চলার শক্তি নেই, তবুও অসহায়দের সহায় তিনি

135

যশ-খ্যাতি, সম্মান, অর্থবিত্ত-সবই আছে তাঁর। ৮ সন্তানের সবাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে ঋদ্ধ, প্রতিষ্ঠিত। স্বমহিমায় উজ্জ্বল। বড় ছেলে বাংলাদেশ সরকারের তথ্যমন্ত্রী। উচ্চশিক্ষিত মেজো ছেলে বিশাল মৎস্যখামারি, স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। তৃতীয় ছেলে শিপিং ব্যবসায়ী। ৪র্থ ছেলে বেলজিয়ামে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর সেখানেই বসতি। কনিষ্ঠ ছেলে আন্তর্জাতিক পর্যটন ব্যবসায়ী। তিন কন্যার একজন চিকিৎসক, অপরজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। একেবারে শেষেরজন স্বামীর কর্মস্থলের সুবাদে থাকেন যুক্তরাজ্যে। রতœাগর্ভা বলতে যা বোঝায়, সত্যিকার অর্থে তিনি তাই-ই।
ঘরে বসে আয়েশি কিংবা ঘুরে বেড়িয়ে বিলাসী জীবন-যাপনের অবারিত দ্বার তাঁর সামনে। কিন্তু বৈষয়িক, জাগতিক এসব প্রাপ্তি, ভালো থাকা তাঁর খুব বেশি পছন্দ নয়। গরিব-দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ানো, তাদেরকে আইনী সহায়তাপ্রদান কিংবা মানবতা লংঘনের জায়গায় প্রতিবাদি ঝান্ডা হাতে লড়াই করার রক্ত যার শরীরে, দীক্ষা-শিক্ষা যে জীবনে; সে জীবনের কাছে লাভ-অলাভ, বিলাসব্যসন সবই তুচ্ছ, নস্যি।
তাইতো প্যারালাইসিসের মতো রোগও তাকে কাবু করতে পারেনি। ৫ বছর আগেই হারিয়েছেন চলার মতো শক্তি। হাঁটেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। কথা বলতে গেলে জড়িয়ে যায়। কিন্তু এসব কিছুই এক মুহূর্তের জন্য তাঁকে দমাতে পারেনি। ঝড়-তুফান, বৃষ্টিবাদল যাই আসুক- প্রতিদিন তিনি নির্দিষ্ট সময়ে ছুটে যান আদালতে নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের সুখ-দুঃখের গল্প শোনেন চেম্বারে বসে। জুনিয়রদের ইন্সট্রাকশন দিয়ে সাধ্যমত সমস্যাসঙ্কুল মানুষদের উদ্ধারের চেষ্টা করেন। কখনো কখনো বিচারকের কক্ষে নিজেই ছোটেন গাউন পরে।
বলছিলাম চট্টগ্রাম আদালত ভবনের প্রবীণ আইনজীবী কামরুন নাহার বেগমের কথা। তাঁর প্রয়াত স্বামী অ্যাডভোকেট নুরুচ্ছফা তালুকদারও ছিলেন এই অঞ্চলের খ্যাতিমান আইনজীবী, আইন অঙ্গনের পুরোধা পুরুষ।
আদালত ভবনের চেম্বারে বসে একুশে পত্রিকার কথা হয় অ্যাডভোকেট কামরুন নাহার বেগমের।
অশীতিপর, ভগ্ন শরীরে এখনো কেন, কীসের টানে আদালতে আসেন- এ প্রশ্নে অ্যাডভোকেট কামরুন নাহার বলেন, আমি প্রশান্তি ও আত্মতৃপ্তি খুঁজে ফিরি আর্তপীড়িতের সেবায়, নারীর ক্ষমতায়নে।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারপারসন কামরুন নাহার বেগম বলেন, ‘আইনপেশায় টাকা আয় করা আমার কাছে মুখ্য বিষয় নয়। নির্যাতিত নারীরা যাতে সুখ পায়, সেজন্য আমি নিজের উদ্যোগে আইনপেশায় এসেছি, এখনো আদালতেই আমার সময় কাটে। আদালত সাময়িক জিম্মায় রাখতে দিলে আমি নির্যাতিত নারীদেরকে বাসায় এনে রাখি। নির্যাতিত মেয়েরা যাতে আইনী সহায়তা পায় সেজন্য আমি মানবাধিকার সংগঠনের সাথেও যুক্ত হয়েছি।’
তিনি বলেন, আমার স্বামী ভালো আইনজীবী ছিলেন। আইনি সহায়তা পেতে ওনার চেম্বারে অনেক নারীও আসতেন। তাদের অবর্ণনীয় কষ্ট দেখে ভাবতাম, আইনজীবী হলে আমিও নিপীড়িত মেয়েদের পাশে দাঁড়াতে পারতাম। গরীব মানুষকে সাহায্য করতে পারতাম। পরে আইনজীবী হয়েছি, এখন তা করছিও।’
চট্টগ্রামে আইনজীবী ভবনের নিজের চেম্বারে বসে এভাবেই আইনজীবী হয়ে উঠার গল্প শোনান উচ্চ আদালত ও চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির তালিকাভুক্ত আইনজীবী কামরুন নাহার বেগম। বর্তমানে আওয়ামী লীগের রাজনীতির পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন তিনি।
এসব পরিচয়ের বাইরে মানবাধিকার সংগঠক হিসেবেও সুনাম কুড়িয়েছেন চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও দু’বারের পিপি প্রয়াত নুরুচ্ছফা তালুকদারের স্ত্রী কামরুন নাহার বেগম। এসবের বাইরে এই নারীর আরেকটি বড় পরিচয়- তিনি বাংলাদেশ সরকারের তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের মা।
একাত্তরের দিনগুলোতে অন্ধকারে নিপতিত হয়েছিলেন কামরুন নাহার বেগম ও তার পরিবার। হানাদারদের আক্রমণের কারণে সুন্দর স্বাভাবিক জীবন তো হারিয়েই গিয়েছিল। তবে দেশ স্বাধীনের পর নতুন জীবনের সন্ধান পেয়েছেন তিনি। কামরুন নাহার বেগম একাত্তরের যুদ্ধদিনের বর্ণনা দেন এভাবে, ‘১৯৭১ সালের জুলাই মাসে রাঙ্গুনিয়ার সুখবিলাস এলাকায় আমার শ্বশুর বাড়িসহ আশপাশের শতাধিক বাড়ি পুড়ে ছাই বানিয়ে দেয় হানাদারবাহিনী। আমাদের ধানের গোলায় আর ধান ছিল না। সব আগুনে ধুলিস্যাৎ করে দেয়। আমাদের অপরাধ ছিল, আমরা কেন মুক্তিযোদ্ধাদের খাবারের আয়োজন করতাম, কেন শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছিলাম।’
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কামরুন নাহার বেগম স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘যুদ্ধের সময় আমরা বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের জায়গা দিয়েছি। দুই-চারজন মুক্তিযোদ্ধা আসলে বাড়িতে রাখতাম। আবার দু’দিন পর আরো ৮-১০ জন আসলে তাদেরও খাওয়াতাম। সমস্যা হতো না। আমার ছোট ভাইও মুক্তিযোদ্ধা ছিল। আমাদের বাড়ির অদূরে খুরুশিয়া পাহাড়ে মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ নিতো। যুদ্ধের প্রথমদিকে সুখবিলাস স্কুলে লঙ্গরখানা খুলেছি। সেখানে বড় বড় ডেকচি দিয়ে রান্না করতে হতো। কোনো কোনো সময় ৫০ জনের জন্যও রান্না করতাম।’
মুক্তিযুদ্ধের আগুনঝরা দিনগুলোর সাক্ষী কামরুন নাহার বেগম বলেন, ‘পাকিস্তানি সেনারা বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়ার পর পালিয়ে পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম আমরা। হাছান (বর্তমান তথ্যমন্ত্রী) ও এরশাদকে (মেজো ছেলে) নিয়ে পাহাড়ে থাকতে হয়েছিল আমাদের। আমার স্বামী তখন কোনদিকে থাকতো জানতাম না। তিনি একাত্তরে যুদ্ধ করেছেন অস্ত্র হাতে। বন্দুক নিয়ে আমাদেরকে পাহাড়ে দেখতে যেতেন। হাছান, এরশাদ আমার সাথে ছিল।’
‘যেদিন পাহাড়ে আশ্রয় নিলাম সেদিনই আমার মেয়ের জন্ম হয়, সে এখন ডাক্তার। তেমন কাপড় ছিল না, কাঁথা ছিল না। আর্থিকভাবে গরীব মানুষ যেমন, তার চেয়েও খারাপ অবস্থা। থামি কাপড় খুঁজে পড়তে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এমন অবস্থার মধ্যে দিয়ে আমরা দিন পার করেছি।’ যোগ করেন তিনি।
চট্টগ্রামের পটিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করার পর মহসিন কলেজ থেকে এইচএসসি উত্তীর্ণ হন কামরুন নাহার বেগম। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ১৯৮০ সালে বি.এড কলেজে ভর্তি হন কামরুন নাহার বেগম। ১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত পদুয়া ডিগ্রি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে শিক্ষকতা করেন। চট্টগ্রাম আইন কলেজ থেকে এলএলবি ডিগ্রি নেন ১৯৮৭ সালে। ১৯৮৮ সালে চট্টগ্রাম বারে আইন পেশায় যোগ দেন তিনি।
দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের রাজনৈতিক জীবনে বারবার অপশক্তি ও স্বাধীনতা বিরোধীদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তাঁর সন্তান তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। এমনকি কয়েকবার তার প্রাণনাশেরও চেষ্টা চালিয়েছিল মৌলবাদি গোষ্ঠি ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা। এসব বিষয় তুলে ধরে তাঁর মা বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রাস্তার পাশে একবার হাছানকে মেরে কাপড় ছিঁড়ে ফেলেছে শিবিরের সন্ত্রাসীরা। বাসায় এসে সে বলেছে, কিছু হয়নি। হোঁচট খেয়ে ছিঁড়ে গেছে। পরদিন সকালে পত্রিকায় দেখলাম, হাছানকে আহত করেছে। রড দিয়ে মেরেছে শিবিরের ছেলেরা। তারপর বুঝতে পারলাম, আমাদেরকে সঠিক কথা বলেনি, আমরা চিন্তা করবো এজন্য।’
হাছান মাহমুদের বেড়ে ওঠার দিনগুলোর কথাও জানান মা কামরুন নাহার বেগম; বলেন, ‘স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বিতর্ক দলের দলনেতা হিসেবে দায়িত্বপালন করেছিল হাছান। স্কুলে পড়ার সময় সে বয় স্কাউটের দলনেতা এবং জুনিয়র রেডক্রস দলেরও সদস্য ছিল।’
স্মৃতিচারণ করে তিনি আরো বলেন, ‘হাছান ফুল পছন্দ করতো। খাওয়া নিয়ে তার কোনো সমস্যা ছিল না। যেটা দিতাম সেটাই খেয়ে নিতো। শাসন করতে হয়নি। ছেলে হিসেবে হাছান আমাদের কোনো কষ্ট দেয়নি। ছোটবেলা থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো সে। রোজা রাখতো। এখনো ভোরে ঘুম থেকে উঠে সবার আগে নামাজটাই সেরে ফেলে।’
হাছান মাহমুদকে কী বানাতে চেয়েছিলেন প্রশ্নে কামরুন নাহার বেগম বলেন, ‘আমার ইচ্ছে ছিল ইঞ্জিনিয়ার বানাবো। তার বাবার ইচ্ছা- আইনজীবী বানানো। পরবর্তীতে নিজের প্রচেষ্টায় রাজনীতিবিদ হয়েছে হাছান। সে বলতো, রাজনীতির মাধ্যমে মানুষকে, দেশকে যেভাবে সেবা দেয়া যায়, অন্য কোনো পেশায় এভাবে সেবা দেয়া যায় না।’
স্বামীর স্মৃতিচারণ করে কামরুন নাহার বেগম বলেন, ৮০ বছর বয়সে তিনি মারা যান, মৃত্যুর আগমুহূর্তেও আদালতে গিয়েছিলেন। নামকরা আইনজীবী ছিলেন। বিপদে-আপদে সবাই এসে ধরতেন ওনাকে, আদালতে না গিয়ে পারতেনই না।
দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন অ্যাডভোকেট কামরুন নাহার বেগম। রাউজানে পুলিশ হেফাজতে সীমা চৌধুরী ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী হিসেবে অপরাধ প্রমাণে ভূমিকা রাখেন সাবেক বিভাগীয় বিশেষ পিপি কামরুন নাহার বেগম।
প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হওয়ার কারণে শরীরের একপাশ প্রায় অচল হয়ে পড়েছে ৩১ বছর ধরে আইনপেশায় নিয়োজিত কামরুন নাহার বেগমের। এরপরও কর্মব্যস্ততায় দিন কাটে তাঁর। তিনি বলেন, প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ি। নামাজ না পড়ে আমি কোনোদিন নাস্তা খাই না। এরপর আদালতে চলে আসি।
‘যে দিন আদালত বন্ধ থাকে, সে সময় আমি লেখালেখি করি। সব সময় কাজের মধ্যে থাকি, বসে থাকি না। হত্যা, অস্ত্র ও চোরাচালানের মতো গুরুতর অপরাধের ১৭০টি মামলায় এখন রাষ্ট্রপক্ষের হয়ে লড়াই করছি আমি। কিছুদিন আগে সোনা চোরাচালান আইনের একটি মামলায় আসামির ২৯ বছর সাজা হয়েছে আমার চেষ্টায়।’
আলাপচারিতার শেষ পর্যায়ে এসে চমক দেন কামরুন নাহার বেগম। তিনি বলেন, ‘আমি বেলজিয়াম, ফ্রান্স, জার্মাানি, লন্ডন, ইটালি, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ড ও সুইজারল্যান্ডসহ অন্তত ১৪টি দেশ ভ্রমণ করেছি। জেনে খুশি হবেন, আমি একটা বই বের করতে যাচ্ছি, ভ্রমণকাহিনী নিয়ে। কোথায় গেলাম, কী দেখলাম এসব সেখানে থাকবে। কিছুদিনের মধ্যেই বইটি প্রকাশিত হতে যাচ্ছে।