গ্রামের বিদ্যালয়গুলোর জন্যে হবে অফুরান প্রেরণার উৎস

54

গত বছরের শেষদিন দেশের সবচেয়ে বড় পাবলিক পরীক্ষা প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পিইসি)পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। কোমলমতি শিশুকিশোরদের জীবনের প্রথম এ পাবলিক পরীক্ষায় চট্টগ্রাম বোর্ডের অধীনে অংশ নিয়েছিল ১,৩৩,৪২৩ জন ছাত্রছাত্রী। নগরীর ৬টি থানা ও ১৪টি উপজেলা থেকে অংশ নেওয়া এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে ১,২৯,১৪৩ জন। পাসের হার ৯৬.৭৯ শতাংশ। অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাস করতে পারেনি এমন ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৪,২৮০ জন। আর যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার পরও পরীক্ষায় নানা কারণে অংশগ্রহণ করেনি অর্থাৎ অনুপস্থিত ছিল প্রায় ফেলের সমসংখ্যক শিক্ষার্থী। এসব শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪০১৪ জন। ঘোষিত ফলানুযায়ী জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৬,৫৩২ জন। গত বছর জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১৮,১৮৪ জন। গত বছর মোট উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১,৩৮,১৭৪ জন। ফলাফল পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, গত বছরের তুলনায় এ বছর জিপিএ-৫ ও পাসের হার দুটোই কমেছে। গত বছর যেখানে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১,৩৮,১৭৪ জন সেখানে এ বছর পাস করেছে ১,২৯,১৪৩ জন। সে হিসেবে ৯০৩১ জন শিক্ষার্থী কম পাস করেছে। একইভাবে জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যাও হ্রাস পেয়েছে। গত বছর যেখানে জিপিএ-৫ পেয়েছিল ১৮,১৮৪ জন শিক্ষার্থী, সেখানে এ বছর পেয়েছে ১৬,৫৩২ জন। গত বছরের তুলনায় এ বছর জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১,৬৫২ জন কমেছে।
মোট পাসের সংখ্য ও জিপিএ -৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমলেও এবারের ফলাফলে রয়েছে সবচেয়ে বড় চমক। আর সেই চমকটি হলো ফলাফলে শহরকে ছাড়িয়ে গ্রামের এগিয়ে যাওয়া। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শুধু মাত্র স্কুলের শিক্ষকদের সহযোগিতা আর নিজের বলে গ্রামাঞ্চলের এই অসাধারণ পাসের হার উপহার দিয়েছে কোমলমতি শিশু-কিশোররা। আর তাই এদেশের মানুষের বিশেষত চট্টগ্রাম বোর্ডের আওতাধীন সকল শ্রেণির অভিভাবকদের এতদিন ধরে লালিত ধারণা পাল্টে দিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে এবারের ফলাফল। এদেশের গ্রামীণ জনগণের বেশির ভাগের ধারণা ছিল ভালো পাস, জিপিএ -৫ পেতে হলে চাই শহরের স্কুল। একমাত্র শহরের স্কুল ছাড়া জিপিএ-৫ পাওয়া মোটের ওপর অসম্ভব। এ কারণে জিপিএ-৫ আর ভালো পাস এর মতো সোনার হরিণের পেছনে ছুটতে অনেকে গ্রামের বাঁধন ছিন্ন করে চলে আসেন শহরে। এভাবে শহরে আসতে গিয়ে অনেক যৌথ পরিবার যেমন ভেঙে যায় তেমনি পরিবারের অন্য সদস্যরা নানা টানাপোড়নের মধ্যে পড়ে। পরিবারে বয়স্ক মা-বাবা থাকলে তাঁদের সেবাযতেœর সমস্যার সৃষ্টি হয়। লেখাপড়ার কথা বলে অনেক প্রবাসী পরিবার শহরে এসে বাসা নেয়। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় একজনের দেখাদেখি আরেকজন শহরে বাসা নেওয়ার জেদ ধরে। এ অবস্থায় প্রয়োজনীয় সঙ্গতি না থাকা সত্তে¡ও অনেক পরিবারের কর্তা বাধ্য হয় সম্মতি দিতে। কার্যক্ষেত্রে এসব পরিবার ভালো পাসের বদলে পরিবারের দুর্ভোগই ডেকে আনে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের গ্রামগুলোকে ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় বলে আখ্যায়িত করেছেন। এবারের প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার ফলাফল প্রমাণ করেছে গ্রামগুলো শুধু শান্তির নীড় নয়, আলোর নীড় হিসেবেও অচিরে স্থান করে নেবে। যারা শুধু ভালো পাসের আশায় গ্রামের বিশুদ্ধ হাওয়া পায়ে মাড়িয়ে গাড়ির কালো ধোঁয়াকে সঙ্গী করে নিয়েছেন তাঁদের ভাবিয়ে তুলবে এবারের পিইসি-এর ফলাফল। এবারের প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় শহরের কোনো স্কুলের এক থেকে ছয়ের মধ্যে জায়গা হয়নি। সবগুলোতে উপজেলার জয়জয়কার। এই ছয়টি স্থান দখল করে নিয়েছে চট্টগ্রামের দক্ষিণের তিনটি এবং উত্তরের তিনটি উপজেলা। সবচেয়ে বড় চমক এক সময়ের কম দুর্গম বাঁশখালী এবং বেশি দুর্গম স›দ্বীপ স্থান করে নিয়েছে প্রথম ও ষষ্ঠস্থান। প্রাথমিক শিক্ষা অফিস প্রতিবারের ন্যায় এবারও পাসের হারের ভিত্তিতে যে ক্রমতালিকা তৈরি করেছে তাতে শীর্ষ দশের মধ্যে ৭টিই শহর এলাকার বাইরের। আর শহরের ভাগে পড়েছে মাত্র তিনটি থানা। অথচ গত বছর শীর্ষ পাঁচের মধ্যে তিনটিই ছিল শহরের। এবারের তালিকায় শীর্ষস্থানে রয়েছে বাঁশখালী উপজেলা। গত বছর পাসের হার অনুযায়ী এ উপজেলার অবস্থান ছিল তৃতীয়। এ বছর এ উপজেলা থেকে ১৬০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৮৬৮১ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। তাদের মধ্যে পাস করেছে ৮,৬৫২ জন। পাসের হার ৯৯.৬৭ শতাংশ। এটাকে অংকের হিসেবে শতভাগ পাসই বলা যায়। প্রায় ৯ হাজার ছাত্রছাত্রীর মধ্যে মাত্র ২৯ জন শিশুর অকৃতকার্য হওয়া, অস্বাভাবিক কিছু নয়। এজন্য বাঁশখালী উপজেলার কোমলমতি শিশুকিশোরদের আমরা জানাই আন্তরিক অভিনন্দন। ‘আমরা করব জয়’ এই গানের কলিটি কোনো বিশেষ স্থানের জন্য সীমাবদ্ধ নয়,বাঁশখালী উপজেলার সোনার ছেলেরা তা করে দেখিয়েছে। সে সঙ্গে আমরা অভিনন্দন জানাই উপজেলায় কর্মরত সকল প্রাথমিক শিক্ষকদের। যাঁরা শহুরে কৃত্রিম মায়াজাল ছিন্ন করে গ্রামবাংলার কোনো কোনোক্ষেত্রে অবহেলিত জনপদের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। শিক্ষক হচ্ছেন সেই মানুষ যিনি ছাত্রদের বুকের ভেতরে লালিত সুপ্ত প্রতিভাকে জাগিয়ে তোলেন। শিক্ষকদের আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও প্রজ্ঞা ছাড়া শিক্ষার্থীদের সুপ্ত প্রতিভাকে জাগিয়ে তোলা সম্ভব নয়। গ্রামবাংলার মানুষ গড়ার কারিগরিরা সেই দুরুহ কাজটিই করে চলেছেন শিক্ষার্থীদের। এজন্য তাঁদের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা।
তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে রাউজান উপজেলা। উপজেলা থেকে এবার ৫,৯১৭ জন অংশগ্রহণ করে পাস করেছে ৫,৮৫৩ জন। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৬৭৩ জন শিক্ষার্থী। তালিকায় তৃতীয় স্থানে থাকা পটিয়া উপজেলা থেকে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ৮,৯৮৬ জন শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে ৮,৮৪৪ জন আর জিপিএ-৫ পেয়েছে ৯০১ জন শিক্ষার্থী। তালিকায় চতুর্থ স্থানে থাকা লোহাগাড়া উপজেলা থেকে মোট ৫১০৭ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে কৃতকার্য হয়েছে ৫০১৫ জন আর জিপিএ-৫ অর্জন করেছে ৭১৫ জন শিক্ষার্থী। পঞ্চম স্থান অর্জনকারী রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ৫,৫১৪ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিল পিইসি পরীক্ষায়। তাদের মধ্যে পাস করেছে ৫,৩৮৩ জন.। এ উপজেলা থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৫০৭ জন শিক্ষার্থী। চট্টগ্রামের ১৪টি উপজেলার মধ্যে স›দ্বীপ ছিল গত বারের ফলাফলে সর্বনিম্নে। কিন্তু এবার এই উপজেলার ফলাফলে হয়েছে খুব ভালো উন্নতি। উপজেলাটি ১৩ ধাপ এগিয়ে এবার স্থান করে নিয়েছে শীর্ষ দশের মধ্যে ষষ্ঠস্থান। স›দ্বীপ উপজেলার ১৯২টি বিদ্যালয় থেকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে মোট ৫,২০২ জন ছাত্র-ছাত্রী। তাদের মধ্যে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫০৭৭ জন। পাসের হার ৯৭.৬০। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৫৮৩ জন শিক্ষার্থী।শহরের নামকরা স্কুলগুলোকে পেছেনে ফেলে গ্রামবাংলার ফলাফলের সুখকর উন্নতির পেছেনে বেশ কটি পদক্ষেপ কাজ দিয়েছে বলে সচেতন মহলের ধারণা। আগে পঞ্চম শ্রেণির কার্যক্রম শুরু হতো দুপুর বারোটায়। এ সময়টায় অনেক ছাত্রছাত্রীই স্কুলে আসার আগ্রহ হারিয়ে ফেলত। এখন সব শ্রেণির কার্যক্রম শুরু হয় একই সময়ে, সকাল সাড়ে নয়টায়। এই পদক্ষেপের ফলে একই পরিবারের ভাইবোন একসঙ্গে স্কুলে আসার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া প্রাথমিক শিক্ষকদের দেওয়া হয়েছে নানা প্রশিক্ষণ। এ প্রশিক্ষণের ফলে তাঁরা আরও দক্ষতার সঙ্গে পাঠদান করতে সমর্থ হচ্ছেন। নতুন নতুন কৌশল প্রয়োগ, শিক্ষার্থীদের শ্রেণিমুখী করতে শিক্ষকদের আন্তরিক প্রয়াস এবং সর্বোপরি দুর্বল শিক্ষার্থীদের বিশেষভাবে যতœ নেওয়ার ফলে গ্রামের স্কুলের এ আশাতীত উন্নতি ঘটেছে বলে সচেতন মানুষের বিশ্বাস।
আমরা যারা শহরে থাকি, শহরে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাই আমাদের ধারণা লেখাপড়া বলতে যা কিছু বোঝায় তা সব শহরেই হয়ে থাকে। আবার যারা গ্রামে থাকেন, অনেকটা সচ্ছল তাঁদেরও অভিন্ন ধারণা শহরই সোনার হরিণের আধার। প্রকৃত অর্থে তা নয়। শহরের মা-বোনেরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে যেভাবে উদয়-অস্ত প্রাণান্তকর শ্রমে নিয়োজিত থাকেন তার সিকিভাগও যদি গ্রামের মা-বোনেরা সচেতন হন কিংবা তাঁদের সচেতন করে তোলা যায় তাহলে নিঃসন্দেহে পাল্টে যাবে গ্রাম বাংলার চেহারা। এতদিন ধরে গ্রাম আর শহরের মধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে যা কিছু সুযোগ সুবিধার কমতি ছিল তা ক্রমেই সমান হয়ে আসছে। বর্তমান সরকারের শিক্ষাবান্ধব কর্মসূচির ফলে খুব সহসাই প্রতিটি গ্রাম হয়ে ওঠবে একটা একটা শহর। আমরা আশা করছি জিপিএ -৫ প্রাপ্তির আশায় মানুষ শহরে নয় গ্রামেই ফিরে যাবে একদিন। সেদিন হয়তো বেশি দূরে,খুব কাছে। তারই প্রতিধ্বনি জানান দিল এবারের সবচেয়ে বড় পাবলিক পরীক্ষার ফল।( ঋণ স্বীকার : প্রথম আলো ৪ জানুয়ারি ২০২০ এবং দৈনিক আজাদী ০১ জানুয়ারি)

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক