চন্দ্রাভিযানে অ্যামেরিকার অংশীদার যাঁরা

33

চাঁদে মানুষ পাঠানোর মিশন অ্যামেরিকার হলেও অন্য অনেক দেশের সহায়তা ছাড়া এ কাজ সম্ভব হত না। অ্যাপোলো প্রোগ্রামের জন্য বিশ্বব্যাপী বহু ট্র্যাকিং স্টেশন এবং এগুলোর প্রকৌশলীদের উপর নির্ভর করতে হয়েছিল তাদেরকে পঞ্চাশ বছর পর এসেও সেসব ট্র্যাকিং স্টেশনগুলোর প্রকৌশলীদের কাছে চাঁদে পা রাখার স্মৃতি এখনো তাজা। এটাকে বিশ্বের সব মানুষের অর্জন হিসাবে ভাবতে চান তাঁরা।
‘‘গাড়ি চালিয়ে বাড়ি যাওয়ার পথে এক জায়গায় থামি আমি। তখন ছিল গাঢ় অন্ধকার। আমি গাড়ি থেকে নেমে চাঁদের দিকে তাকাই। অনুভূতি ছিল এই রকম, ‘এই মুহূর্তে দুইজন লোক ওখানে দাঁড়িয়ে আছে! আবেগ ছিল অনেক অনেক গভীর।
চাঁদে পা রাখার পাঁচ দশক পূর্তিতে এসে কথাগুলো বলেছেন ল্যারি হেগ, স্পেনের মাদ্রিদে নাসার ‘ফ্রেসনেদিয়াস দে লা অলিভা ট্র্যাকিং স্টেশনে কাজ করতেন তিনি। ওই সময়ে ডাটা সিস্টেম সুপারভাইজার হিসাবে রাতের ডিউটি শেষ করে ফিরছিলেন তিনি। চন্দ্রাভিযানের তথ্য পেতে অ্যামেরিকান স্পেস এজেন্সির মোট তিনটি রেডিও টেলিস্কোস কেন্দ্রের একটি ছিল মাদ্রিদে।
১৯৬১ সালে প্রেসিডেন্ট কেনেডি চন্দ্রাভিযানের ঘোষণা যখন দেন, তখন পর্যন্ত মহাকাশেও যায়নি অ্যামেরিকার কেউ। কিন্তু খুব দ্রুতই এগিয়ে যায় চন্দ্রাভিযানের কার্যক্রম।
সে সময়ের স্মৃতিচারণ করে হেগ বলেন, ‘‘আমাদের কিছুই ছিল না। এমনকি মহাকাশে মানুষ পাঠাতে পারিন আমরা। কিন্তু মাত্র আট বছরের মাথায় দু’জন মানুষকে চাঁদে পাঠিয়েছি আমরা। আমরা যা করেছি, সেটা ছিল অবিশ্বাস্য।
অ্যামেরিকার গল্পে অন্যদের ভাগ
অ্যাপোলো স্পেস প্রোগ্রাম অ্যামেরিকানদের গল্প সেটা ঠিক। একইসঙ্গে এটা ছিল স্নায়ুযুদ্ধকালে রাশিয়ার সঙ্গে তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়। কিন্তু অন্যভাবে এটা ছিল বৈশ্বিক গল্পও।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের সহায়তা ছাড়া অ্যামেরিকা কোনোভাবে এটাতে সফল হত না। এমনকি রাশিয়ানরা যদি মহাকাশে প্রথম মানুষ না পাঠাত, তাহলে এটা তাদের চিন্তার বাইরে থাকত।
অ্যামেরিকার রাজনৈতিক ক্ষমতাবৃদ্ধির পেছনের শক্তি হিসাবে কাজ করে এটি। কেবল রাজনৈতিক দিক নয়। কারিগরি দিক থেকে অ্যামেরিকা বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে অভিজ্ঞতা কাজে লাগায়।
এর মধ্যে ছিলেন ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাজ্যের টেকনিশিয়ান এবং প্রকৌশলীরা। যারা অ্যামেরিকানদের পাশাপাশি থেকে স্থানীয় ট্র্যাকিং স্টেশনগুলোতে কাজ করেছেন।
মাদ্রিদের বাইরে অন্য দুটি প্রধান ট্র্যাকিং স্টেশন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মোজাভে মরুভূমি এবং অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরার অদূরে হানিসাকল ক্রিক এলাকায়।
এই তিনটি ট্র্যাকিং স্টেশনের পাশাপাশি নাইজেরিয়ার কানো, প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার গুয়াম, বারমুডা, অ্যান্টিগুয়া, অ্যাসেশন দ্বীপ এবং বিভিন্ন জাহাজের ছোট ছোট কেন্দ্র সংযুক্ত ছিল টেক্সাসের হুস্টনে প্রধান কেন্দ্রের সঙ্গে। এই কেন্দ্রগুলো ২৪ ঘন্টাজুড়ে চাঁদ থেকে ভূমিতে তথ্যের সংযোগ স্থাপন করত।‘‘পৃথিবী থেকে পূর্ব-পশ্চিমে চাঁদের গতিপথ অনুসরণের ১২ থেকে ১৪ ঘন্টা করে সময় লাগত। আপনি আকাশে তাকালে সবসময় চাঁদ দেখবেন না। আমরা যখন দেখতাম, তখন হুস্টনের মানুষ চাঁদ দেখত না, নিজেদের কাজের বর্ণনা দিয়ে বলেছেন হেগ।
নাইল আর্মস্ট্রং ও বাজ অলড্রিন যখন চাঁদে প্রথম পা রাখেন, এক্ষেত্রে প্রাথমিক ট্র্যাকিং সম্পন্ন করেছিল মাদ্রিদের স্টেশন। নভোচারীদের স্বাস্থ্যের ট্র্যাকিংও করেছিল এটি।
হেগ বলেন, চাঁদে পা রাখার পূর্ব মুহূর্তে আর্মস্ট্রংয়ের হার্টবিট ১২০ থেকে ১৩০ পর্যন্ত উঠে গিয়েছিল। ঘটনাচক্রে সেটা টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার হয়ে গিয়েছিল। ‘‘এর জন্য আমাদের তিরস্কৃত হতে হয়েছিল। কারণ এটা ছিল মেডিকেল ড্যাটা, যা প্রকাশ হওয়ার কথা না! স্মৃতি হাতড়ে বলেন তিনি।
হেগ বলেন, ‘‘রাতের কাজ শেষে ট্র্যাকিংয়ের পরবর্তী দায়িত্ব ক্যানবেরার হানিসাকল ক্রিক কেন্দ্রের উপর অর্পণ করেছিলাম। তারা চাঁদে প্রথম পা রাখার সময়টা ট্র্যাক করেছিল।
টেলিভিশনে সরাসরি
নভোচারীরা চাঁদে পা রেখেছে নাকি অ্যামেরিকার কোনো স্টুডিওতে দৃশ্যায়ন করা হয়েছে তাতে কিছু যায় আসে না। আপনি যদি ১৯৬৯ সালে অস্ট্রেলিয়ায় থাকতেন, তাহলে ঠিকই জানতেন ঐতিহাসিক সেই চিত্রগুলো অস্ট্রেলিয়ার হানিসাকল ক্রিক ও পার্কেস রেডিও টেলিস্কোপ কেন্দ্র থেকে।
সে সময় হানিসাকল কেন্দ্রের কম্যুনিকেশন্স বিভাগের কর্মী গিলিয়ান শোয়েবর্ন জানিয়েছেন সেদিনের অভিজ্ঞতার কথা। সহকর্মীদের সঙ্গে দিস্তা পর দিস্তা কাগজে মিশনের নির্দেশনা, টেলিমেট্রি ও মেডিকেল তথ্য পাঠানোর কথা জানান তিনি।
চন্দ্রারোহণে অস্ট্রেলিয়ার হানিসাকল কেন্দ্রের কার্যক্রম নিয়ে একটি ওয়েবসাইট চালান কলিন ম্যাকেলার। তিনি বলেন, ‘‘১৯৬৯ সালে মানুষের চন্দ্রারোহণের গুরুত্ব পৃথিবীর কারো অজানা ছিল না এবং সেটা সরাসরি দেখেছিল তারা। সবাই ছিল উৎফুল্ল।
তাঁদের আক্ষেপ
১৯৬৯ সালে চন্দ্রারোহণের দুবছর পরই হানিসাকল ক্রিক ছেড়ে দিয়েছিলেন শোয়েবর্ন। এরপর পৃথিবী ঘোরা শুরু করেন তিনি এবং যুক্তরাজ্য ও জার্মানিতে এসে তার যাত্রা শেষ হয়।
চাঁদে যাওয়ার পর অ্যাপোলো প্রোগ্রাম বেশিদিন চালু থাকেনি। ১৯৭২ সালে এই কর্মসূচি বন্ধ করে দেয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার। এ নিয়ে আক্ষেপ আছে তখনকার কর্মীদের মধ্যে।
মাদ্রিদে ‘ফ্রেসনেদিয়াস দে লা অলিভা ট্র্যাকিং স্টেশনের কর্মী হেগ বলেন, ‘‘অ্যাপোলো বন্ধ করে দেওয়া ছিল বড় ধরনের ভুল। তবে- পেছনে ফিরে দেখি, আমরা ভিয়েতনাম যুদ্ধ পার করেছি এবং এটা ছিল খুবই খরুচে ব্যাপার। এ কারণে আমাদের এমন পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল।