গ্যাসের ব্যবহারজনিত দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে

130

জীবনযাত্রার নানাক্ষেত্রসহ বিভিন্ন খাতে গ্যাসের ব্যবহারের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এ সংক্রান্ত দুর্ঘটনার ঝুঁকিও। কখনও যানবাহনে সংযোজিত বা বাসাবাড়িতে রাখা গ্যাস সিলিন্ডারের বিস্ফোরণ ঘটছে। কখনও আবার রান্নার কাজে ব্যবহৃত গ্যাসের চুলা থেকে শুরু করে বিতরণ সংস্থার সরবরাহ লাইনের রাইজার ও লিকেজ থেকে নির্গত গ্যাসজনিত বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। হচ্ছে সম্পদহানিও।
বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে চলতি বছরই গ্যাসজনিত বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। গ্যাসের ব্যবহারে গ্রাহক বা ভোক্তা পর্যায়ে সচেতনতার অভাবের পাশাপাশি বিতরণ ও তদারকি সংস্থাগুলো সময়মত কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়ার কারণেই অধিকাংশ দুর্ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে। এমনকি গ্যাসের ব্যবহারজনিত দুর্ঘটনার ঝুঁকি হ্রাসেরও তেমন কোনও কার্যক্রম এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়ে উঠছে না। গ্যাসের ব্যবহারে প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন এবং দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতে এখনই কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন এ খাতের বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, সরকারের কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গত এক দশক নানা খাতে জ্বালানি হিসেবে গ্যাসের ব্যবহারকে উৎসাহিত করার কারণে গ্যাসনির্ভরতা বেড়েছে। যানবাহনে জ্বালানি হিসেবে সিএনজি বা রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাসের পর বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানা ও বাসা-বাড়িতে এলএনজি বা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহারের দিকেই ঝুঁকছে অধিকাংশ মানুষ। ফলে, দেশে গত এক দশকে বেশ কয়েকটি এলএনজি আমদানি, বোতলজাত ও বাজারজাতকরণ প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে। আবাসিক গ্যাস সংযোগ বন্ধের পাশাপাশি তাকে নিরুৎসাহিত করার সরকারি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আবাসিক সংযোগে গ্যাসের দামও দফায় দফায় বৃদ্ধি করা হয়েছে। একইসাথে গ্যাসের ব্যবহারজনিত বিস্ফোরণে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যাও পাল্লা দিয়েই বেড়ে চলেছে। গত এক দশকে বছরে সারা দেশে গ্যাস বিস্ফোরণ সংক্রান্ত বিভিন্ন দুর্ঘটনায় অন্তত পাঁচশ’ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। এর মধ্যে চলতি বছরই এ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা শতাধিক। আহত হয়েছেন কমপক্ষে দুইশ’ জন।
বিস্ফোরক পরিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস, গ্যাস বিতরণ কোম্পানি এবং হাসপাতাল সূত্রে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বছরের শুরুতে রাজধানীর পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডিতে প্রাণ হারান ৮১ জন। ফেব্রæয়ারিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গণপরিবহনে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে তিনজন, এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গ্যাসের বিতরণ লাইনে বিস্ফোরণে দু’জন, অক্টোবরে রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরে বেলুন বিক্রির সময় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে সাত শিশু ও মানিকগঞ্জে একই পরিবারের তিনজন নিহত হন। গত ১৭ নভেম্বর নগরীর পাথরঘাটায় গ্যাসের সরবরাহ লাইনের লিকেজ থেকে সৃষ্ট বিস্ফোরণে দেয়াল চাপা পড়ে আটজন নিহত হয়। সর্বশেষ গত ৫ ডিসেম্বর রাত এগারটার দিকে নগরীর সল্টগোলা ক্রসিং এলাকায় ওয়েস্টার্ন মেরিন ওয়ার্কশপে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ছয়জন অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন। তাদেরকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। বিস্ফোরক পরিদপ্তরের হিসাবে, গত দশ বছরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে নয় শতাধিক দুর্ঘটনায় দেড় হাজার লোক হতাহত হয়েছেন। বছরে গড়ে পাঁচ থেকে ছয়টি গ্যাসজনিত বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। আর গ্যাসজনিত বিস্ফোরণ বা দুর্ঘটনায় বছরে গড়ে নিহত হন ৫০ থেকে ৬০ জন। ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে দেশে গ্যাসজনিত অগ্নিকাÐ ঘটেছে একশ’ ৫৬টি। ২০১৬ সালে গ্যাসজনিত অগ্নি-দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় একশ’ ৯৬ টিতে। গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানির তথ্যমতে, ২০১৭ সালে গ্যাসের চুলা থেকে সৃষ্ট দুর্ঘটনার সংখ্যা দুইশ’ ৩৮টি, আর গ্যাস লিকেজের জন্য ঘটেছে পাঁচ হাজার ৫০টি দুর্ঘটনা। ২০১৮ সালে ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অবশ্য গ্যাস বিতরণ কোম্পানির পরিসংখ্যানকে সমর্থন করে। ফায়ার সার্ভিস বলছে, গত বছর চুলার আগুন থেকে দুর্ঘটনা ঘটেছে তিন হাজার চারশ’ ৪৯টি। নগরীতে গত চার বছরে সাত দফা গ্যাসজনিত বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এসব বিস্ফোরণে মারা গেছেন অন্তত ১৪ জন। তবে গ্যাস বিস্ফোরণে একসঙ্গে সর্বোচ্চ সাতজন নিহত হওয়ার ঘটনা এই প্রথম। এর আগে সাগরিকায় ভূগর্ভস্থ গ্যাস লাইন বিস্ফোরণে কেউ হতাহত না হলেও দেবে গিয়েছিল প্রায় ১০ কিলোমিটার সড়ক।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) সাবেক উপাচার্য জাহাঙ্গীর আলম পূর্বদেশকে বলেন, ‘জ্বালানিমাত্রই দাহ্য পদার্থ। তার মানে সব পর্যায়ে জ্বালানি হল স্পর্শকাতর। তাই জ্বালানি হিসেবে গ্যাসের উৎপাদন, সঞ্চালন, বিতরণ, সংযোগ ও ব্যবহারে প্রতিটি স্তরেই প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করা গুরুত্বপূর্ণ। নিরাপত্তার স্বার্থেই গ্যাস সিলিন্ডার থেকে শুরু করে সরবরাহ লাইন যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ এবং নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও তদারকি অপরিহার্য। কিন্তু বিষয়টিকে কেউই সেভাবে গুরুত্ব দিতে দেখা যাচ্ছে না। বিতরণ সংস্থা আবাসিকে সংযোগ দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে। ভবন মালিকরাও সংযোগ লাইন রক্ষণাবেক্ষণ ও পরীক্ষার ব্যাপারে উদাসীন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে কেউ গ্যাস সংযোগ পরীক্ষা করে না। এমনকি ব্যবহৃত সিলিন্ডার সম্পর্কেও সচেতন নন।
পেট্রেবাংলার অধীনে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চালু হওয়া কেজিডিসিএল বর্তমানে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ কাজে নিয়োজিত। সংস্থাটির ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, তাদের পাঁচ লাখ ৯৭ হাজার নয়শ’ ৮৫টি আবাসিক সংযোগ রয়েছে। দেড় লাখ গ্যাস রাইজার দিয়ে এসব সংযোগ দেয়া হয়েছে ভবনগুলোতে। এ জন্য টানা হয়েছে দুই হাজার আটশ’ কিলোমিটার সরবরাহ লাইন। কিন্তু অর্থ ও জনবল সংকটে এসব লাইন ও সংযোগ নিয়মিত পরীক্ষা করতে পারছে না কেজিডিসিএল। প্রতিবছর গ্যাসজনিত দুর্ঘটনা বৃদ্ধির এটা অন্যতম কারণ। একইভাবে যানবাহনসহ বিভিন্ন খাতে সরবরাহকৃত সিলিন্ডারও নিয়মিত পরীক্ষা না করার অভিযোগ রয়েছে।
কেজিডিসিএল-এর মহাব্যবস্থাপক মো. সারোয়ার হোসেন নিজেও লোকবল সংকটের কারণে আবাসিকের গ্যাস সংযোগগুলো নিয়মিত পরীক্ষা করা যাচ্ছে না বলে স্বীকার করেন। তবে তার দাবি, পাথরঘাটায় দুর্ঘটনার পর নতুন করে দেড় লাখ রাইজার এবং সেগুলো থেকে নেয়া সংযোগ আবারও পরীক্ষা করার কাজ শুরু হয়েছে। দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতে এর চেয়ে ভাল কোনও বিকল্প তাদের কাছে নেই।