গ্রামবাংলার পালাবদলের স্বপ্নদ্রষ্টার চির বিদায় জাতি এক কিংবদন্তিকে হারাল

49

দেশ ও জাতির জন্য এক নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিত্ব, দারিদ্র্য বিমোচনের যাদুর লাঠি নিয়ে যার জন্ম, ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান স্যার ফজলে হাসান আবেদ আর নেই। দেশ-বিদেশে বিপুল খ্যাতি ও সম্মান অর্জন করা সফল এনজিও এ ব্যক্তিত্ব গত শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টায় রাজধানীর একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। ফজলে হাসানের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দৈনিক পূর্বদেশ পরিবারও এ মহান ব্যক্তির ইন্তেকালে শোকাহত। আমরা তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করছি এবং তার শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি।
বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, ব্র্যাক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিপুল অবদান রেখেছেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। যুদ্ধকালীন সময়ে ভারতে আশ্রিত শরণার্থীরা স্বাধীনতা পরবর্তী দেশে ফিরে আসলে, তাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়ে যে ব্র্যাকের সূচনা করেন, এর মাধ্যমেই মূলত দেশের অর্থনৈতিক, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও স্বাস্থ্যের ব্যাপক উন্নয়নে অবিস্মরণীয় অবদান রেখে যান। জাতি তার এ অবদানকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। ফজলে হাসান আবেদ ১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল তদানীন্তন সিলেটের হবিগঞ্জ মহকুমার বানিয়াচং গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লন্ডনে অ্যাকাউন্টিং বিষয়ে পড়ালেখা করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে লন্ডনে চলে যান। সেখানে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ এবং ‘হেল্প বাংলাদেশ’ নামে দুটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর ১৯৭২ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ভারত-প্রত্যাগত শরণার্থীদের জরুরি ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এ লক্ষ্যে তিনি ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করে সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত এলাকায় ফিরে আসা শরণার্থীদের নিয়ে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু করেন। বর্তমানে ১ লাখ কর্মী নিয়ে শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর ১১টি দেশের ১২০ মিলিয়ন মানুষকে বিভিন্ন সেবা দিয়ে চলেছে ব্র্যাক। ফজলে হাসান আবেদকে দেশের মানুষরা গ্রামবাংলার পালাবদলের স্বপ্নদ্রষ্টা বলে আখ্যায়িত করেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার মাধ্যমে ব্র্যাক বিশেষকরে, নারীর ক্ষমতায়নে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। বিশ্বের ১১টি দেশে ব্র্যাক ১০ কোটিরও বেশি মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রেখে চলেছে। দারিদ্র্য বিমোচনে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ফজলে হাসান আবেদকে ২০১০ সালে ব্রিটেনের অন্যতম সম্মানজনক ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এ ছাড়া অসংখ্য দেশি-বিদেশি পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন তিনি। মানুষকে মর্যাদা দেয়ার বিষয়টি ছিল তার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি ব্র্যাকের পরিচিতি যখন বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত তখনো সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের উন্নয়নই তার অগ্রাধিকার ছিল। সততা, বিনয় ও মানবিকতার এক বিরল দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি।
শুক্রবার তার ইন্তেকালের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশের তারুণ্যের এক বড় অংশকে হতাশা প্রকাশ করতে দেখা যায়। শোক প্রকাশের পাশাপাশি স্যার ফজলে হাসানের তরুণদের প্রতি বিশেষ মমতা ও ভালোবাসার আবেগময় বিবরণ দিয়েছেন অনেকে। তার এসব গুণাবলিই মূলত ব্র্যাকের প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যবোধ গড়ে ওঠার ভিত্তি রচনা করেছে। আর স্যার নিজেই জীবদ্দশাতেই পরিণত হয়েছেন কিংবদন্তিতে। তার সমাজকর্ম আগামী বাংলাদেশ বিনির্মাণে নির্দেশিকা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। আমরা এ মহান ব্যক্তির রুহের মাগফেরাত কামনা করছি। মহান আল্লাহ তা’আলা তাকে জান্নাতের অধিবাসী করুক-এ প্রার্থনা করছি।