চট্টগ্রামে রবীন্দ্রনাথ

265

বাংলা সাহিত্যাকাশের সমুজ্জ্বল রবি কবিগুরু রবীন্দনাথ ঠাকুর জমিদারির সুবাদে কুষ্ঠিয়ার শিলাইদহ, পাবনার সাজাদপুর ও রাজশাহীর পতিসরে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকব্যাপী বসবাস করেছেন। বাংলা সাহিত্যের চর্চায় বিশ্বে চট্টগ্রামবাসীর অবদানকে স্বীকৃতি দিতেই ১৯০৭ সালে কবিগুরু চট্টগ্রাম আসেন। কবি সংবর্ধনার অন্যতম উদ্যোক্তা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব উকিল কমলাকান্ত সেন মারা যান ১৯০৬ সালে। এর প্রতি কবির শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হয়েছিল। আর যা কবিকে চট্টগ্রাম আসতে আরো বেশি আবেগতাড়িত করেছিল, অনুপ্রাণিত করেছিল।
১৯০৭ সালে ১৭ জুন সোমবার সকালবেলা কবি চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে এসে পৌঁছান। এদিন কবির সম্মানে পুরো স্টেশনকে ফুল দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়েছিল। স্টেশনে পুষ্পসজ্জিত করে রাখা হয়েছিল ঘোড়ার গাড়ি। এতে করেই কবি জেনারেল হাসপাতালের উত্তর দিকে প্রয়াত কমলাকান্তের দ্বিতল বাড়িতে আসেন। সেদিন কবিকে এক নজর দেখতে কৌতুহলী পুরো চট্টগ্রামের মানুষ সেখানে ভিড় করেছিল। কমলাকান্তের বসার ঘরে উৎসুক জনতা ভিড় করতে থাকে কবিকে দেখতে আর একটু কথা বলার প্রত্যাশায়। কবি সেদিন প্রফুল্ল চিত্তে সবার সাথে কুশল বিনিময় করেন। ১৭ তারিখ কমলাকান্তের বাসায় রাত্রিযাপন করে কবি ১৮ তারিখ সঙ্গীসহ বের হয় চট্টগ্রাম ঘুরতে। কবি কর্তফুলির তীরে জাহাজঘাট পর্যন্ত গিয়েছিলেন সেদিন। ঐদিন সন্ধ্যাবেলা সদরঘাটস্থ কমলাবাবুর থিয়েটার হলে কবিকে জাঁকজমকপূর্ণ এক পরিবেশে সংবর্ধনা দেয়া হয়। ঐদিন বিশাল হলটি স্বদেশপ্রেমিক সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মীতে পরিপূর্ণ ছিল। সেদিন প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল, এরপরও হাজারো মানুষের স্বতস্পূর্ত উপস্থিতি কবিকে বেশ আনন্দ দিয়েছিল। সংবর্ধনার উত্তরে পূর্বকার অনুষ্ঠানগুলোতে কবি প্রবন্ধ পাঠ করতেন কিন্তু ঐদিন দিয়েছিলেন বক্তৃতা। এতে তিনি প্রাচীন বা মধ্যপন্থী নবীন বা উগ্রপন্থি কারো পক্ষ না নিয়ে বরং উভয় পক্ষকে দোষারোপ করেন। সাধারণ মানুষের কাছে এসে তাদের নিয়ে কাজ করার উপর গুরুত্বরোপ করেন। অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে কবি ব্রজকুমার সেন রবী বাবুকে একটা গান করতে অনুরোধ করেন। তখন কবিসঙ্গীরা মৃদু আপত্তি জানালে রবীন্দ্রনাথ বলেন, আমি কবির পিতার আবদার অগ্রাহ্য করতে পারি না। অতঃপর তিনি একটি গান করেন। তবে কোন গানটি করেছিলেন তা জানা যায়নি। ঐদিনই কবি ৮:৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম ত্যাগ করেন।
নোবেল পাবার ৬ বছর আগেই চট্টগ্রামবাসী কবিকে সংবর্ধনা দিয়েছিল যা সত্যিই চট্টগ্রামবাসীর জন্য গর্বের। এছাড়াও ১৯৯২ সালের ৭ জুলাই চট্টগ্রামের কৃতি সন্তান কেদারনাথ দাশগুপ্ত লন্ডনে কবিগুরুকে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন।
চট্টগ্রামের প্রতি অন্য অনেক মণীষীর মতো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছিল। চট্টগ্রামের কৃতীসন্তাান কবি নবীনচন্দ্র সেন, কবিগুণাকর নবীনচন্দ্র দাস, পন্ডত ধর্মরাজ বড়–য়া, কবিভাস্কর শশাঙ্ক মোহন সেন, কবি নলিনীকান্ত সেন, নাট্যনির্দেশক কেদারনাথ দাশগুপ্ত, উকিল যামিনীকান্ত সেন, সাহিত্যিক অধ্যাপক রজনীরঞ্জন সেন, কবি জীবেন্দ্র কুমার দত্ত প্রমুখ সাহিত্যসেবীর লেখার সাথে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যেমন পরিচয় ছিল তেমনি ছিল ব্যক্তিগত সান্নিধ্য ও পত্রবিনিময়। সাহিত্য চর্চায় চট্টগ্রামের অবদানের সাথে পরিচিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ফলে চট্টগ্রামবাসীদের আমন্ত্রণে ১৯০৭ সালে চট্টগ্রাম আগমনে কবি দ্বিধাগ্রস্থ ছিলেন না।
রবীন্দ্রসাহিত্যে বৃহৎ বাংলার পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশ একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান জুড়ে আছে। তবে বাংলাদেশের উত্তর অংশের কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, পাবনার সাজাদপুর ও রাজশাহীর পতিসরের সাথে জমিদারিসূত্রে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ও যোগাযোগ। বাংলাদেশের শিলাইদহ, সাজাদপুর ও পতিসরে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকব্যাপী রবীন্দ্রনাথের বসবাস রবীন্দ্রমানস গঠনে রাখে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা, এখানেই লাভ করেন উদার প্রকৃতি ও বৃহৎসমাজের সান্নিধ্য।
স্বদেশী আন্দোলনে চট্টগ্রামের অগ্রণী ভ‚মিকা, চট্টগ্রামে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের শাখা স্থাপন ইত্যাদি প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ চট্টগ্রামের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন, বরিশাল সফর শেষে কবি ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭২-১৯৪০), কেদারনাথ দাশগুপ্ত (১৮৭৮-১৯৪২) প্রমুখকে সাথে নিয়ে ১৭ জুন ১৯০৭ তারিখ সকালে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে এসে পৌঁছেন।
তাঁর আগমন উপলক্ষে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করে রেল স্টেশনটিকে ফুল দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়েছিল। রেল স্টেশনে রাখা হয়েছিল পুষ্প সজ্জিত ঘোড়ার গাড়ি করে কবিকে জেনারেল হাসপাতালের উত্তর দিকে প্রয়াত কমলাকান্ত সেনের দ্বিতল বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। বিশাল বাড়ির সম্মুখস্থ বিশাল প্রাঙ্গণে কবিকে দেখার জন্য প্রচুর লোকের সমাগম ঘটে। সেন বাড়ির বিশাল ড্রইং রুমেও কবিকে দেখার জন্য অবিরাম লোক আসতে থাকে। কবি প্রশান্ত মনে তাদের সাথে কুশল বিনিময় করতে থাকেন। সেদিন সন্ধ্যাবেলা চট্টগ্রাম কলেজের আইনের অধ্যাপক সাহিত্যিক রজনীরঞ্জন সেন (১৮৬৭-১৯৩৪) এর বাসায় চট্টগ্রামের সকল স্বদেশপ্রেমিক সাহিত্যিক সাহিত্যানুরাগীদের উপস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ চট্টগ্রামে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ-এর শাখা গঠন সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করেন। কমলাকান্তের সেন বাড়িতে রাত্রিযাপন করে ১৮ জুন, মঙ্গলবার, ১৯০৭ তারিখ সকাল বেলা কবি সঙ্গীসহ চট্টগ্রাম শহর ঘুরতে বের হন।
কবি কর্ণফুলী নদীর তীরে জাহাজঘাটা পর্যন্ত গিয়েছিলেন। ১৮ জুন ১৯০৭ তারিখ বিকেল বেলা সদরঘাটস্থ কমলাবাবুর থিয়েটার হলে কবিকে জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সবিশেষ উল্লেখ্য, কমলাবাবুর থিয়েটার হল হাত বদল হয়ে শেষ। নামকরণ হয়েছিল ‘লায়ন সিনেমা হল’, স¤প্রতি তাও বিলুপ্ত হয়ে সেখানে গড়ে ওঠেছে ফ্ল্যাট বাড়ি।
ঐ দিন বিশাল হলটি স্বদেশপ্রেমিক সাহিত্যিক সংস্কৃতিকর্মীতে পরিপূর্ণ ছিল। তখনও কিন্তু প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল, দুর্যোগপূর্ণ প্রাকৃতিক আবহাওয়াকে উপেক্ষা করে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সর্বস্তরের জনগণ কবিকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য > ৪র্থ পৃষ্ঠায় দেখুন
> ৩য় পৃষ্ঠার পর
ও কবির বক্তব্য শোনার জন্য উপস্থিত হয়েছিল। সংবর্ধনার উত্তরে কবি অতীতের মতো কোন প্রবন্ধ পাঠ করেননি, দিয়েছিলেন একটি বক্তৃতা।
বক্তৃতায় তিনি প্রাচীন বা মধ্যপন্থি এবং নবীন বা উগ্রপন্থি কারো পক্ষ নেননি, বরং উভয় পক্ষকে দোষারূপ করেন। সাধারণ মানুষদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে এসে তাদের নিয়ে কাজ করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। সভার কার্য শেষ হলে কবিভাস্কর শশাঙ্ক সেনের বাবা, কবির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের অন্যতম উদ্যোক্তা, সঙ্গীতরসিক কবি ব্রজকুমার সেন রবীন্দ্রনাথকে একটা গান করার অনুরোধ জানান। তখন কবিভক্তরা মৃদু ‘আপত্তি জানালে রবীন্দ্রনাথ বলেন, আমি কবির পিতার আবদার অগ্রাহ্য করতে পারি না।
অতপর তিনি একটি গান করেন। মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে ১৮ জুন ১৯০৭ তারিখ রাত ৮.৩০ টার ট্রেনে কবি সহযাত্রীসহ চট্টগ্রাম ত্যাগ করেন। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির ছয় বছর আগে কবির সাহিত্য প্রতিভার যথাযথ মূল্যায়ন করে কবিকে জাঁকজমকভাবে সংবর্ধনা দিতে পারা চট্টগ্রামবাসীর জন্য কম কৃতিত্বের বিষয় নয়। আমরা আমাদের পূর্বসূরিদের এহেন প্রাগ্রসর চিন্তাঋদ্ধ কর্মের জন্য গর্ব অনুভব করতে পারি। নিবেদন করি উদ্যোক্তাদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধার্ঘ্য।
কবির অনুপ্রেরণায় দেরিতে হলেও ১৯১১ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের চট্টগ্রাম শাখা গঠিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের চট্টগ্রাম আগমনের ছ’বছর পর ১৯১৩ সালের ২২ ও ২৩ মার্চ চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হয় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ষষ্ঠ অধিবেশন। মিউনিসিপ্যাল স্কুল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত দুই দিনের অধিবেশনে অবিভক্ত বাংলার খ্যাতিমান ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও সাহিত্যসেবী আচার্য প্রফুল্লকুমার রায়, সাহিত্যিক অক্ষয় চন্দ্র সরকার, প্রখ্যাত কবি ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (ডিএল রায়), ছন্দের যাদুকর কবি সত্যেন্দ্রনাাথ দত্ত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের খ্যাতনামা অধ্যাপক ও সুসাহিত্যিক বিনয় সরকার, প্রখ্যাত চিন্তাবিদ ও সাহিত্যপ্রেমী রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়, বাগ্মী-রাজনৈতিক নেতা ও সাহিত্যসেবী বিপিনচন্দ্র পাল প্রমুখ।