চট্টগ্রামে প্রাথমিক শিক্ষাকে মানসম্মত করতে চাই

58

বর্তমান সরকার মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা এবং প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষ মানবসম্পদ গড়ার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে। বাস্তবায়ন হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রণীত ‘রূপকল্প ২০২১’। আর তারই হাত ধরে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক নতুন এক পদ্ধতি চালু করেছেন, সেটি হল ‘জেলা প্রশাসক প্রাথমিক শিক্ষাবৃত্তি’।
চট্টগ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার শতভাগ হলেও প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির আগেই শতকরা ১১ ভাগ শিশু ঝরে পড়ে। এ ঝরে পড়ারোধ করতেই চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন ‘জেলা প্রশাসক প্রাথমিক শিক্ষাবৃত্তি’ প্রদানের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন।
গতকাল সোমবার চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেনের সাথে আলাপচারিতায় এ তথ্য উঠে আসে।
জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হোসেন বলেন, চট্টগ্রাম জেলায় প্রাথমিক শিক্ষাকে মানসম্মত করতে, ঝরে পড়ারোধ করে শিশুদেরকে মাধ্যমিক পর্যায়ে পৌঁছে দিতে এ শিক্ষাবৃত্তি অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের নিজস্ব অর্থায়নে চট্টগ্রাম জেলার পিছিয়ে পড়া, অবহেলিত, গরীব প্রাথমিক শিক্ষার্থীরা এ বৃত্তির আওতায় থাকবে।
উল্লেখ্য, প্রাথমিক পর্যায়ে গত শনিবার হাটহাজারী উপজেলার ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের মনাই ত্রিপুরাপাড়ায় বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার মান উন্নয়নে শিক্ষার্থীদের জেলা প্রশাসক প্রাথমিক শিক্ষা বৃত্তি প্রদান করা হয়েছে। তখন ওই পাড়ার ৬০ জন শিক্ষার্থীর মাঝে ৬০ হাজার টাকা শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করা হয়।
জেলা প্রশাসক বলেন, প্রাথমিকভাবে একটি ফান্ড তৈরি করা হবে এ শিক্ষাবৃত্তির জন্য। এ ফান্ড থেকে সকল উপজেলায় বৃত্তি প্রদান করা হবে। তিনি বলেন, একটি শিশু বড় হয়ে কেমন হবে, শিশুটি কী রকম চরিত্রবান হবে, সে কতটুকু জাতীয় চেতনা বা আদর্শ ধারণ করবে কিংবা সমাজের প্রতি, দেশের প্রতি কতটুকু দায়িত্বশীল হবে- তা অনেকাংশেই নির্ভর করে তার শৈশবের শিক্ষার উপর। নীতি-নৈতিকতা বা আদর্শের এই বীজ রোপিত হয় পরিবারে, এরপর প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। প্রাথমিক পর্যায়ে শিশুদের অধিক পড়াশোনার চাপে না রেখে তাদের দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, নৈতিক ও নান্দনিক বিকাশ সাধন এবং উন্নত জীবনের স্বপ্ন দর্শনে উদ্বুদ্ধ করা উচিত। তাই উন্নত মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি আধুনিক প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার জুড়ি নেই।
ইলিয়াস হোসেন বলেন, শিশুরাই একদিন শিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদ হয়ে দেশের হাল ধরবে এবং সার্বিক উন্নয়নে কাজ করবে। উন্নত রাষ্ট্র হওয়ার লক্ষ্যে সরকারের যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, তা বাস্তবায়নে বর্তমান প্রজন্মকে এখন থেকে প্রস্তুত করতে হবে এবং সেই প্রস্তুতির সূচনা হওয়া উচিত প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে।
এসডিজি বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)’ এর ৪ নং অভিষ্ট হলো ‘সকলের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং জীবনব্যাপী শিক্ষালাভের সুযোগসৃষ্টি’। যার ৪.২ নং লক্ষ্যমাত্রা হলো ২০৩০ সালের মধ্যে সকল ছেলে মেয়ে যাতে প্রাথমিক শিক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাসহ শৈশবের একেবারে গোড়া থেকে মানসম্মত বিকাশ ও পরিচর্যার মধ্যদিয়ে বেড়ে ওঠে তার নিশ্চয়তা বিধান করা। ‘সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি)’ অর্জনে বাংলাদেশ যে সফলতা দেখিয়েছে, একইভাবে এসডিজি অর্জনেও সফলতার জন্য প্রয়োজন গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করা।
প্রাথমিক শিক্ষার চ্যালেঞ্জ নিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, উন্নত বিশ্বের মতো প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এখনো কিছু চ্যালেঞ্জ আছে, যেগুলো মোকাবেলায় সামগ্রিকভাবে আমাদের কাজ করতে হবে। সকল শিশুর বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত করে, তাদের ঝরে পড়া রোধ করতে হবে, বিদ্যালয়সহ সকল স্থানে লিঙ্গ সমতা বিধান করতে হবে, পূর্ণ যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে, শ্রেণিকক্ষ অনুপাতে শিক্ষার্থী নিশ্চিত করতে হবে, দুর্বল শিক্ষার্থী চিহ্নিত করে তাদের বাড়তি যত্ন নিতে হবে। দেখা যায়, শহরতলী, প্রত্যন্ত এলাকা বা দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় কর্মজীবী শিশু, প্রতিবন্ধী শিশু ও মেয়ে শিশুরা শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে নিরাপত্তার ঘাটতির কারণে যৌন হয়রানি ও যৌন নিপীড়নের ভয়ে অভিভাবকরা সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে নিরুৎসাহিত হয়ে থাকে। মেয়ে ও প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য উপযুক্ত পয়ঃনিষ্কাশন, অবকাঠামো ও পানির ব্যবস্থা না থাকায় শ্রেণিকক্ষে মনোযোগ এবং উপস্থিতিতে প্রভাব ফেলে। ফলে অনেক সময় অভিভাবকরা বাল্য বিবাহের মতো সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।
তিনি বলেন, উল্লেখিত চ্যালেঞ্জগুলোর পাশাপাশি আরেকটি অনিবার্য চ্যালেঞ্জ আছে সেটা হল গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ। পাশের হারের চেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে শিক্ষার মানের দিকে। প্রাথমিক পর্যায়ে তাত্ত্বিক পড়ালেখার পাশাপাশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত নৈতিক শিক্ষা ও দেশ প্রেমের দিকে। মূলত এই পর্যায়ে মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন ভাল মানুষ কীভাবে হওয়া যায়, সেদিকে শিক্ষকদের গুরুত্ব দিতে হবে। আর বিদ্যালয়ের কার্যকারিতা, শিশুর উপযুক্ত শিক্ষণপদ্ধতি ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের বিষয়গুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা উচিত। এছাড়া আমাদের দরকার বিবেচনাবোধ সম্পন্ন একটি সচেতন নাগরিক সমাজ। যারা ঢালাওভাবে শুধু সিস্টেমের দোষারোপ করবে না, সমাজের বিভিন্ন সমস্যা মোকাবেলার মাধ্যমে একটি সুন্দর জাতি গঠনে নিজেরাও এগিয়ে আসবে।
জেলা প্রশাসক বলেন, শিক্ষাখাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করে একটি শিক্ষিত ও উন্নত জাতি গঠনের লক্ষ্যে, সর্বোপরি রূপকল্প ২০২১, ২০৪১ ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাকে বিবেচনায় নিয়ে সরকার যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, সেক্ষেত্রে উল্লেখিত চ্যালেঞ্জগুলো অবশ্যই মোকাবেলা করতে হবে। তবেই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দক্ষ মানবসম্পদরূপে পরিণত হয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন ও গতিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে।