গ্রাহক প্রতিনিধি নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ

68

চট্টগ্রাম ওয়াসা বোর্ডে পানি ব্যবহারকারীগণের প্রতিনিধি মনোয়নের জন্য চুয়েটের প্রাক্তন ও ইউএসটিসির বর্তমান উপচার্য অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলমের নাম প্রস্তাব করেন ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক। গত ২১ অক্টোবর স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব বরাবরে এ প্রস্তাব পাঠানো হয়। এদিকে প্রস্তাব পাঠানোর দুই সপ্তাহ আগেই জাহাঙ্গীর আলমকে ওয়াসার গ্রাহক করা হয়। নিয়ম না মেনে ড. জাহাঙ্গীর আলমকে গ্রাহক করেন ওয়াসা এমডি। ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয় ড. জাহাঙ্গীর আলমকে বোর্ড সদস্য হিসেবে নিয়োগও দিয়েছেন। অথচ এ বিষয়ে কিছুই জানেন না ড. জাহাঙ্গীর আলম।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মাত্র তিনদিনের মধ্যে ওয়াসার গ্রাহক করা হয় অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলমকে। চলতি বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর রোকসানা মান্নান (ড. জাহঙ্গীর আলমের স্ত্রী) নিজের সংযোগটি তার স্বামীর নামে করার আবেদন করেন। ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বরাবরে করা এ আবেদনের পক্ষে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চাওয়া হয় ওয়াসার পক্ষ থেকে। ওয়াসার নির্ধারিত ফরমে (৫০০ টাকা নির্ধারিত মূল্য) যথানিয়মে আবেদন করার পরামর্শ দেয়া হয়। স্বাভাবিকভাবে আবেদন ফরমের সাথে দলিলের সত্যায়িত কপি, বিএস খতিয়ানের সত্যায়িত কপি, ভূমি উন্নয়ন কর রশিদের সত্যায়িত কপি, বর্তমান গ্রাহকের ছসিবসহ না-দাবিনামা, সর্বশেষ পরিশোধিত বিলের বিবরণ জমা এবং পরিবর্তনকারী গ্রাহকের ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি জমা দিতে বলা হয়। নিকট আত্মীয় হলে ওয়ারিশান সনদ বা দানপত্র জমা নেয় ওয়াসা। কিন্তু এসব গুরুত্বপূর্ণ দলিলের কোনো কপি জমা না নিয়েই ড. জাহাঙ্গীর আলমকে গ্রাহক করা হয়। শুধু তাই নয়, গ্রাহক নাম পরিবর্তনের জন্য আবেদন করলে সেটা মিটার পরিদর্শক, রাজস্ব তত্ত¡াবধায়ক ও রাজস্ব কর্মকর্তা সরেজমিনে পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দেয়ার কথা। এ ক্ষেত্রে তাও করা হয়নি। নিয়ম রয়েছে তিনশ টাকার ননজুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে না-দাবিনামা দিতে হবে। অথচ না-দাবি নামা দেয়া হয়েছে জুড়িশিয়াল কার্টিজ পেপারে, তাও আবার তারিখবিহীন। অফিসিয়াল নিয়ম অনুযায়ী নাম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ফাইলে উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক পর্যন্ত অনুমোদন নেয়ার বিধান থাকলেও এ ক্ষেত্রে সরাসরি ব্যবস্থাপনা পরিচালক হস্তক্ষেপ করেছেন। নিয়মের ব্যর্থয় ঘটিয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রভাব খাটিয়ে মাত্র তিনদিনের মধ্যে পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। কৌশলে প্রফেসর ড. জাহাঙ্গীর আলমকে ওয়াসায় আনা হলেও তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না।
গ্রাহক হওয়া ও বিতর্কের বিষয়ে জানতে চাইলে ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমি এখনো জানি না কি হয়েছে। নিয়ম মেনে করা না হলে এটা বাতিল করে দেবে। এটা তো আহামরি কিছু না। আমি জানিও না, কিভাবে কি ঘটছে। নিয়ম মাফিক হতে হবে তো। বোর্ড মেম্বার এটা কি জানিস সেটাও আমি জানি না। ওটা দিয়ে কি হয় তাও আমি জানি না।
নাম পরিবর্তনে কি ধরনের কাগজপত্র প্রয়োজন জানতে চাইলে ওয়াসার বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক (সিএম) ড. পীযূষ দত্ত বলেন, নতুন যে কিনেছেন তার কাগজ, বিল পরিশোধের কাগজ, নামজারি কাগজ, আগের গ্রাহকের না-দাবিনামা এসব কাগজপত্র লাগবে। পরিবর্তনের যৌক্তিকতা থাকতে হবে। দানপত্র বা ওয়ারিশ হলে সেটারও প্রমাণ লাগবে। কমিশনারের সার্টিফিকেট লাগবে। আমরা জমির মালিক না হলে দিই না। মালিক না হলে অস্থায়ী কানেকশন দিই। সে ক্ষেত্রে জামানত দিতে হয়।
ড. জাহাঙ্গীর আলমকে কিভাবে গ্রাহক করা হয়েছে এমন প্রশ্নে ড. পীযূষ দত্ত বলেন, তিনি গ্রাহক হয়েছেন। তাঁর স্ত্রীর সংযোগ নিজের নামে করে।
এ ক্ষেত্রে কি সকল কাগজপত্র নেয়া হয়েছিল এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কাগজ বলতে নিশ্চয় কোনো প্রত্যয়নপত্র আছে। স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রে সেটা লিভারেলি হয়ে থাকে। আমি প্রথমে এটা বাধা দিয়েছিলাম মনে আছে। শেষে অন্তত কিছু ডকুমেন্ট নিয়েছিলাম নিশ্চয়।
অভিযোগ রয়েছে, ওয়াসার চেয়ারম্যানের পদ নিজের হাতে রাখতে এবং প্রকৌশল রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতে অভিনব এ কারচুপির আশ্রয় নেন ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী একেএম ফজলুল্লাহ। ২৯ অক্টোবর ওয়াসার চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নজরুল ইসলামের মেয়াদ শেষ হয়। সে সময় চেয়ারম্যান হিসেবে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউ অব বাংলাদেশের (আইইবি) প্রতিনিধি হিসাবে প্রকৌশলী মোহাম্মদ হারুনের নাম প্রস্তাব যায় মন্ত্রণালয়ে। তিনিই (মোহাম্মদ হারুন) পরবর্তী বোর্ডের চেয়ারম্যান হবেন এমনটাই নিশ্চিত ছিলেন বোর্ড সদস্যরা। কিন্তু প্রকৌশল রাজনীতিতে ওয়াসার এমডির সাথে বিরোধিতা আছে মোহাম্মদ হারুনের। তাই প্রকৌশলী হারুনকে ঠেকাতেই তড়িঘড়ি করে ইউএসটিসির ভিসিকে গ্রাহক বানানো এবং গ্রাহক প্রতিনিধির নাম প্রস্তাব করেন ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক। গ্রাহক প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগের পর বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগের জন্য মন্ত্রণালয়ে ফাইলও পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে বোর্ড চেয়ারম্যান হিসেবে প্রকৌশলী মোহাম্মদ হারুন ও ড. জাহাঙ্গীর আলমের নাম প্রস্তাব রয়েছে।
এ বিষয়ে রাজস্ব বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রত্যেক অফিসার জাহাঙ্গীর স্যারকে এভাবে গ্রাহক করার বিরোধিতা করেছিলেন। শেষে এমডি স্যারের চাপাচাপিতে সম্মতি দিতে হয়েছে। কোনো প্রক্রিয়া এখানে অনুসরণ করা হয়নি। এমনকি ভিসি স্যারের ছবি পর্যন্ত ফাইলে নেই। তারপরও ওনাকে গ্রাহক করা হয়েছে।
এ বিষয়ে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী একেএম ফজলুল্লাহ বলেন, মেইন লোক বললে, রাইট আছে ট্রান্সফার করার। এখানে ওনার (ড. জাহাঙ্গীর) ওয়াইফ ওনার নামে ট্রান্সফার করেছেন। আর গ্রাহক প্রতিনিধি হতে হলে ওনাকে গ্রাহক হতে হবে। ওনি গ্রাহক হয়েছেন ওনার নাম গেছে। এখানে আপত্তি কিসের?
গ্রাহক হওয়ার প্রক্রিয়াগত ত্রূটি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রক্রিয়া মানে দুইটা, যার কানেকশন সে আবেদন করবে আর একটা ফি দিতে হবে। বিল সব পরিশোধ আছে। ওনার স্ত্রী, তাই কি স্ট্যাম্প নিব? ছবি লাগে না। প্রক্রিয়াতে কোনো ভুল নেই। সব ফাইল আমার কাছে আসে, আবার আমার কাছে আসেও না। আমি ম্যানেজিং ডাইরেক্টর, আমি যদি ফাইল অনুমোদন করি এতে বলার কেউ নেই। ডিএমডি করলে এরপর বলার থাকতে পারে।
এ প্রসঙ্গে উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (প্রশাসন) গোলাম হোসেন বলেন, নাম পরিবর্তনের মাধ্যমে ওনাকে গ্রাহক করা হয়েছে। এরপর গ্রাহক প্রতিনিধি হিসাবে নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। কাগজপত্র সবগুলো নেয়া হয়েছে নিশ্চয়। এ বিষয়ে আমার আসলে তেমন কিছু জানা নেই।
কে হবে গ্রাহকদের প্রতিনিধি : আইনে ওয়াসার পানি ব্যবহারকারীগণের একজন প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিনিধি নিয়োগের বিষয়টি উল্লেখ আছে। কিভাবে এ নিয়োগ সম্পন্ন হবে সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু উল্লেখ না থাকায় ওয়াসার পক্ষ থেকে পছন্দের গ্রাহকের নাম প্রস্তাব করা হয়। মন্ত্রণালয় সেখান থেকেই একজনকে নিয়োগ দিয়ে থাকে। ‘প্রতিনিধিত্বকারী’ হতে হলে সেটাতে নির্বাচনের বিষয়টি চলে আসে। একমাত্র ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত ব্যক্তিই প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন। তাছাড়া ভোক্তা বা গ্রাহকদের প্রতিনিধিত্বকারী বৈধ সংগঠনও প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। কিন্তু ওয়াসা নির্বাচন বা বৈধ সংগঠনের নাম প্রস্তাব না করে বরাবরই পছন্দের দিকে ঝুঁকেছে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, ভোক্তাদের একমাত্র প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ক্যাব। ওয়াসার গ্রাহক প্রতিনিধি নিয়োগ নিয়ে আমরা আপত্তি জানিয়ে আসছিলাম। কোনো গ্রাহককে সরাসরি প্রতিনিধিত্বকারী হিসাবে নিয়োগের সুযোগ নেই। হয়তো ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বকারী নির্বাচিত করতে হবে। না হয়, ভোক্তাদের সংগঠন হিসেবে ক্যাবের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। ওয়াসা এর কোনোটাই না করে মনগড়া গ্রাহক প্রতিনিধি নিয়োগ করছে। এরমাধ্যমে গ্রাহকদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেয়া হচ্ছে। আমরা এটার আইনি পদক্ষেপে যাবো।
২৮ নভেম্বর মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মোহাম্মদ সাঈদ-উর-রহমান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলমকে ওয়াসার পানি ব্যবহারকারীগণের প্রনিতিধিত্বকারী সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ওয়াসার পূর্বের বোর্ড সদস্য মো. সোলায়মান আলম শেঠের স্থলাভিষিক্ত করা হয় তাঁকে।