চাই অন্ধকারে আলোর সন্ধান

102

অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকার পেরিয়ে যেমন আলোর সন্ধান মেলে। তেমনি খুন, নিপীড়ন- নির্যাতনের মধ্যে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এসবের জন্য লাগবে সাহস, সহমর্মিতা, মানবিকতা, আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং দ্রুততম বিচার ব্যবস্থা। বাঙালি জাতির ইতিহাস অনেক গৌরবময় এবং উজ্জ্বল। সেই প্রেরণা নিয়ে আমাদের যাত্রা হবে অপ্রতিরোধ্য।
খুন, ধর্ষণ, নিপীড়ন, নারী ও শিশু নির্যাতনের মত জঘন্যতম অপরাধ প্রবণতা দিনদিন বেড়ে চলেছে। অভিনব কায়দায়, ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে তা সংগঠিত হচ্ছে। আগে মানুষ খুন হয়েছে রাতের অন্ধকারে, আড়ালে-আবডালে। এখন খুন হচ্ছে প্রকাশ্য দিবালোকে। আমরা দেখতে দেখতে অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। একটি ঘটনা অন্য একটি ঘটনার জন্ম দিচ্ছে, আমাদের দুর্বলতার কারণে। সারাদেশজুড়ে চলছে, এই তান্ডব ও ভয়াবহতা। খুনের যে মহোৎসব চলছে, তাতে আতঙ্কিত না হয়ে পারিনা। সভ্য সমাজে যেন এক অসভ্যতার কালো ছায়া। এই ধরণের বর্বরতা আমার এবং আমার পরিবারের উপর ঘটলেও সয়ে যেতে হবে। আমরা খুনি ও ধর্ষকদের ঘৃণাভাবে দেখলেও অনেকে যথার্থ বলে দাবী করছে। তাদেরও পরিবার আছে, আছে ভিন্ন এক জগৎ, পাচ্ছে পৃষ্ঠপোষকতা এবং মামলা পরিচালনার জন্য তাদের পক্ষে আইনজীবী। কাজেই এই সমাজ তাদের আলাদা ভাবতে পারছে না। এই বছর শিশুর প্রতি নির্যাতন হয়েছে সবচেয়ে বেশী। প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, আজ পর্যন্ত ৮৯৫ টি শিশু বিভিন্নভাবে নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছে। তন্মধ্যে ২০৩টি শিশু খুন হয়েছে এবং ধর্ষণ হয়েছে ৭৩১টি। আমাদের প্রচলিত সংলাপ জঙ্গি, খুনি ও সন্ত্রাসীদের কোন দল নেই এবং তারা দেশের শত্রু। প্রকৃতপক্ষে তা আমাদের আবেগের কথা। সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া সবচেয়ে আলোচিত দু’টি ঘটনার দিকে তাকালে বাস্তবচিত্র আমাদের কাছে ফুটে ওঠে। নুসরাত জাহান রাফির বর্বরোচিত হত্যার সাথে জড়িত সরকারি দলের নেতা জনাব রুহুল আমীন এবং কাউন্সিলর জনাব মাকসুদ আলম। বর্তমানে তারা কারাগারে আছেন। পাশাপাশি রিফাত হত্যার মদদদাতা হিসেবে বরগুনা জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং অত্র এলাকার এমপি’র কথা সংবাদ মাধ্যমে তথ্য মেলে। সন্ত্রাসীরা কোন ঘটনা ঘটায়না, সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে ঘটনা ঘটানো হয়ে থাকে। এককথায় তারা দলের ছত্রছায়ায় থাকে। যারা অপরাধ করে, তাদের ভবিষ্যত পরিণতি কি হবে, তা তারা একবারও চিন্তা করে না। যেহেতু তাদের পিছনে বড় ভাই এবং পৃষ্ঠপোষকতা থাকে। বেশিরভাগ খুনের সাথে ভোগবাদিতা জড়িত। বলতে গেলে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ভোগবাদিতা চরম আকার ধারণ করেছে। নুসরাত এবং রিফাতের কথা নাই বা বললাম। পুরান ঢাকার ওয়ারী বনগ্রামে সাত বছরের শিশু সামিয়া আফরিন সায়মাও নরপশুর শিকার হয়ে মৃত্যুবরন করতে হয়েছে। নার্স খাদিজাও রেহায় পায়নি, পরিণতি হয়েছে মৃত্যু। নোয়াখালীর কবিরহাট এলাকার এক গৃহবধূ ধর্ষণের শিকার। চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ইপিজেড জুতার কারখানার কর্মী এক কিশোরীও ধর্ষণের শিকার। নারায়নগঞ্জের বিউটি আক্তার নামে এক ইউপি সদস্যকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় অবসরপ্রাপ্ত এক সেনা সদস্য এবং ৯৫ বছর বয়সী বৃদ্ধা মাকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। সম্প্রতি রিকশা-ভ্যান চালক শাহিনও তাদের হাত থেকে রেহাই পাইনি। তার রিকশাভ্যানটি ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। রেখে গেছে তাকে রক্তাক্ত করে। খুনের মহোৎসবে মসজিদের ইমাম ও খাদেম রেহাই পাচ্ছে না। শত শত খুনের ঘটনা কাগজের এই ছোট্ট পরিসরে বর্ণনা করা সম্ভব নয়।
পাশাপাশি স্কুল, কলেজ এবং মাদ্রাসার কতেক শিক্ষক ভোগবাদিতার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কলঙ্কিত করে চলেছেন। তাদের মধ্যে রাফি হত্যার মুল আসামি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এম. সিরাজদ্দৌল্লা। সিদ্ধিরগঞ্জ অক্সফোর্ড স্কুলের শিক্ষক আরিফুল ইসলাম ২০ জন শিক্ষার্থীকে যৌন-নিপীড়নের কথা স্বীকার করেছেন । ফতুল্লায় বায়তুলহুদা মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক মাওলানা আল-আমিন ১২ জন শিশু শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। বর্তমানে উভয়েই কারাবন্দী আছেন। সম্প্রতি পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার হাদিউল উম্মা মহিলা মাদ্রাসার শিক্ষক মোহাম্মদ ফরাজী ১১ বছরের শিশু ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত হয়েছেন।
আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতি ও সমাজের অবক্ষয়ে বিস্মিত, উচ্চ আদালত। বলতে গেলে দেশে আইন আছে, শাসন নেই। বাগেরহাটের নিমাই কৃষ্ণ সেনের মতে- রাষ্ট্রের মানুষ শান্তি চায়, স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চায়, অত্যাচারীর বিচার চায়, সন্ত্রাসীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায় এবং মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে চায়। মানুষের নিরাপত্তা সবার আগে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র, গনপরিবহন এবং এমনকি নিজ এলাকায়ও নারীরা নিরাপত্তাবোধ করেন না। মানুষদের অনিরাপদ অবস্থায় দেশের উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও অর্জন সবকিছু মুখথুবড়ে পড়বে। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এবং বিচারহীনতার কারণে আজ অপরাধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সেক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। ফলে দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে, অপরাধীরা দেশকে কলঙ্কিত করছে বহিবিশ্বের কাছে। বিচারহীনতা অপরাধী সৃষ্টি করতে ভূমিকা রাখছে। অপরাধের ভয়াবহতায় প্রশাসনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। বিশ্বজিৎ হত্যার অভিযুক্তদের সর্বোচ্চ সাজা হওয়া সত্তে¡ও ছাড়া পেয়ে যায়, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে।
শুধুমাত্র আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উপর নির্ভরশীল হয়ে বসে থাকলে চলবে না। নিজ নিজ অবস্থান থেকে আমাদের সাড়া দিতে হবে। বিশেষ করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে যথাসাধ্য সহযোগিতা করতে হবে। “ অপরাধের বিচার হবে, পার পেয়ে যাবে না” এই নিশ্চয়তাটুকু দিতে হবে বিচার ব্যবস্থাপনা তথা সরকারকে। সমস্যা আমাদের, সমস্যা দেশের। কাজেই সরকারি দল এবং বিরোধী দল আলাদা করে ভাবার অবকাশ নেই। দেশ স্বাধীন হয়েছে, চার যুগ পার হতে চলে। সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে না। আমরা কেউ এর দায় এড়াতে পারিনা, সরকারও না। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। তবে উন্নয়ণের পাশাপাশি সমাজে তথা রাষ্ট্রে সু-শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রতিটি এলাকায় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সামাজিক অপরাধ প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা জরুরি। প্রশাসন , থানা এবং প্রতিরোধ কমিটি একযোগে কাজ করলে দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হতে বাধ্য। পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থা শুন্যের কোটায়। তাই ক্ষতিগ্রস্তরা এবং নির্যাতিতরা থানায় যেতে ভয় পায়। সর্ব প্রথমে থানাকে দুর্নীতিমুক্ত করা এবং জবাবদিহিতা প্রয়োজন। থানা যদি শুধু ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের মত লোকদের কথায় চলে, তাহলে পুরো সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়বে। স্থানীয় প্রশাসন যদি আন্তরিক হন এবং তৎপর থাকেন, তাহলে অপরাধের মাত্রা কমিয়ে আসবে নিঃসন্দেহে। এক্ষেত্রে প্রশাসন রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হতে হবে। জনসাধারণের মধ্যে অপরাধ বিষয়ে বিভক্তি, কোন অবস্থাতেই কাম্য নয়। বর্বরতার মূল উৎপাটনে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা প্রশাসনকে।
*প্রতিটি এলাকায় সামাজিক অপরাধ প্রতিরোধ কমিটি গঠনের ব্যাপারে ঐক্যমত্য ও সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।* স্বাভাবিক শিক্ষার পাশাপাশি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নৈতিক শিক্ষার প্রচলনের গুরুত্ব অত্যধিক।* বিচার কাজ দ্রুত সম্পন্ন হওয়ার ক্ষেত্রে প্রশাসনের সার্বিক সহযোগিতা প্রয়োজন। *সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা এবং অপরাধীদের ছাড় না দেওয়ার ব্যপারে সরকারের সদিচ্ছার প্রতিফলন জনগণ আশা করে। *দ্রুত বিচার আদালতের বিচক্ষণতায় সাম্প্রতিক বহুল আলোচিত ঘটনাবলীর ঐতিহাসিক রায় জাতি দেখতে চায়।
লেখক : প্রাবন্ধিক