চট্টগ্রামের নৃতত্ব ঃ প্রসঙ্গ চট্টগ্রামের আদি অধিবাসি

272

প্রাচীন অনেক জনপদ যখন বঙ্গোপসাগরের অতল জলে নিমজ্জিত তখনো চট্টগ্রামের অস্তিত্ব ছিল। পাহাড়, সমুদ্র, নদ-নদীবেষ্টিত রূপময়ী চট্টগ্রাম আর এর কোল ঘেঁষে গড়ে উঠা প্রাকৃতিক বন্দর চিরকাল ভ্রমণ পিপাসু পর্যটক, পীর-সন্যাসী ও রাজা রাজড়াদের নানাভাবে আকর্ষণ করেছিল। চট্টগ্রাম নিয়ে শাসকেদের মধ্যে যুগে যুগে লড়াই সংঘর্ষ লেগেই ছিল। এটি কখনো আরাকানি মগ, কখনো ত্রিপুরারাজ, কখনো পর্তূগিজ হার্মাদ, কিংবা বর্মিরাজ, কখনো বা পাঠান, মোঘল, ইংরেজ শাসনের অধীনে ছিল। নানা কালপর্বে ঘাত-সংঘাত, নানা প্রাকৃতিক দূর্যোগ, ভূমিকম্প, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, প্লাবন, মহামারী চট্টগ্রামের আকর্ষন কমাতে পারেনি। ইতিহাসের কালপর্বে নানা রাজ্যের নানা জাতিগোষ্ঠীর আগমনে নানা ভাষা, কৃষ্টি-সভ্যতা ও জনগোষ্ঠির সংমিশ্রণে রূপে ও প্রাণে চট্টগ্রাম বৈচিত্রময় হয়ে উঠে।
এসব বসতি স্থাপনকারি, তীর্থযাত্রী ও ভূ-পর্যটকরা চট্টগ্রামকে তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী থেকে নানা নামে নামকরণ করেছিল। দু’হাজার বছর আগে করা গ্রীক জ্যোতির্বিদ ও ভূগোলিক টেেলমির মানচিত্রে চট্টগ্রামকে ‘পেন্টাপোলিস’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর্যদের কাছে চট্টগ্রাম হল ‘সুক্ষদেশ’ আর পালিগ্রন্থে এর নাম ‘রম্ভূ বা ‘রম্যভূমি’, তন্ত্র ও পুরানে এর নাম ‘চট্টল’। বৌদ্ধ চৈত্যের প্রাচুর্যের কারণে একে ‘চৈত্যগ্রাম’ বলা হত ৭ম শতকের চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং একে ‘শ্রীচটলো’ বলে উল্লেখ করেছেন। পুরাতন সপ্তগ্রাম বা সাতগাঁও থেকে বহুলোক এখানে বসতি করে এর নাম সপ্তগ্রাম বা সাতগাঁও রেখেছিল বলে অনেকে ধারণা করে থাকেন। বর্মীভাষায় এর নাম ‘চিতাগাঁও’ বা ’চিৎগাঁও’ যা ‘চিৎ তোৎ গাং’ শব্দ জাত যার অর্থ ‘আর যুদ্ধ নয়’। হিন্দু সাধু-সন্যাসীরা একে ‘চন্দ্রনাথ’ বলে চিনতেন। আদিকালে সীতাকুন্ড চন্দ্রনাথে যাতায়াতকারী ব্রাহ্মণগণ একে সীতার গাঙ্গ?‘সীতাগাঙ্গ’ বলতেন। আরব ভৌগলিক ইদ্রিসী চট্টগ্রামকে ‘কর্ণবুল’ বলে উল্লেখ করেছেন। ত্রয়োদশ শতকের পর্যটক ইবনে বতুতার ভ্রমণ কাহিনীতে এদেশ ‘সতের কাউন’ নামে উল্লেখ রয়েছে। ইতিহাসবিদ হামিদুল্লাহ খাঁ তাঁর ‘তারিখে হামিদী’ গ্রন্থে – বদর পীরের চাটি থেকে ‘ ‘চাটগাঁ’ শব্দের উৎপত্তি’ জনশ্রুতির উল্লেখ করেন। প্রাচীন আরাকানের গুরুত্বপূর্ণ নগর হিসেবে একে ‘রোসাংগ পূরীও‘ বলা হত। পর্তূগীজরা এর নাম দিয়েছিল ‘পোর্টোগ্রান্দো’ (Porto Grando> Grand Port) চট্টগ্রাম বন্দরকে তাঁরা প্রধান বন্দর বলে উল্লেখ করত; সাতগাঁওয়ে তাদের দখলে আরেকটি পোর্ট ছিল। সুলতানী আমলে নসরত শাহ (১৫১৯-১৫৩২) এর নাম দিয়েছিলেন ‘ফতেয়াবাদ’। আওরঙ্গজেবের সময় (১৬৬৬) এটি ‘ইসলামাবাদ’ নামে পরিচিত ছিল। কেউ কেউ একে মগরাজ্যও বলে থাকেন। ইংরেজের উচ্চারণে চট্টগ্রাম হয়ে যায় ‘চিটাগাং’। মুসলিম ভক্তিবাদীরা একে ‘বারো আউলিয়ার দেশ’ বলে থাকেন।
কেবল চট্টগ্রাম নয় বাংলাদেশের আদি অধিবাসি কারা – তার সঠিক নির্ণয় অদ্যবধি হয়নি। রামায়নের সময় বঙ্গদেশের পুরো অঞ্চলটি জনপদহীন বিরান ভূমি এবং বঙ্গোপসাগরকে পূর্ব সাগর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও একই সময়ে বঙ্গের আশে পাশে কিরাত, বিদেহ, অঙ্গ, পুন্ড্র, প্রভৃতি জনপদের চিহ্ন পাওয়া যায় (কমলেশ দাশগুপ্ত, প্রাচীন চট্টগ্রাম ও সেকালের হিন্দু সমাজ, অক্টো:২০১৮, পৃ-৪)। চট্টগ্রামের আদিম জনগোষ্ঠী নিয়ে নানা নৃতাত্তি¡ক ব্যাখ্যা রয়েছে। ই. ই. পারজিটার বলেন, ‘প্রাচীন বঙ্গভূমি বহু নদনদীর মোহনায় জেগে উঠা দ্বীপ সমষ্টিই ছিল। চলাফেরার একমাত্র বাহন ছিল নৌকা। কিন্তু চট্টগ্রামের আদি জনপদ গড়ে উঠেছিল পৃথিবীর আদিমতম অধিবাসীদের দ্বারা। তারা পায়ে হেঁটেই চট্টগ্রাম এসেছিল।’ (Ancient counties in eastern India, 1897, Journal of Asiatic Society.) যদি এসব প্রাচীন জনগোষ্ঠী হেঁটেই এসে থাকে তাহলে কোন পথ দিয়ে এসেছিল? আর এসব জনগোষ্ঠী কারা?

গঙ্গা যেখানে সমুদ্রে পতিত হয়েছে তার মোহনায় ‘গঙ্গারিডাই’ নামে এক সমৃদ্ধ নগরের কথা মেগাস্থিনিস প্রায় দু’হাজার বছর পূর্বে বলে গেছেন। এর তিন’শ বছর পর টলেমীর মানচিত্র ও ‘দি পেরিপ্লাস অব ইরাত্রিয়ান সি’ নামক ভ্রমণ গ্রন্থের বিবরণী মিলিয়ে সেই গঙ্গারিডাই ও এর দক্ষিণে ‘পেন্টাপোলিস’(চট্টগ্রাম) নগরের অস্তিত্ব দেখা যায়; যার উত্তরে ‘কিরাডিয়া’ নামে একটি রাজ্যের অস্তিত্বও রয়েছে। সেই কিরাডিয়া রাজ্যটি হলো ‘কিরাত’ রাজ্য যার বর্তমান নাম ত্রিপুরা। এই ত্রিপুরার আদিম জনগোষ্ঠী ছিল ‘কিরাতিরা’। ত্রিপুরার ‘রাজমালা’ অনুসারে প্রাচীনকালে অসভ্য বর্বর বলে পরিচিত কিরাত জাতিকে উচ্ছেদ করে ত্রিপুরায় রাজবংশের রাজত্ব শুরু হয়েছিল। আর উচ্ছেদকৃত এসব জনগোষ্ঠী দক্ষিণের পেন্টাপোলিস বা বর্তমান চট্টগ্রামে পালিয়ে বসতি স্থাপন করে। সুতরাং কিরাতিরাই চট্টগ্রামের আদি অধিবাসি বলে এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ধারণা করা যায়। সুতরাং আর্যীকরণের পূর্বে চাটগাঁ’র আদি অধিবাসি ছিল কিরাতিরা। এ জাতি পূর্বে ব্রহ্মরাজ্য, পশ্চিমে ত্রিপুরা ও চট্টগ্রাম এবং উত্তরে প্রাচীন কাছাড় ও সিতাই ভূমি, দক্ষিণে অরাকান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। লুইস বলেন, “They differ entirely from the other hill tribes of Burma or Arakanese origine, in that their face bear no marks of Tatar or Mongolian descent.” (Hill Tracts of Chittagong, : 9)
পন্ডিতরা এও বলেন যে, চট্টগ্রামে অষ্ট্রিক ও মঙ্গোলয়েড গোত্রদের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বতীর ধরে প্রাগজ্যোতিষপুর (আসাম), কাছাড় হয়ে সিলেটের দক্ষিণমূখী সীমানার বাঁকা পাহাড় সমষ্টির দূর্গম পথ দিয়ে। এখানে আর্যরা না এলেও আর্য সংস্কৃতি ও ভাষার প্রভাবে চট্টগ্রামে আর্যায়ন ঘটেছে। খ্রিষ্টীয় নবম শতাব্দী থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত হিন্দু ও বৌদ্ধ অধ্যুষিত চট্টগ্রামে কান্তি দেব ও দামোদর দেবের যে দুটি তাম্র শাসন লিপি পাওয়া যায় তার ভাষা সংস্কৃত প্রভাবিত। উত্তর দিকে গাঙ্গেয় অঞ্চলের আর্য ভাষা সংস্কৃতি চট্টগ্রামকে প্রভাবিত করেছিল। পারজিটার বলেন,
Anga, Vanga, Kolinga, Pundra and Suhma with Tamralipta and Odra kinder nations which were no Ariyan stack and were not subjected by the Aryas, but passed under Aryan influenced and became Arynized. (Ibid).
বৈদিক যুগের মানচিত্রে বঙ্গ থাকলেও সেখানে চট্টগ্রাম নেই। মহাভারত, রামায়ন যুগেও বঙ্গ লোকালয় শূন্য জনপদ আর চট্টগ্রামের অস্তিত্বও ছিল না। পুরানে বঙ্গ, পুন্ড্র, পুন্ড্রবর্ধন ও গৌড়ের উল্লেখ থাকলেও চট্টগ্রামের উল্লেখ নেই। তাহলে রামের সীতাকুন্ড পাহাড়ে আসা, আদিনাথ পাহাড়ে রাবনের অবস্থানের বিষয়টি কল্পকাহিনী মাত্র। বঙ্গের এ দক্ষিণাঞ্চল প্রাকৃতিক বিপর্যয় সংকুল এলাকা বিধায় এটি জনবিরল ছিল। বতুতা গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের সংঘম স্থল হিসেবে চট্টগ্রামকে দেখেছিলেন কিন্তু চট্টগ্রামে পৃথিবীর প্রাচীন নরগোষ্ঠীর পরিভ্রমণের অতীত ইতিহাস ও বসতির সম্ভবনার বিষয় নানা যৌক্তিক কারণে উড়িয়ে দেয়া যায় না। ত্রিপুরা, মনিপুর, কুকি এবং লুসাই পর্বতমালার সুউচ্চ ও দুর্গম পথের কারণে আদিম জনগোষ্ঠীর যোগাযোগে প্রধান অন্তরায় হলেও এসব পর্বত শ্রেণির গতিবিধির মধ্যেই ব্রহ্মপুত্র ও ইরাবতী নদীর মধ্যে প্রায় কয়েক শত মাইল দীর্ঘ ও উঁচু পর্বতশ্রেণির মাধমে জনসংযোগের আভাস পাওয়া যায় যা চট্টগ্রামের আদিম জনবসতির বসবাস ও পরিভ্রমন পথরেখার ধারণাকে দৃঢ় করে। ড. সুনতি ভূষণ কানুনগোও প্রাগৌতিহাসিক যুগে (খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ) মঙ্গোলয়ের গোষ্ঠীর চট্টগ্রামে প্রবেশের একই পথরেখা উল্লেখ করেছেন। এ প্রসঙ্গে খ. L. A. Waddell, “…a remarkable broad belt running in almost parallel lines meridionally through Tripura, Monipur and the Kuki lusai land for several hundred miles between Brahmaputra and Irawadi.” (The Tribes of the Brahmaputra Valley: A contribution on their physical types and affinities)
কোন কোন পন্ডিতের মতে, বাংলায় নেগ্রিটো, প্রোটো-অষ্ট্রোলয়েড ও মঙ্গোলয়েড গোত্রের অধিবাসিদের সংমিশ্রন অধিক ঘটেছে। নিগ্রোরা আফ্রিকা থেকে আরব-ইরান হয়ে ভারতে এসেছিল। এরপর আসে প্রোটো-অষ্ট্রোলয়েড গোত্রের পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় জনগোষ্ঠী। পরে দ্রাবিড়েরা পাক-ভারতে প্রবেশ করে। আর্য নামে অভিহিত ১ম প্রবাহে আগত আলপেনিয়রা গুজরাট, মারাটা এবং বাংলায় অধিক বসবাস করতো আর শেষ প্রবাহে আগত শর্ট হেডেড মঙ্গোলয়েডরা এসেছিল বার্মা-আরাকান হয়ে চট্টগ্রামে। আবদুল হক পন্ডিতদের উদ্ধৃত করে বলেন, “আসামের খাসি ও বার্মার মম বা তালাইং শ্রেনীর অষ্ট্রো-এশীয় জনগোষ্ঠী সম্ভবত আরাকান চট্টগ্রামের অধিবাসী” (চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতির রূপরেখা, বাংলা একাডেমি, ২০১৩: ৯)। ড. সুনতি ভূষণ কানুনগো বলেন, হুনদের আক্রমনে মঙ্গোলীয় গোত্রের বহুলোক এখানে পালিয়ে আসে-“ …some branches of mongoloid people entered Chittagong through Tripura, Lusai and Arakan hills.” (Histry of Chittagong : 1988, P-36)). এদের সাথে পরবর্তীতে মিশেছে ভোট-চীনারা। চট্টগ্রামের ভাষার উপর বিশেষভাবে ধ্বনি বিকৃতির প্রকৃতিতে ভোট-চীনা ভাষার প্রভাব লক্ষ্যনীয়। আর পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়ে এসেছে কুকী-চীনারা। চট্টগ্রামে বিদ্যমান এসব জনগোষ্ঠীর সাথে অতি প্রাচীনকালে (২২০০ খিঃ পূঃ থেকে ২০০ খিষ্ট্রাব্দ্র) হিন্দু, বৌদ্ধ ও জেন মগবাসিরাই বঙ্গে-আরাকানে- বার্মায় ধর্মপ্রচার ও উপনিবেশ স্থাপন করতে আসে (এ. পি. ফায়ার, হিস্ট্রি অব বার্মা, পৃ: ৪২)। কালক্রমে এসব মগদের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মের আধিক্য ও স্থায়িত্ব ঘটে। মধ্যযুগে চট্টগ্রামে প্রায় দু’শো বছর মগ রাজত্ব বিরাজমান ছিল। মগরাজা নরমিখলা (১৪৩০-১৪৩৪) গৌড়ের সেনাবাহিনীর সাহায্যে আরাকান পূণরাধিকারকালে তাদের সাহায্যকারি বিপুল সংখ্যক চট্টগ্রামী মুসলমান আরাকানে যান। এসব মুসলমানের অনেকেই মগ রমনী বিবাহ করে সেখানে স্থিত হয়ে যান। ইতিহাসের কালপর্বে ভারতীয়দের বিশেষত চট্টগ্রামীদের ব্যবসা বাণিজ্য ও মগ রমনীর আকর্ষনে আরাকানে গিয়ে থিতু হবার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। চট্টগ্রামী মুসলমান ও আরাকানি মগ রমনীর ওরসে যে বর্ণ সংকর জনগোষ্ঠীর উদ্ভব হয় তারা ‘জেরবাদী’ নামে অভিহিত হয়ে আসছে। যুগে যুগে চট্টগ্রামের বহু পুরুষ নানা সংকট কালে মগী স্ত্রী-সন্তান নিয়ে নিজভূমি চট্টগ্রামে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। ফলে গোলাকার মুখে চ্যাপ্টা নাক, ক্ষুদ্রাকৃতির চক্ষু ও খর্বাকায় এসব মগের নৃতত্ত¡, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও ভাষা চট্টগ্রামকে দারুন প্রভাবিত করে আসছে।
আলেকজান্ডারের সময়ের পূর্ব থেকেই গ্রিক, আরব, চীনা বণিকেরা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ নিয়ে আসতো। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে আরব বণিকদের অনেকেই এখানে অবকাশ যাপন করতেন। তাঁরাই চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল আলকরণ, বাকলিয়া, সুলুপবহর, কোলাগাঁও, কাপাসগোলা, হালিশহর প্রভৃতির নামকরণ করেন। এরপর ইসলাম ধর্ম বিকাশের প্রাথমিক সময়ে আরব বণিকের সাথে ধর্ম প্রচারক, সুফি, দরবেশরাও আসা শুরু করেন। বখতেয়ার খিলজীর বঙ্গ বিজয়ের পর মুসলিম আগমনের এ ধারা প্রবল হয়ে উঠে। তাঁদের সহজ সরল জীবন যাপন স্থানীয় বর্ণ জর্জরিত হিন্দুরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে লাগলো। বহিরাগত এসব পীর-দরবেশ এবং তাদের মুরিদদের অনেকেই ধর্মান্তরিত স্থানীয় মেয়ে বিয়ে করে চট্টগ্রামেই থেকে যান। এটি প্রচলিত যে, চট্টগ্রামে বসতি স্থাপনকারি বণিক, নাবিক, ফকীর-দরবেশ এবং গৌড়ের তুর্কী -পাঠান বাদশাহের চট্টগ্রাম শাসনকালে গৌড়াগত মুসলমানদের সাথে স্থানীয় নিম্নবর্ণের হিন্দু-বৌদ্ধদের সংমিশ্রণে এবং ধর্মান্তরের ফলে চট্টগ্রামে মুসলিম সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। সেন আমলে ও পরবর্তীতে বখতেয়ারের হামলায় নালান্দা বিহার ধ্বংসের ফলে বিতাড়িত বৌদ্ধ পন্ডিত, ভিক্ষু নেপাল, দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণে আরাকান অবধি ছড়িয়ে পড়ে। তারাই পরবর্তীতে চট্টগ্রামে পন্ডিত বিহার প্রতিষ্ঠা করেন। রাঢ় ও বরেন্দ্রের হিন্দুদের চট্টগ্রামে আগমনের সূচনা বল্লাল সেনের সময়ে (১১৫৯-১৫৭৯)। প্রথম কুলীন হিন্দুরা চট্টগ্রাম আসেন ১২৭৭-৮২ সালে। তাছাড়া পঞ্চদশ শতাব্দীতে চট্টগ্রামে মোগল শাসকের অধীনে রাজস্ব সংগ্রহ, আবাদ ও ভূমি সংস্কারের দায়িত্ব নিয়ে রাঢ়বঙ্গ থেকে হিন্দু জনগোষ্ঠীর আগমন ঘটে। মোগল প্রশাসনে এসব চাকুরিজীবী, ভূমধ্যকারী হিসেবে চট্টগ্রামের গ্রামভিত্তিক জনপরিবেশ উন্নয়নে, নতুন জমির আবাদে, উৎপাদন ও শ্রম সংযোগের নতুন ক্ষেত্র তৈরীতে, পেশাভিত্তিক জনবসতি গড়ে তুলতে, শিক্ষা সংস্কৃতি ও ধর্মচর্চাসহ সার্বিক বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ষোল-সতের শতকে পর্তূগীজদের ঔরসে নি¤œ বর্ণের হিন্দু-বৌদ্ধ রমনীদের গর্ভে চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র মেটে ফিরিঙ্গী সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়।
চট্টগ্রাম বহু বৈচিত্র্যপূর্ণ জনগোষ্ঠির সংমিশ্রনে গঠিত এক অনন্য নৃতাত্তি¡ক একক জাতিগোষ্ঠি। এর ভাষা বাংলা কিন্তু উচ্চারণ ঢং স্বতঃস্ফূর্ত ও ঋজু যা বাংলা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আর এ ভিন্নতা চট্টগ্রামকে বাংলায় স্বতন্ত্র রূপ দান করেছে। মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান এ চার প্রধান ধর্মের জনগোষ্ঠির দীর্ঘকাল ব্যাপি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বাংলায় আর কোথাও দেখা যায়না। চট্টগ্রামী মানুষের চারিত্রিক মগী সরলতা ও দৃঢ়তার ডিলেমা, ধর্মাচারে আরব-তুর্কি-ইরানী মুসলমানের গভীর নিষ্ঠা আর হাজার বছরের বাঙ্গালি সংস্কৃতি চর্চার সাথে পাহাড়-পর্বত ও নদী-সমুদ্র ঘেরা অপরূপ ভূগোল একে স্বর্গময় করে তুলেছে।