ঘটনাবহুল মার্চ এবং প্রধানমন্ত্রীর আহবান

64

মার্চ মাস আমাদের জাতীয় জীবনে অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। এই মাসের সঙ্গে যেমনটি জড়িয়ে আছে আনন্দ খুশির বাঁধ ভাঙা অনুভূতি তেমনি আছে হৃদয়ে নিরন্তর রক্তক্ষরণের স্মৃতি। এই মাসের ৭ তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিয়েছিলেন এক ঐতিহাসিক ভাষণ, যে ভাষণ এখন বিশ্ব প্রামাণ্য দলিলের একটি অংশ। যে ভাষণ যুগে যুগে বিশ্বের নির্যাতিত অধিকারবঞ্চিত, স্বাধীকারকামী মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। যে ভাষণের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি চরণ অকূল সমুদ্রে বাতিঘরের মতো পথ দেখাবে পথহারা, দিশাহারা মানুষকে। এই মাসের ১৭ তারিখ জন্মগ্রহণ করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যে মানুষটির জন্ম না হলে বাঙালি জাতি কখনো তার আত্মপরিচয় খুঁজে পেতো না। স্বপ্ন দেখারও সুযোগ হতো না পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নতুন দেশের। পেতাম না বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের হৃদয়ছোঁয়া সঙ্গীত —আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। এই মাসের ২৬ তারিখ বাঙালির পরম আনন্দের দিন- স্বাধীনতার দিন। সর্বোপরি ২০২০ সালের ১৭ মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী। তাই এ বছরটি পালিত হচ্ছে মুজিব বর্ষ হিসেবে। নানা ঘটনার স্বাক্ষী এই মাসটিতে নতুন করে সংঘটিত হয়েছে এমন একটি ঘটনা যা শুধু বাংলাদেশের মানুষকে নয় বিশ্বের প্রতিটি দেশকে ফেলে দিয়েছে ভয়ংকর আতংকের মধ্যে। প্রতিটি মুহূর্তে যেন আমরা শুনতে পাচ্ছি মৃত্যুর পদধ্বনি। যে পদধ্বনি আমরা একবার শুনতে পেয়েছিলাম ১৯৭১ সালের একই দিনে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর। উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীকারকামী বীর বাঙালিকে নির্মূল করা, বীর বাঙালির স্বাধীনতার অদম্য স্পৃহাকে যেভাবে হোক নিভিয়ে দেওয়া। এজন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান একটি নীল নকশা প্রণয়ন করেছিলেন, যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’। এ অপারেশন সার্চলাইটের স্বরূপ উন্মোচন করতে গিয়ে জনপ্রিয় লেখক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল তাঁর ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ গ্রন্হে লিখেছেন, ‘ গণহত্যার জন্য জেনারেল ইয়াহিয়া ২৫ মার্চ তারিখটা বেছে নিয়েছিল কারণ সে বিশ্বাস করত এটা তার জন্য শুভদিন। দুই বছর আগে এই দিনে সে আইয়ুব খানের কাছ থেকে ক্ষমতা পেয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়েছিল। ২৫শে মার্চ রাতে বাংলাদেশের ইতিহাসে নিষ্ঠুরতম গণহত্যার আদেশ দিয়ে সে সন্ধ্যাবেলা পশ্চিম পাকিস্তানে যাত্রা শুরু করে দিলো। জেনারেল ইয়াহিয়া খান সেনাবাহিনীকে বলেছিল, ত্রিশ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা কর, তখন দেখবে তারা আমাদের হাত চেটে খাবে। গণহত্যার নিখুঁত পরিকল্পনা অনেক আগে থেকে করা আছে সেই নীল নকশার নাম অপারেশন সার্চলাইট। যেখানে স্পষ্ট করে লেখা আছে কেমন করে আলোচনার ভান করে কালক্ষেপণ করা হবে, কীভাবে বাঙালি সৈন্যদের নিশ্চিহ্ন করা হবে, কীভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণ করা হবে, সোজা কথায়, কীভাবে একটা জাতিকে ধ্বংস করা প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পৃষ্ঠা -০৭)
পরিকল্পনা অনুযায়ী পাকিস্তানি হায়েনারা নির্দিষ্ট সময়ের দেড় ঘণ্টা আগে রাত ১১-৩০ মিনিটে ঢাকা সেনানিবাস থেকে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। আর পাগলা হাতির মতো সামনে যা পড়ে তা দুমড়ে মুচড়ে এগিয়ে যেতে থাকে সামনে। এ সময় তাদের প্রথম আক্রমণের শিকার হয় ঢাকার ফার্মগেট এলাকা। এরপর পিলখানার ইপিআই হেড কোয়ার্টার আর রাজারবাগ পুলিশ লাইন। গভীর রাতে হায়েনারা ঝাঁপিয়ে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তারা আক্রমণ চালায় সম্পূর্ণ সামরিক কায়দায়। এই আক্রমণে পাকিস্তানি হায়েনারা মেশিন গান, মর্টার, ট্যাংক ও অন্যান্য মারণাস্ত্র প্রয়োগ করে। তারা পৃথিবীর সমস্থ বর্বরতা আর পাশবিকতাকে হার মানিয়ে ঘুমন্ত আদম সন্তানদের চিরদিনের জন্য ঘুম পাড়িয়ে দেয়। তাদের আক্রমণ থেকে মসজিদ, মন্দির, শহিদ মিনারও রক্ষা পায়নি। আক্রমণের সময় তারা মসজিদে অবস্থানরত ইমাম ও মুয়াজ্জিনদেরও হত্যা করে। পঁচিশে মার্চ দিবাগত রাতের এই হত্যাকাÐ পৃথিবীর স্মরণকালের জঘন্য ও নৃশংসতার অন্যতম দৃষ্টান্ত হিসেবে বিশ্ব-ইতিহাসে স্থান লাভ করেছে। এই নির্মম, অমানবিক, ভয়ংকর হত্যাযজ্ঞের ঘটনাবলির বিবরণ দিতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক লিখেছেন, ‘ রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে খান খান করে গর্জে উঠল মেশিনগান। একটি নয়। দুই নয়। অসংখ্য। দেখতে দেখতে ঢাকার আকাশ লালে লাল হয়ে উঠল আগুনের লেলিহান শিখায়। আগুন জ্বলছে রাজারবাগে, আগুন জ্বলছে পিলখানায়, আগুন জ্বলছে বস্তিতে বস্তিতে। হাজার হাজার নারী-পুরুষ শিশুর মর্মভেদী আর্ত চিৎকারে ভরে উঠল ঢাকার আকাশ বাতাস। শুধু মেশিন গান নয় —আরও কত স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গোলাগুলির একটানা শব্দে বিষাক্ত হয়ে উঠল রাজধানীর রাত ( মুক্তিসংগ্রাম, আবুল কাসেম ফজলুল হক, আগামী প্রকাশন, মার্চ ২০১২, পৃষ্ঠা-২৫৭)। এই ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাত অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম পহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তিনি তাঁর ঘোষণায় যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে দখলদার বাহিনীর মোকাবিলা এবং দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করার লক্ষে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার আহবান জানান।
আজ স্বাধীনতার লাভের ৪৯ বছর পর ২০২০ সালের একই তারিখে ( ২৫ মার্চ ২০২০) তাঁর সুযোগ্য কন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলার মানুষকে একটি ভিন্নধর্মী যুদ্ধে অবর্তীর্ণ হওয়ার আহবান জানিয়েছেন। এ যুদ্ধ কোনো মানুষরূপি দানবের বিরুদ্ধে নয়, এ যুদ্ধ কোনো দেশ বা মানুষের বিপক্ষে নয়। এ যুদ্ধ কোনো ভূখন্ড রক্ষা বা দখলের জন্য নয়। এ যুদ্ধ এক অদৃশ্য ভাইরাসের বিরুদ্ধে। যে ভাইরাসের নাম করোনা। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ ছিল পাকিস্তানি হায়েনার বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধ। খালি হাতে একটি শক্তিশালী পক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয় ছিনিয়ে আনার যুদ্ধ। যা ছিল রীতিমতো অবিশ্বাস্য ও স্বপ্নাতীত। কিন্তু বাঙালির দুর্দমনীয় ইচ্ছা ও অটল, অটুট ঐক্যের কাছে সেই অবিশ্বাস্য ও স্বপ্নাতীত বিষয়টিও বাস্তবে রূপ নিয়েছিল। যদিও তার জন্যে এদেশের মানুষকে দিতে হয়েছে মোটা দাগে প্রতিদান। ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে মাত্র নয় মাসের জীবনবাজি রাখা যুদ্ধে লড়াকু বাঙালিরা ছিনিযে এনেছিল সেই বহুল কাক্সিক্ষত সোনার হরিণ স্বাধীনতা। ২০২০ সালের এদিনে এসে বাংলার ১৮ কোটি মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধু কন্যার আহবান করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার। তবে এ লড়ায়ের জন্য লাগবে না কোনো ঢাল তলোয়ার। লাগবে না কোনো রাইফেল, বন্দুক, কামান। লাগবে শুধু সচেতনতা, সতর্কতা, বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করা। নিজকে বাঁচানোর জন্য, নিজের স্বজন-প্রিয়জনকে বাঁচার জন্যে আমাদের সবাইকে অবশ্যই কিছু বিধিনিষেধ কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। অতীতে যেমন ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগীকে মশারীর নিচে থাকতে হতো, গুটি বসন্তের রোগীকে আলাদা ঘরে রাখতে হতো, এখনও যেমন যক্ষা রোগীর থালা বাসন আলাদা করে রাখা হয়, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত থাকতে হবে নিজ নিজ বাসা-বাড়িতে। একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙালি। একাত্তরের লড়াই ছিল মাঠে ময়দানে, দুর্গম পাহাড়-টিলায়, জলে-স্থলে, ঝড়-বৃষ্টি এমনকি বজ্রপাতের মধ্যে। ছিল না খাবার, পানীয় জলের নিশ্চয়তা। ছিল না ঘুম, বিশ্রাম, অবসরের ফুরসত। রণাঙ্গনের প্রতিটি মুহূর্তেই ছিল মৃত্যুর হাতছানি। এমন ভয়াবহ অবস্থার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যদি সাড়ে সাত কোটি প্রাণ অন্তপ্রাণ হয়ে পৃথিবীর সবচে মহার্ঘ নিজেদের করে নিতে পারে আমরা কেন পারব না যার যার ঘরে, বাসা বাড়িতে থাকতে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আহবান হয়তো সবার কানে পৌঁছবে না। কিন্তু আপনার সুস্থতার প্রয়োজনে আপনাকেই আপনার প্রতিবেশীর কানে পৌঁছাতে হবে ভালো থাকার বার্তা। মনে রাখতে হবে পাশের বাসায় আগুন লাগলে আপনার বাসাটি যতই সুরক্ষিত হোক সে সুরক্ষা কোনো কাজে আসবে না। আপনিও হতে পারেন সেই আগুনের শিকার। তাই করোনা ভাইরাসে বিরুদ্ধে জিততে আমাদের প্রয়োজন একাত্তরের মতো নিবিড় ঐক্য। যে ঐক্য আমাদের সহায়তা করবে প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাস বিরুদ্ধে একযোগে লড়তে।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক