চট্টগ্রাম জেলার সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য

394

 

উপমহাদেশের অন্যান্য জায়গার মতো চট্টগ্রামের জীবন ও সংস্কৃতি ছিল গ্রামীণ। চট্টগ্রাম ও আরাকান সুপ্রাচীন কাল থেকে খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতক পর্যন্ত একটি অখন্ড রাজ্যরূপে শাসিত হতো। অর্থাৎ এক দেশ বলে পরিগণিত হতো। সেজন্যে এই গ্রামীণ সংস্কৃতিতে ছিল বর্মী প্রভাব এবং তাতে এখানকার জনগোষ্ঠীর এক বিশেষ পরিচয় গড়ে ওঠে। পরবর্তীকালে আরাকান রাজাদের কোন্দলের সুযোগ নিয়ে সমতট ও হরিকেল রাজ্যভুক্ত হয় চট্টগ্রাম। তখনও সমতট ও হরিকেলের রাজা-শাসকদের সঙ্গে আরাকানের রাজাদের প্রায়শ যুদ্ধ বিগ্রহ লেগে থাকতো। এজন্য কারো শাসনই নিরঙ্কুশ না হলেও চট্টগ্রামে বৌদ্ধ সংস্কৃতি প্রসারে বিঘ্ন ঘটে নি এবং যার প্রভাব এখানকার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতেও পড়েছে।
চট্টগ্রামে পরিবেশন শিল্পের ইতিহাস পাওয়া যায় সামান্য। তবে অনুমান করা যায়, যেহেতু নাচ-গান-নাটক আদিম মানব সমাজেও ছিল, সে জন্য চট্টগ্রামেও মানব বসতির কাল থেকে এসব পরিবেশনা শিল্প চলে আসছে।
সংগীতের ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাংলার সবচেয়ে প্রাচীন গান চর্যাগীত। চর্যাকারদের মধ্যে কয়েকজন চট্টগ্রামের অধিবাসী বলে পÐিতরা দাবি করেছেন। তাছাড়া, প্রাচীন বৌদ্ধ-তিব্বতি ভাষাসাহিত্য বিশারদ রায় বাহাদুর শরচ্চন্দ্র দাশ-এর এন্টিকুইটি অব চিটাগাং নিবন্ধে উল্লেখ আছে, দশম শতাব্দীতে চট্টগ্রামে ‘পÐিত বিহার’ নামে একটি বৌদ্ধ বিহার ছিল। এতে ‘কানুপাদ’, ‘হাড়িপাদ’ ‘শবরীপাদ’ প্রমুখ চর্যাকারেরা অধ্যাপনা করতেন বলে অনুমান করা হয়। অতএব বলা যেতে পারে, হাজার বছর আগে চট্টগ্রামে রাগ সংগীতের চর্চা কম-বেশি হতো।
চট্টগ্রামে লোকসংগীত মানব-বসতির সময় থেকে চলে এলেও রাগ সংগীত বা উচ্চাঙ্গ সংগীতের ইতিহাস অপেক্ষাকৃত কম প্রাচীন। তবে তার বয়সও হাজার বছরের উপরে। উল্লেখ্য যে, মধ্যযুগেও চট্টগ্রামে যে রাগ সংগীতের প্রচলন ছিল তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ সংগৃহীত ১৯টি রাগনামা ও ১৩টি রাগতালনামা পুঁথি মধ্য যুগে রাগ সংগীত চর্চারই প্রমাণ। এ-ছাড়া ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হকও রাগ-তাল সম্পর্কিত কয়েকটি পুঁথি চট্টগ্রামের পল্লী অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করেন। এসব পুঁথির রচয়িতারা চট্টগ্রামের অধিবাসী ছিলেন। ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে রাউজানের তৎকালীন জমিদার ওয়াহিদ মুহম্মদ চৌধুরীর আদেশে ফাজিল নাসির মুহাম্মদ রচিত রাগমালা পুঁথির অবিকৃত রূপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগে রক্ষিত আছে।
উনিশ শতকের শেষদিকে আনোয়ারা থানার পরৈকোড়া নিবাসী, জমিদার প্রসন্নকুমার রায়ের বৈঠকখানা, সংগীত রসিক তবলাবাদক হাওলার জমিদার সারদালালা তাঁর ভাঙঘুটনাস্থ (অধুনা জয়নগর) ‘নাচখানা’, ডাবুয়ার জমিদার ধর প্রমূখের পরিবারের উদ্যোগে সে সময় উচ্চাঙ্গ সংগীতের জলসা বসত।
প্রকৃত পক্ষে ব্রিটিশ শাসন ও পাশ্চাত্য শিক্ষার ফলে সমাজ জীবনে ধীরে ধীরে যে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তার প্রভাব এ দেশের সংস্কৃতিতেও পড়েছে। সমাজ বদলের সঙ্গে সঙ্গে রুচিরও পরিবর্তন হয়েছে। সংস্কৃতির রূপান্তরের কারণে এখানকার অনেক লোকসম্পদও ক্রমে বিলুপ্ত হয়েছে। কিন্তু এরপরও যা এখনো রয়েছে তার জন্য চট্টগ্রামবাসী গর্ব করতে পারে।
চট্টগ্রামের যেমন রয়েছে বৈচিত্রময় সংস্কৃতি তেমনি তার রয়েছে নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্যও। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হল চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান, মাইজভান্ডারী গান, হালদাফাডা গান, হঁঅলা গান, হাইল্যা সাইর, পাইন্যা সাইর, পালাগান বা গীতিকা, শিব-গৌরীর গান, উল্টা বাউলের গান, কানুফকিরের গান, ফুলপাট গান, ওলশা মাছের গান প্রভৃতি যেগুলো চট্টগ্রামের একান্ত নিজস্ব সম্পদ। এছাড়াও জব্বারের বলী খেলা ও বৈশাখী মেলা, মেজবান, সাম্পান, শুটকি মাছ, বেলা বিস্কিট প্রভৃতি চট্টগ্রামের সংস্কৃতিরই অনন্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখযোগ্য।
চট্টগ্রামী ভাষায় রচিত গ্রাম-চট্টলার জনমানুষের চিত্র সম্বলিত গান এখনও দেশ-বিদেশের রসিক মনকে মোহিত করে। আজও চট্টগ্রামের শিল্পী শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব-শেফালী ঘোষ জুটির কণ্ঠে গীত ‘আঞ্চলিক গান’ বাংলাদেশের বাইরেও সমাদৃত। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের তুমুল জনপ্রিয়তার কারণ ছিল মোহাম্মদ নাসির ও মলয় ঘোষ দস্তিদারের মূল চাটগাইয়া ভাষায় গান রচনা। এছাড়াও বিশিষ্ট গীতিকার সুরকার ও শিল্পী এম. এন আকতার, আব্দুল গফুর হালী পরবর্তীতে সৈয়দ মহিউদ্দিন ভান্ডারী সহ অনেকেই চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের প্রচার প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। উল্লেখ্য যে ১৯৩২ সালে এইচ. এম.ভি থেকে মোহাম্মদ নাসিরের চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের দুটি রেকর্ড বের করা হয়। শিল্পীদের মধ্যে সঞ্জিত আচার্য্য, কল্যাণী ঘোষ, শাক্যমিত্র বড়ুয়া প্রমূখ আঞ্চলিক গান পরিবেশনের মধ্য দিয়ে পূর্বের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সচেষ্ট রয়েছে। এছাড়া ফটিকছড়ি থানার মাইজভান্ডার নিবাসী সুফি সাধক মওলানা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ সাহেব প্রবর্তিত মাইজভান্ডারি তরিকার সাধন সংগীত হিসেবে মাইজভান্ডারি গানের উদ্ভব। দলবদ্ধভাবে সুর, তান, লয়ে ঢোলকের তালে তালে এই গান গীত হয়। মাইজভান্ডারি গানের অন্যতম খ্যাতনামা গীতিকার ও শিল্পী ছিলেন কবিয়াল রমেশ শীল।
উত্তর চট্টগ্রামের হালদা নদীর নামানুসারে হয়েছে হালদাফাডা গান। হালদা নদীতে নৌকা-সাম্পানের মাঝি-মাল্লারা নদীতে নৌকা-সাম্পান বেয়ে যাবার সময় এই গান গাইতেন। গান গাওয়া হত উঁচু পর্দায়। হালদা ফাডা গান অনেকটা ভাটিয়ালি গানের মতো। তবে যন্ত্র ছাড়া সুরের সামঞ্জস্য রক্ষা করতে হয়। চট্টগ্রামের গ্রামাঞ্চলে বিয়ে-শাদি, খৎনা, মেয়েদের কর্ণছেদন উপলক্ষে নারীরা নেচে-নেচে এই গান গেয়ে থাকেন। হঁঅলা গানের মহলে পুরুষদের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। এছাড়া সারি গানেরই মতো আমন মওসুমে ধান রোপণের সময় চাষীরা যে গান গাইতেন তা হাইল্য সাইর নামে পরিচিত। স›দ্বীপের অধিবাসীরা হাইল্যা সাইরের গানকে পাইন্যা সাইরও বলে থাকেন। ৮/১০ জন মিলে সমবেতভাবে হাইল্যা সাইর ও পাইন্যা সাইর পরিবেশন করে এবং দোহারেরা ধুয়া ধরে।
চট্টগ্রামের সংস্কৃতির ঐতিহ্যের অংশ হয়ে উঠা চট্টগ্রাম শহরের বদরপাতি নিবাসী আবদুল জব্বার সওদাগর প্রবর্তিত বলি খেলা ১৯০৯ সালের ১২ বৈশাখ তারিখে লালদিঘির ময়দানে সর্বপ্রথম অনুষ্ঠিত হয়। তখন থেকে প্রতি বছর ১২ বৈশাখ তারিখে শহর চট্টগ্রামে আবদুল জব্বার সওদাগরের বলি খেলা ও বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
বর্তমান শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে প্রগতিশীল বামপন্থীদের উদ্যোগে চট্টগ্রামেই প্রথম কবিয়ালদের সংগঠিত করার চেষ্টা হয়েছিল এবং এর লক্ষ্য ছিল কবিগানকে অশ্লীলতা ও চটুলতা মুক্ত করে জনগণের আন্দোলন ও সংগ্রামের অন্যতম হাতিয়ার করে তোলা। এসময় গণজাগরণে কবিগানের অন্তনির্হিত শক্তি পুনরাবিষ্কারে চট্টগ্রামের কবিয়াল রমেশ শীলের নেতৃত্বে ফণী বড়ুয়া, রাইগোপাল, এয়াকুব আলী, হেমায়েত আলী প্রমুখ কবিয়াল বিশেস ভ’মিকা পালন করেন। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে রমেশ শীলকে সভাপতি ও ফণী বড়ুয়াকে সম্পাদক করে ‘চট্টগ্রাম কবি সমিতি’ নামে গঠিত কবিয়ালদের সংগঠনই ছিল এই নতুন দিগন্ত উন্মোচনের সহায়ক শক্তি। চট্টগ্রামের লোকগীতিকা বা গাঁথাকাব্যে সুরারোপ করে তাল ও বাদ্যযন্ত্রী সহযোগেই পরিবেশিত হতো পালাগান। বর্তমান শতাব্দীর গোড়ার দিকেও পালাগানের প্রচলন ছিল।
উনিশ শতকের চট্টগ্রামের সংগীতগুণীদের অনেকেরই নাম বর্তমানে বিস্মৃত। তবে যতটুকু জানা যায় তাতে দেখা যাচ্ছে, জমিদার প্রসন্ন কুমার রায়ের পুত্র জমিদার দীনেশ রায়, কানুনগোপাড়ার হরেন্দ্রলাল দত্ত, ধলঘাটের বঙ্কিম দস্তিদার, সূর্য দাস, ধোরলার ত্রিপুরা চৌধুরী ও দুর্গাকিঙ্কর চৌধুরী, নোয়াপাড়ার যোগেশ গুহ, মনীন্দ্র রায়, ভাটিখাইনের রবীন্দ্র চৌধুরী, সারোয়াতলীর দীনেশ সেন, মুরারী ঠাকুর প্রমুখ গুণীরা কণ্ঠ ও যন্ত্রসংগীতে চট্টগ্রামকে মাতিয়ে রেখেছিলেন। উনিশ শতকের শেষার্ধে রাঙ্গুুিনয়ার জগৎ ঠাকুর চট্টগ্রামে ধ্রূপদ চর্চার পুনঃপ্রবর্তন করেন। তিনি বিষ্ণুপুরের ধ্রূপদীয়াদের কাছে তালিম নিয়েছিলেন বলে জানা যায়। তবে বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত তিনিই ছিলেন চট্টগ্রামে একমাত্র ধ্রূপদ শিল্পী। তবে শতাব্দীর গোড়ায় চট্টগ্রাম সংগীত সাধনার এক নতুন যুগের সূচনা হয়। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় উপমহাদেশের দ্বিতীয় এবং অবিভক্ত বাংলার প্রথম সংগীত শিক্ষাকেন্দ্র বলে পরিচিত ‘আর্য সংগীত সমিতি’। ইতিপূর্বে সংগীত শিক্ষা ছিল গুরু ও ওস্তাদকেন্দ্রিক। ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে চট্টগ্রামে সংগীতের প্রচার ও প্রসারে যাঁরা ভূমিকা পালন করেছিলেন তাঁদের প্রায় সকলেই ছিলেন সুরেন্দ্র লালের শিষ্য বা সহচর। এরা সকলেই সে সময় আর্যসংগীত আলোকিত করে রেখেছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন সুরেন্দ্রলালের ছোট ভাই ধীরেন্দ্র লাল দাস, সালামত আলী দেওয়ান, গঙ্গাপদ আচার্য, শ্রীপদ আচার্য, জ্যোতিন কানুনগো, হরিপ্রসন্ন দাস, জীবন দাস, নির্মল চৌধুরী, যতীন্দ্রনাথ দত্ত, সিদ্ধেশ্বর দাসগুপ্ত, হরি ভট্টাচার্য, বিমল দত্ত, ধীরেন সেন, বিধু চৌধুরী, প্রিয়গোপাল গুপ্ত (অধরবাবু), তিন কড়ি দে, শিবশঙ্কর মিত্র, গোপাল দাশগুপ্ত, সুবোধ রায়, অনিল গুহ, প্রিয়দারঞ্জন সেনগুপ্ত, কুমুদবন্ধু সেন (জুলু বাবু), হরি সরকার, কিশোর সাহা, বিজয় দত্ত, জ্যোতিন মল্লিক, সুরেন্দ্র লালের পুত্র আদিত্য দাস, প্রধীর দাশগুপ্ত, বিনোদ চক্রবর্তী, অজিত রায়, ননী মিত্র, কালিশঙ্কর দাস, আবু নঈম, দেবব্রত ভট্টাচার্য প্রমুখ।
১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে সুরেন্দ্র লাল আর্যসংগীতে ছাত্রীদেরও সংগীত শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেন। তাঁর ছাত্রীদের মধ্যে ঊষা সেনগুপ্তা নিখিল বঙ্গ সংগীত সম্মেলনে সেতারে কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। এছাড়া মালতী দত্ত, চিন্ময়ী কানুনগো, অনিমা সেনগুপ্ত, সুরেন দাসের কন্যা লীলা, বনবীথি সেনগুপ্তা, চিত্রা দত্ত প্রমুখ ত্রিশের দশকের মাঝামাঝি থেকে ভারত বিভাগ পূর্বকাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের সংগীত জগৎকে উজ্জ্বল করে রেখেছিলেন।
চট্টগ্রামে প্রাচীনকাল থেকে কীর্তন, শ্যামা সংগীত, জারি, সারি, বারমাসি, বাউল-মুর্শিদি, মারফতি, কবিগান ইত্যাদির চর্চা হয়ে আসছে। চৈতন্যযুগে চট্টগ্রামে কীর্তন গানেরও প্রথম প্রচলন হয়। শ্রীচৈতন্যের অন্যতম পার্ষদ পুন্ডরীক বিদ্যানিধি ছিলেন হাটহাজারী থানার মেখলের অধিবাসী। চট্টগ্রামে অতীতে কীর্তন গানের খুব সমাদর ছিল এবং বর্তমানে হিন্দু সম্প্রদায়ের মহোৎসবগুলিতে অষ্টপ্রহর বা ষোড়শ প্রহর নাম সংকীর্তন হয়। বর্তমান শতাব্দীর সত্তরের দশক পর্যন্ত পালা কীর্তনেরও প্রচলন ছিল। পদাবলী কীর্তনিয়া মাখনলাল ব্যানার্জি ও তাঁর পুত্র গোপাল বানার্জী খুবই খ্যাতনামা ছিলেন। পালা কীর্তনে, বামা ঠাকুর, শ্যামা ঠাকুর, কৃষ্ণ ঠাকুর, সত্যেন্দ্র রুদ্র, মহেন্দ্র চক্রবর্তী, জ্ঞান সাধু, মনোরঞ্জন দে ছিলেন সুপরিচিত কীর্তনিয়া। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যেও কীর্তনের প্রচলন আছে। সংগীতজ্ঞ জগদানন্দ বড়ুয়ার পিতা শিক্ষাবিদ মোহন চন্দ্র বড়ুয়া বহু বৌদ্ধ কীর্তনের রচয়িতা। তিনি নিজেও ছিলেন কীর্তনিয়া। তাঁর রচিত সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগ ও মার বিজয় ঢপকীর্তনের ঢঙে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে পরিবেশিত হয়েছিল।
প্রাচীনকাল থেকে চট্টগ্রামে কাওয়ালি, গজল, হামদ্, নাত্, মারফতি, মুর্শিদি ইত্যাদি ধর্মীয় ভক্তিগীতির চর্চা হয়ে আসছে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে শিল্পী আবু কাওয়ালের খ্যাতি সুদূর কলকাতা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। তিনি মোটিয়া বুরুজের নবাব ওয়াজেদ আলি সাহেবের দরবারের ওস্তাদ বংশীয়দের কাছে তালিম নিয়েছিলেন। ।
রাগসংগীতের পাশাপাশি রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল সংগীত, লোক সংগীত, গণসংগীত ইত্যাদি সুগম সংগীতের চর্চাও হয়ে আসছে দীর্ঘ সময়কাল ধরে। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের শিল্পী ও খ্যাতনামা রবীন্দ্র সংগীত গায়ক কলিম শরাফী চট্টগ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলে গণসংগীত ও রবীন্দ্র সংগীত চর্চায় নতুন মাত্রা পায়। হরিপ্রসন্ন পাল চট্টগ্রামের গণসঙ্গীতের একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব।
১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারি হবার পর সংগীত চর্চায় আরেকটা ধাক্কা লাগে। ১৯৬০-৬১ খ্রিস্টাব্দের নজরুলের হীরক জয়ন্তী ও রবীন্দ্রনাথের জন্মশত বার্ষিকীকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে সংগীত শেখবার ও শিখাবার যে ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় তাতে চট্টগ্রামের সংগীত জগতে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়। এ আয়োজনে কামাল এ খান সহ অনেকেই জড়িত ছিলেন। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে ভারত থেকে উচ্চতর উচ্চাঙ্গ প্রশিক্ষণ নিয়ে শিল্পী নীরদ বরণ বড়ুয়া চট্টগ্রামে আর্যসংগীতে শিক্ষকতায় যোগ দেন। এর কিছু দিন পর ওস্তাদ দবির খানের শিষ্য মনোরঞ্জন বড়ুয়া কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম ফিরে এসে ব্যক্তিগতভাবে সংগীত শিক্ষা দিতে শুরু করেন। প্রিয়দা রঞ্জন সেনগুপ্তের তত্ত্বাবধানে সংগীত ভবনেও সংগীত শিক্ষাদান চলতে থাকে। ষাটের দশকে অনেকেই সংগীত-শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত এই দশ বছরে চট্টগ্রামে মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রচুর ছেলে-মেয়ে সংগীত শিক্ষায় উৎসাহী হয়ে ওঠে এবং এর প্রধান কারণ ছিল ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামে বেতার কেন্দ্র স্থাপন।
চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের রয়েছে দীর্ঘ ঐতিহ্য। এসব ঐতিহ্যের তালিকা খুবই দীর্ঘ। তৎমধ্যে- চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম নজরুল জয়ন্তী উদযাপিত হয় ১৯৪৬ সালে। অধ্যাপক আবুল ফজল সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম চৌধুরী। ১৯৫১ সালের ১৬ থেকে ১৯ মার্চ শহরের হরিখোলার মাঠে সাংস্কৃতিক বৈঠক এবং প্রান্তিক নবনাট্য সংঘ-এর উদ্যোগে যৌথভাবে দেশের প্রথম সাংস্কৃতিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এই সাংস্কৃতিক সম্মেলনে মূল সভাপতি ছিলেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। জে এম সেন হল প্রাঙ্গণে প্রান্তিক নবনাট্য সংঘ এবং চট্টগ্রাম কবিয়াল সমিতির যৌথ উদ্যোগে ১৯৫৩ সালের ১৭ ও ১৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয় দেশের প্রথম লোকসংস্কৃতি সম্মেলন। কবিয়াল রমেশ শীল এই কমিটির সভাপতি এবং অন্যতম যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন কলিম শরাফী।
চট্টগ্রামে মহিলা সমন্বিত প্রথম যাত্রাদল প্রতিষ্ঠিত হয় হাজী আমিন শরীফের ‘বাবুল অপেরা’ ১৯৫৪ সালে। অমেলেন্দু বিশ্বাস যাত্রশিল্পের এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। ১৯৫২ সালে মাহবুব আলম চৌধুরীই একুশের প্রথম কবিতা “কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি” রচনা করেছিলেন।
চট্টগ্রামে নিয়মিত চলচ্চিত্র প্রদর্শন শুরু হয় সদরঘাটস্থ কমলাবাবুর থিয়েটার হলে ১৯২৬ সালে। বাংলাদেশের আধুনিক নৃত্যের প্রতিভু বুলবুল চৌধুরী এই চট্টগ্রামেরই সন্তান। যিনি সামাজিক ভাবে নাচকে প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় করতে বিশাল ভুমিকা রেখেছিলেন। খ্যাতিমান নৃত্যশিল্পী রুনু বিশ্বাস, প্রখ্যাত সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক সত্য সাহা প্রমূখ গুণিজন এ অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেছেন।
নাটকের ক্ষেত্রেও চট্টগ্রামের রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস ও উল্লেখযোগ্য ভুমিকা। দীর্ঘ সময় থেকে এখানে নাট্যচর্চা হয়ে আসছে। স্বাধীনতা পূর্ব সময়ে এখানে প্রতিবাদী নাটক ‘এবারের সংগ্রাম’ এবং ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এ নাটক দুটি মঞ্চস্থ হয়েছে। প্যারেড মাঠে ‘এবারের সংগ্রাম’ নাটকটি চলাকালীন সময়ে চট্টগ্রাম বন্দরে সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসের খবর আসলে উপস্থিত জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে এবং আক্রমণ করে অস্ত্র খালাসে বাঁধা দেয়। মিলন চৌধুরী রচিত ‘যায় দিন ফাগুনো দিন’ বাংলাদেশের প্রথম পথ নাটক।
চট্টগ্রামের ব্যান্ড সঙ্গীতেরও একটি বলবান ধারা পরিলক্ষিত হয় একেবারে শুরুর কাল থেকে। চট্টগ্রাম থেকে ষাটের দশকের প্রথম দিক থেকে যাঁরা ব্যান্ড সঙ্গীতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন তাঁদের মধ্যে তপন চৌধুরী, কুমার বিশ্বজিৎ, নকীব খান, আইয়ুব বাচ্চু, পার্থ প্রমূখ উল্লেখযোগ্য।
এছাড়াও আস্কর আলী পন্ডিত, সাহিত্যিক কবি লোক গবেষক আশুতোষ চৌধুরী, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ আবুল ফজল, ইতিহাসবিদ আব্দুল হক চৌধুরী, ছড়াকার সুকুমার বড়–য়া, সাহিত্যিক নাট্যকার ছৌধুরী জহুরুল হক, বিশিষ্ট চিত্র শিল্পী চট্টগ্রাম আর্ট কলেজের প্রতিষ্ঠিত সবিহ উল আলম প্রমূখ তাঁদের কর্ম ও সৃজনে অত্র অঞ্চলের গৌরব বৃদ্ধি করেছেন।
পরিশেষে বলতে হয় সত্যিকারের লোকসাহিত্যের জন্ম যেমন পল্লীর লোকারণ্যে, তেমনি তার স্থিতিও পল্লীর নৈসর্গিক পরিবেশে, সহজ সরল মানুষের মুখে-মুখে। কালের করাল গ্রাসে এই অমূল্য সম্পদের বহু বিলুপ্তি ঘটেছে। চট্টগ্রামের হারিয়ে যাওয়া গর্বের এই ইতিহাস ঐতিহ্য ধরে রাখার দায়িত্ব আমার-আপনার, আমাদের সকলের। তার কারণ সৃজন ও সমীক্ষার ক্ষেত্রে মানুষ সব সময় সন্ধান করে পূর্বপুরুষদের, খুঁজে বেড়ায় অতীতকে, অতীতের সব কিছু নির্বিচারে গ্রহণ না করলেও অতীত শক্তি যোগায় নতুন পথে এগিয়ে যাবার, পাথেয় হয় পথ চলার। সময় সল্পতার দরুণ অনেক তথ্য এখানে সন্নিবেশিত করা যায়নি। তার জন্য দু:খ প্রকাশ করছি।