তিনি এর পেছনে দু’টি কারণ রয়েছে বলে মনে করেন।
তিনি বলেন, ‘এখানে আমার মনে হয়েছে আমি মেয়ে বলে আমাকে কম বেতন দেয়া হয়েছে। নতুবা ঐ ছেলেটার লবিং আছে যেটা আমার নেই। আমি যখন চ্যালেঞ্জিং কাজ করতে চাই এবং কর্মকর্তাদের বলি তখন তারা বলে এটা তুমি পারবে না, তারা ছেলে কলিগদের দিয়ে করায়, বছর শেষে পদোন্নতি তারা পেয়ে যায়’। খবর বিবিসি বাংলার
‘নারী, ব্যবসা ও আইন ২০১৯’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনটি তৈরির জন্য বিশ্বব্যাংক গত ১০ বছর ধরে বিশ্বের ১৮৭ টি দেশে পর্যবেক্ষণ চালিয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ২০১২ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত একই স্কোর- ৪৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ অর্থাৎ অবস্থার উন্নতি হয়নি।
এদিকে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার অন্ততঃ ১০ বছর ধরে নারীদের উন্নয়নের বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। তাহলে কেন এই পরিস্থিতি? শিশু ও নারী এই মন্ত্রণালয়টি এখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আওতায় রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী জানান, ‘নারীদের সার্বিক অবস্থানে আগের চেয়ে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। তবে পুরুষের সমান হতে পারেনি’। তিনি বলেন, ‘যেহেতু আমরা মুসলমান অধ্যুষিত রাষ্ট্র এবং সমাজ ব্যবস্থা এক সময় পুরুষশাসিত ছিল। সেখানে স্বাভাবিকভাবে নারীদের পশ্চাৎপদ করে রেখে দেয়া হয়েছিল আমাদের সামাজিক অবস্থানের কারণে। সেখান থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীদের টেনে নিয়ে এসেছেন। আপনি দেখেন ৩৩% বেসরকারি চাকরি নারীদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে নারীদের অর্থনৈতিক দিক দিয়ে স্বাবলম্বী করার কাজ করা হচ্ছে’।
কিন্তু তারপরেও সার্বিক যে স্কোর সেটা ৫০ হতে পারতো, সেটা কেন হয়নি? এমন প্রশ্নের জবাবে ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, এই স্কোর তারা কিভাবে করেছেন সেটা তাদের বিষয়। কিন্তু বাস্তবভিত্তিক যদি আমরা দেখি তাহলে এই স্কোর আরো অনেক বেশি হওয়া উচিত ছিল। নারীকে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন না; নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে নারীদের আজকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের নারীরা সার্বিক দিক থেকে উন্নতি করেছে? পুরুষের সমান বা কাছাকাছি কি হতে পেরেছে?- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘অতীতের তুলনায় আমি বলবো তারা অনেক অগ্রসর হয়েছে। তবে বৈষম্য আছে, পুরুষের সমান হতে পারেনি’।
যদিও বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের যে অবস্থান এসেছে- বাংলাদেশের সরকার বলছে সেটাকে বাস্তবতার নিরিখে করলে আরো ভালো অবস্থান হতো বাংলাদেশের। কিন্তু সেটার চেয়ে বড় কথা হলো, আসলেই নারীদের সার্বিক পরিস্থিতি কতটা পাল্টেছে। আর সেই বৈষম্যের চিত্র কিছুটা হলেও উঠে এসেছে এই নিয়ে বিভিন্ন জনের কথায়।