চমেক হাসপাতালে ‘বেহালদশা’

134

বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না করে ‘নানা অপরাধের’ সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে একযোগে সাড়ে ৩শ অবৈতনিক কর্মচারীকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ‘বেহালদশার’ সৃষ্টি হয়েছে। রোগীদের ফেলে দেওয়া চিকিৎসা বর্জ্য ও ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে হাসপাতালের সবকটি ওয়ার্ড। একটি আদেশে অলিখিত ৩৫০ অবৈতনিক কর্মচারী অব্যাহতির কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে এই আদেশের মাধ্যমে ৫০০ এর বেশি কর্মচারী অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ওয়ার্ড সংশ্লিষ্ট লোকজন।
হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে। যথাসময়ে সঠিক চিকিৎসা সেবা না পাওয়ার শঙ্কায়ও ভুগছেন তারা। বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে পেশেন্ট ট্রলি, হুইল চেয়ার, অক্সিজেন মিটার, বালিশ, কম্বল, বেডশীটসহ গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা সরঞ্জাম চুরি হয়ে যাচ্ছে। ওয়ার্ডের পাশে বারান্দায় অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, পানি ও আবর্জনার স্তুপ মাড়িয়ে টয়লেটে যাচ্ছে রোগী ও তাদের স্বজনরা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এমনিতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নির্দিষ্ট সিটের বাইরে তিনগুণ রোগী ভর্তি থাকে। আগে থেকেই রয়েছে পর্যাপ্ত জনবলের সংকট। সেবা নিতে আসা প্রায় তিন হাজার রোগীদের যথাসময়ে চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। এসব সংকটের মধ্যে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা ঠিক না করেই একসাথে সাড়ে তিনশ কর্মচারীকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিলে হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থার অবনতি হবেই। হাসপাতালের মত গুরুত্বপূর্ণ সেবা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যেকোন ধরনের পরিবর্তনের আগে বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি করে রাখতে হবে। যাতে করে চিকিৎসা সেবায় কোন ধরণের ব্যাঘাত না ঘটে। এইক্ষেত্রে সমাধান হলো অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে হাসপাতালে সেবা নিতে আসা রোগীদের অনুপাতে অভিজ্ঞ লোকজন নিয়োগের মাধ্যমে চিকিৎসা ব্যবস্থার স্বাভাবিক পরিবেশ তৈরি করা।
কিন্তু এসব বিবেচনা না করেই একদিনেই সাড়ে ৩শ অবৈতনিক কর্মচারীকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। উদ্ভুত সংকট নিরসনে নতুন করে কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এ সুযোগে কতিপয় কর্মচারীর সিন্ডিকেট নিয়োগ বাণিজ্যের সাথে জড়িয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এদের মূলহোতা হলো হাসপাতালে দুয়েকজন ওয়ার্ড মাস্টার। এদের সাথে হাসপাতাল প্রশাসনের সম্পর্ক নিবিড়। ইতোমধ্যে সাড়ে ৩৫০ জন কর্মচারীকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার পর নতুন করে ১০৯ জন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যাদের অধিকাংশই অনভিজ্ঞ বলে জানা গেছে। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে নিয়োগ পেয়েছেন বলেও জানিয়েছেন নিয়োগ পাওয়া কয়েকজন। হাসপাতালের বর্তমান সংকট নিরসনে শীঘ্রই আরো নতুন করে লোক নেওয়ার চেষ্টা চলছে। এজন্যে সিন্ডিকেট চক্রটি পুরাতনদের কাছ থেকেও মোটা অংকের টাকা দাবি করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
পরিচালকের সামনে এক সিনিয়র চিকিৎসকের সাথে দেখা হলে কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখানকার সরকারী নিয়োগপ্রাপ্ত লোকজন কাজ না বাইরে ঘুরে বেড়ায়। আর তারা অবৈতনিক লোকজনকে দিয়ে কাজ করায়। এসব লোকজনকে নিয়ন্ত্রণ করে সরকারি কর্মচারীর একটি সিন্ডিকেট চক্র। চক্রটি অবৈতনিক কর্মচারীদের মাধ্যমে রোগীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে। কিছু টাকা তাদেরকে দিয়ে বাকি টাকা চক্রটি হাতিয়ে নেয়।
সরেজমিনে হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, চমেক হাসপাতালে গুরুত্বপূর্ণ ওয়ার্ডগুলোর মধ্যে ১২নং ওয়ার্ডের হৃদরোগ বিভাগ অন্যতম। এই ওয়ার্ডটি তিনটি মেডিসিন ওয়ার্ডের সমান বলা যায়। এ ওয়ার্ডে ২০০টি বেডের বিপরীতে প্রতিদিন রোগী ভর্তি থাকে ২৫০ থেকে ৩০০ জন। এসকল রোগীকে প্রতিনিয়ত চিকিৎসা সেবা দিতে ৩ শিফটে জনবল লাগবে ৪০ জন। কিন্তু ৩৫০জন কর্মচারীকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সময় গুরুত্বপূর্ণ এ ওয়ার্ড থেকে ১৫ জনকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে এ ওয়ার্ডে জনবল রয়েছে ১৫ জন।
এখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, চাহিদা অনুপাতে জনবল সংকট রয়েছে। হঠাৎ করে অভিজ্ঞ লোকজনের অনুপস্থিতিতে রোগীদের সেবা দিতে সমস্যা হচ্ছে। ওয়ার্ডে আয়া ও মাসি সংকটের কারণে বাথরুম, রোগীদের মলমূত্র ও বমি পরিস্কার করতে সমস্যা হচ্ছে। এতো বড় ওয়ার্ড পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে গিয়েও প্রতিনিয়ত সমস্যা হচ্ছে।
১৬ নং ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে আরো ভয়াবহ অবস্থা। যেখানে সেখানে ময়লার স্তুপ। ভিতরে বাইরে রোগী ও স্বজনদের ঠাসা। কোথাও পা রাখার জায়গা নেই। বারান্দায় পানি চলচল করছে। সেই পানি মাড়িয়ে রোগী ও তাদেররা স্বজনরা টয়লেটে যাচ্ছেন। এসব পানি বারান্দায় থাকা রোগীদের বেডে নিচেও জমে রয়েছে। লোকবলেও অভাবে এসব পরিষ্কার করা সম্ভব হচ্ছেনা বলে জানিয়েছেন ওয়ার্ড সংশ্লিষ্ট লোকজন।
এছাড়া এ ওয়ার্ডে প্রতিদিন ২৫০ জনের বেশি রোগী ভর্তি থাকেন। এ ওয়ার্ড থেকে ২০ জনকে বাদ দিয়ে নতুন করে ৬ জন নিয়োগ দেওয়া হয়। এরমধ্যে একজন আয়া, তিনজন ওয়ার্ডবয় এবং দুইজন পরিচ্ছন্ন কর্মী রয়েছে।
দায়িত্বরত লোকজন বলেন, অনভিজ্ঞ লোকজন নিয়োগের কারণে অনকলে এক ওয়ার্ড থেকে অন্য ওয়ার্ডে রোগীদের সঠিক সময়ে নিতে সমস্যা হচ্ছে। এ কারণে অনেক সময় রোগীর অবস্থা খারাপের দিকে ধাবিত হয়। পর্যাপ্ত পরিচ্ছন্ন কর্মী ও আয়া না থাকার কারণে ওয়ার্ডের টয়লেটের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছে। সঠিক সময়ে ময়লা সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে না। বিশেষ করে এ ওয়ার্ডে সেবা নিতে আসা বিষ খাওয়া রোগী, সাপে কাটা রোগীদের অতিদ্রæত সময়ে চিকিৎসা সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছেনা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওয়ার্ড সংশ্লিষ্ট একজন জানান, হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট কর্মচারী অভাবে পেশেন্ট ট্রলি, হুইল চেয়ার, অক্সিজেন মিটার, বালিশ, কম্বল, বেডশীটসহ গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র চুরি হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। শুধু তাই নয়, হাসপাতালের ১৩, ১৪ এবং ১৫ নং ওয়ার্ড, ২৬ নং ওয়ার্ড, গাইনী ওয়ার্ড, জরুরি বিভাগ, সিসিইউসহ প্রায় সকল ওয়ার্ডের পর্যাপ্ত লোকবল না থাকায় রোগীদের সঠিক সময়ে সেবা প্রদান ব্যাহত হচ্ছে।

যা বললেন
পরিচালক

চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহসেন উদ্দিন আহমদ বলেন, হাসপাতালে রোগীদের সেবার অজুহাতে বিভিন্ন সময় নানা অপরাধে যাদেরকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, তারা তাদের বৈধতা নেওয়ার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনের কাছে যে সকল অভিযোগগুলো করছে তা সঠিক নয়। কতিপয় লোকজনের কারণে হাসপাতাপলের সুনাম নষ্ট হোক, তা আমরা কেউ চাই না। হয়ত এতগুলো জনবল একসাথে অব্যাহতি দেওয়ার কারণে হাসপাতালের কার্যক্রম চালাতে কিছুটা কষ্ট হবে। তবে এই মুহুর্ত পর্যন্ত কোন ধরনের সমস্যা হচ্ছে না।
ইতোমধ্যে জনবলের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অভিজ্ঞ লোকবল নেওয়ার চেষ্টা চলমান রয়েছে।
ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ময়লার স্তূপ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একজন রোগীর সাথে ৪ থেকে ৫ জন রোগীর স্বজন আসেন। যেখানে ইচ্ছা সেখানে ময়লা ফেলছেন তারা। সচেতনতার কার্যক্রম অব্যাহত আছে। তবে কেউ কর্ণপাত করছে না। আর আমাদের একার পক্ষে এতো বড় হাসপাতাল পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন রাখা সম্ভব না। সেবা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনদেরকেও সচেতন হতে হবে।
গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা সরঞ্জাম চুরির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ সংক্রান্ত কোন অভিযোগ আমার কাছে আসে নাই। অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কিছু ওয়ার্ডের খারাপ পরিস্থিতি বিরাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, এসব ওয়ার্ডে রোগীদের প্রচন্ড চাপ রয়েছে। রোগীদের অসচেতনতার কারণেই এ সমস্যাটা হচ্ছে। পরিষ্কার করার কিছুক্ষণের মধ্যে আবারও একই অবস্থায় পরিণত হয়। হাসপাতালে সেবা নিতে গেলে রোগীদেরকে পরিমিত পয়সা খরচ করার কথাও জানান তিনি।
এছাড়া আমরা ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সের কর্মচারীদের হাসপাতালে নিয়োগ করবো। আর আমাদের যে সকল কর্মচারী রয়েছে, তাদের অধিকাংশই ৪০ বছর পেরিয়ে গেছে। এমনকি তারা অনেকেই নিজেই রোগী হয়েছে। তাহলে কেমনে তারা রোগীদেরকে সেবা প্রদান করবে। তাই হাসপাতালের শতভাগ সেবা নিশ্চিত করতে পর্যায়ক্রমে আমরা সব ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করবো।