ঘরে চুরির শঙ্কায় আশ্রয়কেন্দ্রে যায় না মানুষ

28

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ বাংলাদেশ-ভারত উপকূলের দিকে ক্রমশ ধেয়ে আসছে। খুলনা, বরিশালে ১০ নম্বর ও চট্টগ্রামে ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হলেও পতেঙ্গা সমুদ্রের পার্শ্ববতী মানুষদের সরানো যাচ্ছে না। তারা বলছেন, ‘কত ঘূর্ণিঝড় এলো গেলো আমাদের কিছুই হবে না’। আর আমরা আশ্রয়কেন্দ্রে গেলে ঘর পাহারা দিবে কে? মূল্যবান জিনিসপত্রের দায়িত্ব কে নিবে ? অথচ ১৯৯১ সালে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘ম্যারি এন’ যখন আঘাত হানে তখনও মানুষ চুরির ভয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে চাননি।
এদিকে জেলা প্রশাসন ও সিটি কর্পোরেশন থেকে মাইকে ‘বুলবুলের’ ভয়াবহতার কথা বলে মাইকিং করা হলেও সাড়া নেই উপকূলবাসীর। তেমনি মতিঝর্ণা, বাটালি হিল এলাকায়ও একই অবস্থা। পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থানরত কেউ ঘর ছাড়া হতে চাচ্ছে না। তাদের জোর করে বাসা বাড়ি থেকে বের করতে হচ্ছে বলে জানান সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুস সামাদ শিকদার। তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে সবাইকে বুঝিয়ে ঘর থেকে বের করতে হচ্ছে। আবার অনেককে ধমকও দিচ্ছি।
উপকূল এলাকায় গতকাল বিকালে দেখা যায়, পতেঙ্গা থানাধীন খেজুর তলা, মুসলিমাবাদ বেড়িবাঁধ, চরপাড়া, লিংকরোডের কিছু অংশে কয়েকহাজার পরিবারের বসতি। এ এলাকার বাসিন্দারা নিজ থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে যাচ্ছেন না। এমনকি জোর করেও তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া যাচ্ছে না। তবে উপকূলবাসীর কথা হচ্ছে, অতীতে আমাদের এখানে কিছু হয়নি বরং আমরা আমাদের ঘর ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে গেলে ঘর চুরির আশঙ্কা বেড়ে যায়।
বয়োবৃদ্ধা কুলছুমা বানু বলেন, কত ঝড় এলো গেলো সামান্য ঝড় বৃষ্টি ছাড়া তেমন বড় ক্ষতি হবে না। আবুল ফয়েজ বলেন, আমাদেরকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে গেলে বাড়িঘর দেখবে কে? আমাদের টাকা-পয়সাসহ নানা জিনিসপত্র ফেলে চলে যাবো, এতে অন্যরা সুযোগ নিবে।
আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার (ভূমি) এসহান মুরাদ গতকাল বলেন, নগরীতে আমাদের ৭২টির মতো আশ্রয়কেন্দ্র আছে। বেড়িবাঁধ সংলগ্ন অন্যান্য এলাকার বাসিন্দাদের সরিয়ে আনতে আমরা সর্বাত্মক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু তারা কেউ আশ্রয়কেন্দ্রে আসছেন না। আমি বর্তমানে টাইগারপাস পাহাড়ের পাদদেশ অবস্থানরতদের উচ্ছেদে এসেছি। তারপর পতেঙ্গা যাবো। ট্যুরিস্ট পুলিশ, সিটি করপোরেশনের লোকজনও আমাদের সাথে প্রচারণা চালাচ্ছেন।
৪০নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর জয়নাল আবেদিন বলেন, আমাদের ৯টি আশ্রয় কেন্দ্র আছে। তারমধ্যে একটি মেইন শেল্টার করা হয়েছে পতেঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখানে বিকেলের দিকে ৭০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধা আসলেও আর কেউ আসেননি। রাত সাড়ে আটটার দিকেও কেউ না আসায়, তাকে উল্টো গাড়ি ভাড়া দিয়ে বাসায় পৌঁছে দিতে হয়েছে। উপকূলে বসবাসরতদের বলেও আমরা আশ্রয়কেন্দ্রে আনতে পারছি না। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, যখন বাতাসের বেগ বৃদ্ধি পেতে শুরু করে, তখন তারা (উপকূলবাসী) সরে যেতে তাড়াহুড়ো শুরু করেন।
তিনি আরও বলেন, ইপিজেডের পশ্চিম দিকে বেড়িবাঁধের বাইরের যারা বসবাস করছে, তাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বেশি। কারণ সেখানে জলোচ্ছ্বাস হলেই পানিতে ডুবে যাবে ঘরবাড়ি। এ ব্যাপারে আমি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে জানিয়েছি।
চাঁন্দগাও ভূমি সার্কেল এর সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফোরকান এলাহী অনুপম জানান, চান্দগাঁও সার্কেলের আওতাধীন বিহার পাহাড় সংলগ্ন পাদদেশ থেকে প্রায় ৭০টি পরিবারকে রৌফাবাদ আদর্শ বিদ্যালয়ে নিরাপদে নিয়ে আনা হয়েছে। এছাড়া জেলা প্রশাসনের মাইকিংয়ের পর বিভিন্ন স্থান থেকে আরও অনেক পরিবার নিকটবর্তী স্থানে আত্মীয়-স্বজনের বাসায় নিরাপদে সরে গিয়েছেন বলে জানান তিনি। মহানগরীর এলাকায় আমিন জুুটমিল সংলগ্ন আল হেরা ইসলামিয়া মাদ্রাসাকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে এবং সেখানেও প্রায় ১০০ পরিবারকে নিরাপদে সরিয়ে আনা হয়েছে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, উপকূলবর্তী উপজেলাসহ মহানগরের ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা থেকে সারাদিনে প্রায় ৫০ হাজার মানুষকে সরিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে মাইকিং অব্যাহত রয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ইউএনও, এসিল্যান্ড ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের তত্ত্বাবধানে খাবারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। পতেঙ্গা সি-বিচসহ আশপাশের এলাকা থেকে ভাসমান দোকানগুলো তুলে দিয়ে সকল লোকজনকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া জেলায় সর্বমোট ৪৭৯টি আশ্রয়কেন্দ্রসহ চার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রস্তুত রাখা হয়েছে। উপজেলাসহ জেলার সকল সরকারি অফিস সারাদিন খোলা রেখে ঘূর্ণিঝড় পরিস্থিতি মনিটরিং করা হয়েছে। কন্ট্রোল রুম থেকে সার্বক্ষণিক জরুরি তথ্য সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে।
জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তানভীর ফরহাদ শামীম জানান, ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় নগদ টাকা, জি.আর চাল, শুকনো খাবার, ঢেউটিন ও তাঁবু প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তাছাড়া ২৯০টি মেডিকেল টিম, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, ফায়ার সার্ভিস, বিএনসিসি, স্কাউট, স্বেচ্ছাসেবক টিমসহ সকল সহযোগী সংস্থা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পুলিশ, নৌ পুলিশ, কোস্টগার্ড ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে এবং তারা প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন।
জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন পূর্বদেশকে জানান, ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ এর কারণে উপকূলবর্তী উপজেলাসহ নগরের ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা থেকে সারাদিনে প্রায় ৫০ হাজার মানুষকে সরিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে মাইকিং অব্যাহত রয়েছে।
তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী আমরা সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি। চট্টগ্রামে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের ৪৭৯টি আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়াও ২ হাজার ২৬৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ১ হাজার ২৫০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। সম্ভাব্য দুর্যোগে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অধিদফতরের বরাদ্দকৃত ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা জিআর ক্যাশ, ৩৪৯ মেট্রিক টন জিআর চাল, ৬৮১ বান্ডিল ঢেউটিন, দুই হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার এবং ৫০০ তাঁবু প্রস্তুত রাখা হয়েছে।