চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৭তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ঐতিহ্য এবং গৌরবের বিদ্যাপীঠ

13

মোহাম্মদ হোসেন

দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের অন্যতম উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। অনিন্দ্য সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার উত্তরে হাটহাজারী উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নে পাহাড়ি ও সমতল ভূমির উপর এ বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত। বাদশা মিঞা চৌধুরী ও অধ্যাপক আহমদ হোসেন চট্টগ্রামের শিক্ষা ও সংস্কৃতি জগতের অন্যতম দিকপাল। ইতিমধ্যে তাঁরা চট্টগ্রাম অঞ্চলে অনেক স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। চট্টগ্রাম শহরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চালানোর জন্য সর্বজন শ্রদ্ধেয় জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদল্লাহ্ কর্তৃক উৎসাহিত হয়ে বাদশা মিঞা চৌধুরী ও অধ্যাপক আহমদ হোসেন চট্টগ্রামের নেতৃস্থানীয় নাগরিক, শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও ছাত্রদের একটি সভা আহŸান করেন। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের ৭ মে রোববার অনুষ্ঠিত এই ঐতিহাসিক সভায় ড. মুহম্মদ শহীদল্লাহ ঢাকা থেকে এসে যোগদান করেছিলেন বলে জানা যায়। প্রস্তাবিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অবৈতনিক শিক্ষক হিসেবে সহায়তা করার প্রতিশ্রæতিও দেন। এই সভায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংগঠনিক পরিষদ গঠিত হয়। জনাব বাদশা মিঞা চৌধুরী এই পরিষদের সভাপতি এবং অধ্যাপক আহমদ হোসেন আহŸায়ক নিযুক্ত হন। এরপর পরিষদের এক জরুরি সভায় দ্বিতীয় পাঁচশালা পরিকল্পনা অনুযায়ী চট্টগ্রাম কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করার কাজ ত্বরান্বিত করতে প্রেসিডেন্ট, গভর্নর ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার অন্যান্য সদস্যদের কাছে স্মারকলিপি পেশ করার বিষয় অনুমোদিত হয়। স্মারকলিপি পেশ করার পর পাকিস্তানের জেনারেল প্রেসিডেন্ট আইউব অচিরেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হবে বলে আশ্বস্ত করেন। বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আন্দোলনে জনাব বাদশা মিঞা চৌধুরী ও অধ্যাপক আহমদ হোসেনের নিরলস কর্ম প্রচেষ্টা সংশ্লিষ্ট সকল মহলে আশার সঞ্চার করে।এমন সময় কোন একদিন আইউব খান বেড়াতে গেলেন সিলেটে; সঙ্গে তৎকালীন পূর্বপাক প্রদেশের জনপ্রিয় গভর্নর জেনারেল (অব.) আজম খানও। সিলেটের ছাত্ররা ‘সদর’-কে কাছে পেয়ে জেঁকে ধরলো বিশ্ববিদ্যালয় দিতে হবে সিলেটে। জনপ্রিয় সদর আর জনপ্রিয় গভর্নরের জনপ্রিয়তা লাটে ওঠার উপক্রম। কিন্তু যায় কোথায়, গভর্নরের জনপ্রিয়তা কি এমনিতেই বাঙালির রগ চিনেছিলেন এই চতুর পাঠান। পরিস্থিতি সামলে দিতে গাড় থেকে নেমে পড়লেন তিনি। ঘোষণা দিলেন, হজরত শাহ জালালের (রা.) দেশ সিলেটেই প্রদেশের তৃতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হবে। ধন্য ধন্য পড়ে গেল সদর আর গভর্নরের— সিলেটবাসী মহাখুশি ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মুলো ঝুলিয়ে রাজনীতি ওঠলো তুঙ্গে। যে দেশের মানুষ বাড়ির সীমা, জমির আল, খাঁচার মুরগী আর কাটা ঘুড় নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয় তথাকথিত রাজনীতির আলখেল্লা ধারীদের যৎসামান্য উষ্কানিই তাদের জন্য যথেষ্ট। কুমিল্লা স্টেশনে চট্টগ্রামগামী ট্রেন আক্রান্ত হলো। চট্টগ্রামবাসী গেল ন্যায়সঙ্গত প্রতিবাদের পথে। মিছিল আর সভা করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সীতাকুÐ পাহাড়ের মতো রুখে দাঁড়ালো তারা। বাদশা মিঞা আর আহমদ হোসেনরা বুক চিতিয়ে সামনে এগিয়ে গেলেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংগঠনিক পরিষদ ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সংগ্রাম পরিষদ’ নামে পুনর্গঠিত হলো। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর লালদিঘির ময়দানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় চট্টগ্রাম কলেজকে কেন্দ্র করে পূর্বপাক প্রদেশের তৃতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকা সত্তে¡ও এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সরকারের গড়িমসির তীব্র সমালোচনা করা হয় এই সভায়। সংগ্রাম পরিষদের আহŸায়ক অধ্যাপক আহমদ হোসেন আঞ্চলিকতাবাদী ও স্বার্থান্বেষী রাজনীতিবিদদের অপতৎপরতায় অনুমোদিত পরিকল্পনার অহেতুক ও যথেচ্ছ রদবদল দেশের সমূহ অমঙ্গল ডেকে আনবে বলে সরকারকে সতর্ক করে দেন। তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবির সঙ্গে কুমিল্লা ও সিলেটবাসীর দাবির কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না, চট্টগ্রামবাসী শুধু পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বিশিষ্ট ধারার বাস্তবায়ন দাবি করছে।
ষড়যন্ত্রকারীরা ডুব সাঁতার দেওয়া আরম্ভ করলো। এক ঢিলে অনেক পাখি মারতে হবে তাদের এবং দ্বিতীয় পাঁচশালা পরিকল্পনার বিশ্ববিদ্যালয়কে শিকেয় তুলতে হবে। এমন সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে টঙ্গীতে নির্বাসন দেওয়ার ষড়যন্ত্রও শুরু হয়ে গিয়েছিল। কারন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা আইউব-মোনায়েম চক্রকে ঢাকা শহরে সুখে শান্তিতে রাজত্ব করতে দিচ্ছে না। এখন চট্টগ্রাম কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করা হলে ঢাকার মতো চট্টগ্রামও প্রশাসনের অশান্তির কারণ হয়ে উঠবে। এভাবে অনেক বিবেচ্য বিষয় উকিল-গভর্নর আবদুল মোনায়েম খান এবং তাঁর যোগ্য শিক্ষামন্ত্রী মফিজউদ্দীনের মাথায় জট পাকাচ্ছে। তাঁরা এই জট থেকে বেরিয়ে আসার এক ফন্দি আঁটলেন। দ্বিতীয় পাঁচশালা পরিকল্পনা মোতাবেক চট্টগ্রাম কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করার প্রকল্পের নথিটি ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করা হলো। এর বদলে তৃতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কোথায় করা যায় তা নির্ধারণ করার জন্য একটি স্থান নির্বাচন কমিটি গঠন করা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. এম. ও. গণির নেতৃত্বে। চট্টগ্রামবাসী সরকারের এই অন্যায্য সিদ্ধান্তেরও প্রতিবাদ করলো।
সামরিক শাসনের অধীনে তৎকালীন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচন অর্বাচীন মৌলিক গণতন্ত্রের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই নির্বাচনে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম, রাউজান, হাটহাজারী ও রাগুনীয়া নিয়ে একটি বিশাল নির্বাচনী এলাকা গঠিত ছিল। জানা যায় ওই নির্বাচনে এই এলাকার জৈনিক প্রার্থী নির্বাচনী প্রচারভিযানকালে হাটহাজারীতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সকল প্রচেষ্টা নেবেন বলে প্রতিশ্রæতি দেন। সরকার নিযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় স্থান নির্বাচন কমিটিও হাটহাজারীর ফতেহপুর ইউনিয়নের জঙ্গল পশ্চিম পট্টি মৌজার দুর্গম পাহাড় এলাকাকে প্রদেশের তৃতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান হিসেবে বেছে নেয়। চট্টগ্রাম কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করার তথা চট্টগ্রাম শহরে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বাদশা মিঞা- আহমদ হোসেনদের লালিত স্বপ্নও ভোরের শিশিরের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরের উপ-কিউরেটর হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ড.শামসুল হোসাইন অধ্যাপক আহমদ হোসেন স্মৃতি সংসদ কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাদশা মিঞা- আহমদ হোসেনের স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়’ কলামে এবং ‘প্রেরণার উৎস’ শীর্ষক প্রকাশনায় উপরোল্লেখিত তথ্যদির সত্যতা পাওয়া যায়।
১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক খসড়া পরিকল্পনা তৈরী করেন তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের উপ-জনশিক্ষা পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) জনাব মোহাম্মদ ফেরদাউস খান। এ পরিকল্পনার সামগ্রিক মূল্যানুমান ছিল ৬২.৬৭৫ মিলিয়ন টাকা। যথাসময়ে একটি বিস্তারিত পরিকল্পনা প্রণয়ন সাপেক্ষে ফেরদাউস খানের উপরোক্ত খসড়া পরিকল্পনা তৎকালীন পাকিস্তানের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির নীতিগত অনুমোদন লাভ করে ১৯৬৫ সালের জুন মাসের কোন সময়ে অনুষ্ঠিত এক সভায়। এর আগে ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. এম. ও. গণিকে সভাপতি ও ড. মুহাম্মদ শহীদল্লাহ প্রমুখকে সদস্য করে একটি স্থান নির্বাচন কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটিই চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলায় ফতেপুর গ্রামের পাহাড়ী অঞ্চলের পশ্চিম পট্টি মৌজায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করেন। তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান ১৯৬৪ সালের ২৯ আগস্ট সুপারিশকৃত স্থানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এসময় চট্টগ্রামের জনসাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্যে পঁচিশ লক্ষ টাকার একটি তোড়া প্রেসিডেন্টকে উপহার দেয়।
ষাটের দশকের প্রথম ভাগে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় ছিল মাত্র দু’টি ঢাকা এবং রাজশাহীতে। অথচ তুলনামূলক কম জনসংখ্যা নিয়ে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল চারটি এবং পঞ্চমটি চালু হতে যাচ্ছিল ইসলামাবাদে, কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে। ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দে এবং রাজশাহীতে ১৯৫৩-তে। আলোচ্য সময়ে ঢাকার ছাত্র সংখ্যা ছিল পাঁচ হাজার এবং রাজশাহীতে আড়াই হাজার। এ অবস্থায় ঢাকার ছাত্র সংখ্যাকে মনে করা হচ্ছিল অতিমাত্রায় ভিড়াক্রান্ত।
এই সমস্যার সমাধান করে শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং আরো বেশী সংখ্যায় উৎসাহী ও যোগ্য শিক্ষার্থীর জন্যে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে তৎকালীন জাতীয় শিক্ষা কমিশন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে দ্বিতীয় পাঁচশালা পরিকল্পনাকালে আরো একটি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করে। সে সময় চট্টগ্রাম বিভাগের ভৌগোলিক আওতায় দেড় কোটি লোকের জন্যে উচ্চ শিক্ষার কোনো সুযোগ ছিল না। এই সমস্যা সমাধানকল্পে চট্টগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
প্রসঙ্গক্রমে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার প্রাচীন প্রতœ-আবহ সম্পর্ক এখানে কিছুটা আলোকপাত করা যেতে পারে। ধারণা করা হয়, ফতেপুর গ্রামের নামকরণের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে চট্টগ্রামে প্রথম মুসলিম বিজয়ের স্মৃতি। তার পার্শ্ববর্তী জোবরা গ্রামের আলাওল দীঘির উত্তর পাড়ে একটি প্রাচীন মসজিদের ভগ্ন দেয়ালে পাথরে উৎকীর্ণ একখানা শিলালিপি পাঠে বাংলার স্বাধীন সুলতান রুকনুদ্দীন বারবক শাহের আমলের মজলিস আলা রাস্তি খানের নাম পাওয়া যায়। অদূরবর্তী হাটহাজারী বাজারের সংলগ্ন পশ্চিম পার্শ্বে আবিষ্কৃত হয়েছে আরো একখানি সুলতানী মসজিদ ও শিলালিপি। বিশ্ববিদ্যালয় পূর্বের রেজিস্ট্রার অফিস সংলগ্ন পাহাড়ে এক সময় মঘ রাজার বাড়ী ছিল বলে জনশ্রæতি প্রচলিত আছে। এছাড়াও উপচার্যের বাসভবন নির্মাণের জন্যে ভিত খোঁড়ার সময় মাটির অনেক গভীরে পাওয়া যায় ধাতু নির্মিত দু’খানা প্রাচীন থালা। স¤প্রতি শামসুন্নাহার হলের সামনে পাওয়া গেছে একখÐ অশীভূত কাঠ। এসব নিদর্শন ও তথ্য অনুশীলনে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার প্রতœ-আবহ সম্পর্কে ধারণা করা চলে।
১৯৬৫ সালের ৩ ডিসেম্বর প্রফেসর আজিজুর রহমান মল্লিক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পের পরিচালক নিযুক্ত হন। নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটির ৩ নম্বর রাস্তার ‘কাকাসান’ ভবনে প্রকল্প কার্যালয় স্থাপন করা হয়। পরিচালক একই ভবনের দোতলায় থাকতেন। তদানীন্তন পাকিস্তান সরকারের শিক্ষা পরিদপ্তরের বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত শাখার সকল কর্মচারীকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পে বদলী করা হয়। ১৪ ডিসেম্বর ১৯৬৫ তারিখের একটি সরকারী নির্দেশে সর্বজনাব মোহাম্মদ হোসেন মোল্লা, মমিনুল ইসলাম ভূঁইয়া এবং মোহাম্মদ বদিউল আলম প্রকল্প অফিসে রিপোর্ট করেন। ঢাকা থেকে তাঁরা সঙ্গে নিয়ে আসেন একটি রেক্স রোটারী ডুপ্লিকেটিং মেশিন এবং একটি আন্ডারউড টাইপ রাইটার। আসবাবপত্রের তাৎক্ষনিক অভাবে প্রফেসর মল্লিকের খাওয়ার টেবিলেই অফিসের কাজ শুরু করতে হয়।
অতি অল্প সময়ের মধ্যে প্রফেসর মল্লিক বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় জরুরী ভিত্তিতে কয়েকটি ভবন নির্মাণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাশ শুরু করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এসময় একটি গ্রন্থাগার ভবন (পূর্বের কাউন্সিল, একাডেমিক, উন্নয়ন ও ফটোগ্রাফী অফিস এবং ডাকঘর), ফ্যাকাল্টি সদস্যদের জন্যে একটি অফিস (পূর্বের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দপ্তর), ক্লাশ ভবন (পূর্বের হিসাব নিয়ামকের অফিস), দুতলা প্রশাসনিক ভবন (পূর্বের উপাচার্য ও রেজিষ্টারের দপ্তর), শিক্ষকদের বসবাসের জন্যে তিনটি একতলা বিল্ডিং, প্রত্যেকটিতে চারটি করে মোট বারটি ফ্ল্যাট, ছাত্রদের হোস্টেলের জন্যে এসবেস্টসের চালা দেওয়া তিনটি শেড (বর্তমানে প্রেস, শারীরিক শিক্ষা বিভাগ ও প্রকৌশল বিভাগ) নির্মাণ করা হয়। বলা হয়েছিল অস্থায়ী গ্রন্থাগার ভবন, ফ্যাকাটি অফিস এবং ক্লাশ ভবন প্রকৃতপক্ষে ব্যবহৃত হবে মেডিক্যাল সেন্টার, মেনটেন্যান্স অফিস এবং কিন্ডার গার্টেন স্কুল হিসেবে। দুতলা প্রশাসনিক ভবনে স্থাপিত হবে ইউ. ও. টি. সি.সদর দপ্তর। ছাত্রদের হোস্টেল হবে ছাপাখানা। শিক্ষকদের আবাসিক ফ্ল্যাটগুলো অবিবাহিত শিক্ষকদের ব্যবহারের জন্যে চিহ্নিত করার পরিকল্পনা ছিল। ১৯৬৬ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ জারী করা হয়। ঐ দিনেই প্রফেসর মল্লিক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে নিযুক্তি লাভ করেন। তিনি উপাচার্য পদে কাজে যোগ দেন ১৯৬৬ সালের ৯ অক্টোবর।
১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্বোধন ঘোষণা করেন তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের প্রাদেশিক গভর্ণর আবদুল মোনায়েম খান। উদ্বোধনের ১০ দিন পর ১৯৬৬ সালের ২৮ নভেম্বর বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস ও অর্থনীতি এই চারটি বিভাগে ২০২ জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে এম. এ. প্রথম পর্বে (প্রিলিমিনারি) ক্লাশ চালুর মাধ্যমে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। এসব বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন বাংলা বিভাগে জনাব আবুল কালাম মনজুর মোর্শেদ, ইংরেজি বিভাগে জনাব মোহাম্মদ আলী ও জনাব আজিজুল হাকিম, ইতিহাস বিভাগে ডঃ আবদুল করিম ও ড. জাকিউদ্দীন আহমদ এবং অর্থনীতি বিভাগে ড. এস. এ. আতহার। রেজিস্ট্রার নিযুক্ত হন জনাব মুহাম্মদ খলিলুর রহমান, তত্ত¡াবধায়ক প্রকৌশলী জনাব মহিউদ্দীন আহমদ খান, সহকারী প্রকৌশলী বাবু প্রফল্ল কুমার সোম এবং সহকারী গ্রন্থাগারিক পদে জনাব আতাউর রহমান। চমৎকার বিষয় হচ্ছে ২০২ জন শিক্ষার্থী নিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক যাত্রা যেদিন শুরু হয়েছিল ঐদিন ৪টি বিভাগের ক্লাস একই সাথে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। উক্ত ক্লাসে উপস্থিত শিক্ষার্থীর তালিকা ও সংখ্যা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।
প্রাথমিক বাধা বিপত্তি কাটিয়ে উন্নয়নের ধারা যখন পূর্ণবেগে ধাবমান তখনই শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীরা এই যুদ্ধে নেয় এক অগ্রণী ভূমিকা। ২৪ মার্চ ১৯৭১ প্যারেড ময়দানে (চট্টগ্রাম কলেজ ময়দান) একটি জমায়েতের আয়োজন করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাক্তন ছাত্র সমিতি। এদিনের অনুষ্ঠানসূচিতে ছিল গণমিছিল, সভা, গণসঙ্গীতের আসর ও গণআন্দোলন ভিত্তিক নাট্যাভিনয়। মুসলিম ইনস্টিটিউট থেকে প্যারেড ময়দান পর্যন্ত মিছিলে নেতৃত্ব দেন উপাচার্য এ. আর. মল্লিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রদের সঙ্গে মিছিলে আরো যোগ দেন বিশ্ববিদালয় ও কলেজের অনেক শিক্ষক। মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে সংঘর্ষে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জনাব আবদুর রব নিহত হন। ১৯৭০ সালে তিনি ছিলেন ইতিহাস বিভাগে প্রিলিমিনারি পরীক্ষার্থী। এ যুদ্ধে আরো শহীদ হন ইতিহাস বিভাগের ছাত্র ফরহাদ, রাজনীতি বিজ্ঞানের ছাত্র নাজিম উদ্দীন, ইফতেখার, খন্ডকালীন শিক্ষক অবনী মোহন দত্ত, প্রকৌশল বিভাগের প্রভাষ কুমার বড়–য়া, চেইনম্যান মোহাম্মদ হোসেন (বীর প্রতীক)।
নৌ কমান্ডো মোহাম্মদ হোসেনের বীরত্ব গাঁথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে আছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে। ১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়জন মুক্তিপাগল সৈনিক ডুবুরী ঝাপিয়ে পড়লো কর্ণফুলীর উত্তাল তরঙ্গে। লক্ষ্য তাদের শত্রæর জাহাজ। অভিযান সফল হল, কিন্তু ফিরলোনা একজন। ২৪ সেপ্টেম্বর বহির্নোঙ্গরে ভেসে ওঠে মোহাম্মদ হোসেনের লাশ। কোমরে তখনও বাঁধা জাহাজ বিধ্বংসী লিম্পেট মাইন।
উপাচার্য প্রফেসর এ. আর. মল্লিক মুক্তিযুদ্ধে যোগ দান করায় বিশ্ববিদ্যালয় কোষাধ্যক্ষ জনাব ইউ. এন. সিদ্দিকীকে ২২ মে ১৯৭১ সাল উপাচার্যের দায়িত্ব দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নতুন বিভাগ খোলা হয়, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ। মুক্তিযুদ্ধ শেষে প্রফেসর মল্লিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন এবং ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন।
এই সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আইন ’৭৩ এর বাস্তবায়ন। গবেষণার নূতন ক্ষেত্র চয়ন, সুন্দর ও সত্যের অন্বেষণে আত্মনিয়োগ ও ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে লুকায়িত বৃত্তিগুলোর বিকাশ সাধন এবং বৈষয়িক শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে রুজি-রোজগারের জন্য যোগ্য করে গড়ে তোলা এই দ্বিবিধ উদ্দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম রচিত হয়। এর বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন মুক্ত পরিবেশ ও স্বাধীনতা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আইন ’৭৩ এ পর্যাপ্ত স্বাধীনতার বিধান রয়েছে। প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আইন ’৭৩ অনুযায়ী নিযুক্তি প্রথম উপাচার্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের রজতজয়ন্তীতে প্রকাশিত স্মরণিকা ‘স্মৃতি’ শীর্ষক প্রকাশনায় ড.শামসুল হোসাইন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে উপরোক্ত তথ্যাদি পাওয়া যায়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হবার পাঁচ বছরের মধ্যেই আমাদের স্বাধীকার আন্দোলন শুরু হয়। ফলে প্রাথমিক পর্যায়েই এর উন্নয়ন বাধাপ্রাপ্ত হয়। একাত্তরে স্বাধীনতা লাভের পর সদ্য স্বাধীন দেশের আর্থিক অভাব অনটন এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা এই সংকটকে আরো বাড়িয়ে তোলে। পরবর্তীকালের সরকারগুলো বিকাশমুখী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে সুবিবেচনার পরিচয় দেয়নি। বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অবকাঠামো উন্নয়ন থেকে শুরু করে পড়া-লেখার মান উন্নয়নে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে বিশ্বের অনেক নামী-দামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সমযোতা (গঙট) চুক্তির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীবৃন্দ নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিদেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা কাজের সুযোগ অবারিত হয়েছে। এছাড়াও আমার জানা মতে কর্মকর্তাদের উন্নত প্রশিক্ষণের জন্যও এ সুযোগ রয়েছে।
৬ জনশিক্ষক ২০২ জন শিক্ষার্থী এবং ৪ জন কর্মকর্তা দিয়ে শুরু হওয়া বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে ২৭৫৫০ জনশিক্ষার্থী ৯০৬ জন শিক্ষক,৩৭৬ জন কর্মকর্তা ও ১৫৯৮ জন কর্মচারী নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান-গবেষণায় একটি সমৃদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষক-গবেষকবৃন্দ নব নব জ্ঞানের উদ্ভাবন করছেন এবং তা দেশ-জাতির কল্যাণে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। সম্মানিত শিক্ষকদের পাশাপাশি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীও জ্ঞান-গবেষণা, প্রশাসনিক দক্ষতা ও পারদর্শিতা এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ‘দক্ষতা উন্নয়ন’ শীর্ষক নিয়মিত কর্মশালার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ সম্মানিত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্র সম্প্রসারণে এগিয়ে নিতে অবদান রাখছেন। হাঁটি হাঁটি পা-পা করে দেশের অন্যতম উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স এখন ৫৬ বছর। আগামীদিনে এ পৃথিবীর জন্য দক্ষ ও যোগ্য মানবসম্পদ সৃষ্টিতে আলোর দিশারী হয়ে জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালিয়ে চলেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা উৎকর্ষের পাশাপাশি ‘৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে, ৭০-এর নির্বাচন, ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ দেশ ও জাতির প্রতিটি ক্রান্তিকালে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা।

লেখক : সহকারী রেজিস্ট্রার (তথ্য), চ.বি.