চট্টগ্রামের চলমান উন্নয়ন প্রকল্প : একটি পর্যালোচনা

109

 

দেশের অর্থনীতিতে বানিজ্যিক রাজধানী খ্যাত চট্টগ্রামের অবদান অনস্বীকার্য। চট্টগ্রাম বন্দরকে দেশের লাইফলাইন বলা হয়। আমদানি রফতানির সিংহভাগ সম্পন্ন হয় চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারও চট্টগ্রামের সাথেই সম্পৃক্ত। চট্টগ্রামের উন্নয়ন মানেই দেশের উন্নয়ন। কয়েকমাস আগে এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি বদলে গেলে তার প্রাণশক্তি হবে চট্টগ্রাম। এটা আমাদের বাণিজ্য নগরী। এক সময় অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় ছিল চট্টগ্রামে, কিন্তু ৭৫ পরবর্তী সরকার গুলো এসব প্রধান কার্যালয় ঢাকায় নিয়ে এসেছে। যার কারণে চট্টগ্রাম অনেকটা অবহেলিত থেকে যায়। কিন্তু আওয়ামী লীগ যখন আবার সরকার গঠন করে তখন থেকে চট্টগ্রাম প্রাণ ফিরে পায়।’ গত ১৬ মার্চ চট্টগ্রাম ওয়াসার শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার প্রকল্প-২ উদ্বোধন কালে বক্তৃতায় তিনি পুনরায় চট্টগ্রামের উন্নয়নের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উদ্বোধনি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, চট্টগ্রামে শিল্পায়ন হচ্ছে, খেয়াল রাখতে হবে এতে করে কর্ণফুলী, হালদা, সাঙ্গুসহ চট্টগ্রামে যে কয়টা নদী আছে, নদীগুলো যাতে দূষণ না হয়। দূষণের হাত থেকে এসব নদীকে রক্ষা করতে হবে’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কর্ণফুলীর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। প্রত্যেকটা শিল্প প্রতিষ্ঠানকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্ল্যান্ট করতে হবে। চট্টগ্রামের উন্নয়ন সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ কথা যে অসত্য নয়, তা চট্টগ্রামের উন্নয়নে জন্য বিগত কয়েকবছরে গৃহীত(বাস্তবায়িত ও বাস্তবায়নাধিন) অন্তত ১৫টি মেগা প্রকল্পের কথা উল্লেখ করলে বুঝা যাবে। এবং এটাও বুঝা যাবে যে, সরকার চট্টগ্রামের উন্নয়নের প্রতি সত্যিকার অর্থেই আন্তরিক।
সিডিএ, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম বন্দর, ওয়াসা, সওজ, রেলওয়ে ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মাধ্যমে এসব প্রকল্পে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকার অধিক ব্যয় হবে। প্রকল্প গুলো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতা যেমন দূর হবে, তেমনি যোগাযোগ ব্যবস্থাও আমূল পাল্টে যাবে এবং এর মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামের সত্যিকারের বাণিজ্যিক রাজধানী হওয়ার পথের অবকাঠামোগত সংকট অনেকটা দূর হবে। সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থান। মেগা প্রকল্প গুলোর মধ্যে কয়েকটি প্রকল্পের কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। সমাপ্ত হওয়া প্রকল্প গুলোর অন্যতম হলো- ৩২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ডিটি রোড(ফৌজদার হাট)-বায়েজিদ সংযোগ সড়ক, ৬৯৬ কোটি টাকা ব্যয়ে মুরাদপুর- লালখান বাজার আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভার, কদমতলি ফ্লাইওভার, অক্সিজেন- কুয়াইশ সংযোগ সড়ক’। শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার-১ এবং শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার প্রকল্প-২ (যা গত ১৬,মার্চ’২২ তারিখে উদ্বোধন করা হয়েছে)। জাইকা, বাংলাদেশ সরকার ও চট্টগ্রাম ওয়াসার যৌথ অর্থায়নে এই প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৪ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে চট্টগ্রাম ওয়াসাতে দৈনিক পানির উৎপাদন সক্ষমতা ৩৬ কোটি লিটার থেকে ৫০ কোটি লিটারে উন্নীত হয়েছে।
নির্মাণাধীন প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে-১৮ হাজার কোটি টাকায় দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার-গুনদুম রেললাইন স্থাপন প্রকল্প’। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নয় হাজার আটশত আশি কোটি চল্লিশ লক্ষ টাকা ব্যয়ে দেশের প্রথম টানেল ‘বঙ্গবন্ধু টানেল’, যার মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের অর্থ সহায়তা তিন হাজার নয়শত সাতষট্টি কোটি একুশ লক্ষ টাকা এবং চীন সরকারের অর্থ সহায়তা পাঁচ হাজার নয়শত তের কোটি ঊনিশ লক্ষ টাকা (এই টানেলের কাজ ২০২৩ সনে শেষ হবে)। ২৮০ কোটি টাকায় নদীতীর সংরক্ষণ প্রকল্প। সড়ক ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা সংস্কারে ৭১৬ কোটি টাকার প্রকল্প। এবং লালখানবাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ১৮ কিমি দীর্ঘ ফ্লাইওভার। শহর রক্ষা, শিল্পায়ন, আবাসন ও পর্যটনের প্রেক্ষাপাটে গুরুত্বপূর্ণ ও সবচেয়ে বড় প্রকল্প আউটার রিং-রোড প্রকল্প (১৭শ’ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষ মেগা প্রকল্পটিতে জাপানের জাইকা ৭শ’ ৫২ কোটি টাকা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ৮২ কোটি টাকা এবং সরকারের তরফ থেকে ৮শ’ ৬৬ কোটি টাকা অর্থায়ন করা হচ্ছে), হালিশহর আনন্দবাজার থেকে দক্ষিণ কাট্টলী রাসমনিঘাট পর্যন্ত সাগরের বুকে জেগে ওঠা ভূমিতে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নির্মাণ করবে ‘বে-টার্মিনাল’। গত বছর অনুমোদন চূড়ান্ত হওয়া এ প্রকল্পের জন্য এখন ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হবে। এদিকে কর্ণফুলীর তীর ঘেঁষে ‘চাক্তাই থেকে কালুরঘাট’ পর্যন্ত ২১২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রায় আট কিলোমিটার দীর্ঘ চার লেনের এই সড়কের ( সøুইসগেটসহ) ৫০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। সম্পূর্ণ শেষ হতে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
ইহাব্যতিত শিল্পায়ন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ সৃষ্টির জন্য আনোয়ারার গহিরা এলাকায় ৭৭৪ একর জমি নিয়ে বিশেষ অর্থনৈতিক জোন করতে ব্যয় করা হবে ১৬ হাজার কোটি টাকা। ইতোমধ্যে মিরসরাইয়ের অর্থনৈতিক অঞ্চলেরও মূল কাজ শুরু হয়েছে । এতে পানি উন্নয়ন বোর্ড ব্যয় করছে প্রায় এক হাজার ১০০ কোটি টাকা। এ দুটি অর্থনৈতিক জোন হলে স্থাপিত হবে পাঁচ শতাধিক শিল্পকারখানা। হবে লক্ষাধিক লোকের কর্মসংস্থান। সরকারি এসব প্রকল্পের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগে এ বছরই বাঁশখালীতে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু করছে এস আলম গ্রæপ ও চীনের শেনডম ইলেকট্রিক পাওয়ার কনস্ট্রাকশন (সেপকো)। যাতে ব্যয় হবে ২০ হাজার কোটি টাকা। ৪০০ কোটি টাকায় প্রোটন গাড়ির কারখানা স্থাপনের কাজও শুরু হবে এবছরই। চট্টগ্রাম নগরীর অন্যতম সমস্যা জলাবদ্ধতা। প্রতিবছর বর্ষায় নগরী বিস্তীর্ণ এলাকা জলাবদ্ধতায় আক্রান্ত হয়। ক্ষতি হয় শতকোটি টাকার পণ্য সামগ্রী। এই সমস্যা নিরসনের থেকে স্থায়ী ভাবে পরিত্রাণের লক্ষ্যে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) তত্ত¡াবধানে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প’। ২০১৭ সালের শুরু করা এ প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ হলে জলাবদ্ধতা নিরসন হবে। নগরীকে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে চলতি বছর ‘পাউবো’ সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার কাজ শুরু করবে বলেও জানা গেছে। জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য বহুল প্রতিক্ষিত বহদ্দারহাট বারইপাড়া-বলিরহাট নতুন খাল’ সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক চারগুণ ব্যয় বাড়িয়ে দ্বিতীয়বার উদ্বোধন হলো গত মার্চ মাসে। ২.৯ কিমি দৈর্ঘ্যের এই খালটি খননের জন্য ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রথমে প্রস্তাব করেছিল। তার প্রায় দুই দশক পর ২০১৪ সনে সিটি কর্পোরেশনের প্রস্তাবটি ‘একনেক’ সভায় অনুমোদন পায়। তখন ৩২৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকা অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। কিন্তু যথাসময়ে সরকারি অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় এবং জমি অধিগ্রহণ নিয়ে জটিলতায় প্রথম মেয়াদে প্রকল্পের কোনো কাজই করতে পারেনি সিটি করপোরেশন। এরপর ২০১৭ সনের নভেম্বরে একনেকে প্রকল্পটি পুনর্বিবেচনা করে আবারও অনুমোদন দেয়। তখন ব্যয় বেড়ে হয় ১ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা। সবশেষ গত বছরের জুনে প্রকল্পটি আবারও সংশোধন করা হয়। তাতে ব্যয় বেড়ে হয় ১ হাজার ৩ শত ৭৪ কোটি টাকা। ‘চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই খাল খননে এত দীর্ঘসূত্রতা চট্টগ্রামবাসিকে হতাশ করেছিল’। খাল খনন শুরু না হওয়ায় গত ১২ মে তারিখে চট্টগ্রামে সিনিয়র সরকারি কর্মকর্তাদের সভায় ‘প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব ড. আহমদ কাইকাউস’ ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি দ্রæত খাল খনন শুরু করার নির্দেশনা দেন। চট্টগ্রামবাসির প্রত্যাশা, এবার নিশ্চয় খাল খনন প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীও এবার দ্রুত খাল খননের কাজ শুরু করার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। চট্টগ্রামের চলমান এতগুলো বড় প্রকল্প ও বিশাল বাজেট সম্পর্কে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি অধ্যাপক সিকান্দার খান বলেন, ‘চট্টগ্রামকে সত্যিকারের বাণিজ্যিক রাজধানী করতে হলে পরিকল্পিত উন্নয়নের বিকল্প নেই’। আমরাও মনে করি, সরকারি সেবা সংস্থা গুলোর মধ্যে সমন্বয় করে স্বচ্ছতা ও দুর্নীতিমুক্ত ভাবে উন্নয়ন প্রকল্প গুলো বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। একটু পেছনে গেলে দেখা যাবে যে, মূলত ২০২০ সনে শেখ হাসিনার এক সিদ্ধান্তে চট্টগ্রামের রাজনীতিতে ব্যপক পরিবর্তন আসে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম চৌধুরী’ নামের যাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল, তিনি আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত ত্যাগী নেতা। ক্লিন ইমেজের এই নেতা প্রয়াত চট্টলবীর এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ অনুসারী হিসাবে পরিচিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের সিনিয়র নেতাদের সাথে আলাপ করে অনেক বিকল্প হতে রেজাউল করিম চৌধুরীকেই প্রার্থী হিসাবে বেছে নেন। যা চট্টগ্রামের উন্নয়নের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব আনবে বলেই অনেকে মনে করেন।
চট্টগ্রামের চলমান উন্নয়ন প্রকল্প গুলো যথা সময়ে শেষ হলে চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি হবে এবং ও জলবদ্ধতা নিরসন হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন সিটি করপোরেশনের বর্তমান মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী। চট্টগ্রামবাসি মনে করেন, চট্টগ্রামের উন্নয়ন মানে-দেশের উন্নয়ন। তাই উন্নয়নের ব্যাপারে সর্বাগ্রে চট্টগ্রামকেই গুরুত্ব দিতে হবে। চট্টগ্রাম বন্দরের রাজস্ব দিয়ে দেশের সিংহভাগ ব্যয় নির্বাহ সম্ভব হবে। চট্টগ্রামের চলমান উন্নয়ন প্রকল্প গুলো যেনো যথাসময়ে শেষ হয় সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক বিপর্যয়, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ইত্যাদি বিষয় মাথায় রেখে উন্নয়ন প্রকল্প গুলো বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করতে হবে।

লেখক : কলামিস্ট ও সমাজকর্মী