গোড়ায় গলদ দূর করতে হবে

87

যে নদীর তীর ঘেঁষে প্রাচ্যের রাণী চট্টগ্রাম গড়ে উঠেছে, মানুষ সৃষ্ট দূষণ ও অবৈধ দখলদারিত্বে সেই কর্ণফুলী নদী আজ সরু খালে পরিণত হওয়ার পথে। এ নিয়ে চট্টগ্রামবাসীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সীমা না থাকলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের নির্লিপ্ততা নগরবাসীকে চরমভাবে হতাশ করছে। সাধারণ মানুষ দেখছে আর ক্ষোভে জ্বলছে এ জন্যই যে, তাদের চোখের সামনেই ঘটছে দেশের অর্থনীতির প্রাণপ্রবাহ কর্ণফুলী নদীর মৃত্যুযন্ত্রণা। কর্ণফুলীর প্রাণ সঞ্চারনী যে তেরটি প্রধান খালসহ ৫৪টি ছোটবড় খাল ছিল এরমধ্যে কয়েকটি সরু খালে পরিণত হয়ে বেঁচে আছে মাত্র । অধিকাংশ খাল হয়ত প্রভাবশালীদের দখলে অথবা বর্জ্যসহ নানা অত্যাচারে বিলিন হয়ে গেছে। নগর কর্তৃপক্ষ, বন্দর, সিডিএ, পানি উন্নযন বোর্ড এমনকি প্রশাসনও এ বিষয়টি নিয়ে মাঝেমধ্যে সরব হতে দেখা যায়, কিন্তু ‘যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবন’। অবশেষে কর্ণফুলীকে দখল ও দূষণমুক্ত করতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা জারি হয়েছিল, গণমাধ্যমে নানা প্রতিবেদন, সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু তাতে নির্লিপ্ততা কাটে নি সংশ্লিষ্টদের। পরে অবশ্যই বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজের কাঁধে এর দায় তুলে নিয়ে গত বছর সেপ্টেম্বর মাস থেকে কর্ণফুলী নদীর গভীরতা বাড়াতে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজ শুরু করে। বন্দর কর্তৃপক্ষ এর জন্য প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। তবে এ ড্রেজিং স্থায়িত্ব কতদিন থাকবে-তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এর কারণ অবশ্যই বন্দর কর্তৃপক্ষ নয়, বরং আমরা নগরবাসীই। সম্প্রতি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নগরীর খালগুলো ড্রেজিং শুরু করেছে, দখল ও দূষণমুক্ত করাসহ খালগুলোর কুলঘেঁষে রিংরোড, বাঁধ, সৌন্দর্যবর্ধনসহ বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। গত জুন থেকে প্রাথমিকভাবে অনেক খাল খনন করতে গিয়ে যে বর্জ্য তোলা হয়েছে তাতে মাটির সাথে অধিকাংশই প্লাস্টিকসামগ্রী ছাড়া তেমন কিছু ছিল না। একই অবস্থা কর্ণফুলীতেও। গতকাল শুক্রবার দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বন্দর কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন আধুনিক ড্রেজার মেশিনের সাহায্যে নদীর তলদেশ খননের কাজ করছে। ড্রেজিংয়ের সময় নদীর তলদেশ থেকে মাটি-বালুর চেয়েও বেশি উঠছে অপচনশীল ‘প্লাস্টিক বর্জ্য’। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্লাস্টিক বর্জ্য এখন ড্রেজিংয়ে ‘বড় বাধা’ হয়ে দেখা দিয়েছে। এ ধরনের কঠিন বর্জ্যের কারণে টানা বিশ মিনিটও ড্রেজার সচল রাখা যাচ্ছে না।
প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, নগরীর বিভিন্ন খাল হয়ে প্রতিদিন সরাসরি কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়ছে নানা ধরনের গৃহস্থালী ও শিল্পবর্জ্য। এসব খাল দিয়ে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টন ময়লা নদীর তলদেশে জমা হচ্ছে। এতে করে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে পলিথিনের বিশাল এক আস্তরণ তৈরি হয়েছে। নিত্যদিনের কাজকর্ম ও জীবনযাত্রায় পলিথিন-প্লাস্টিক জাতীয় পণ্যের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় নদীকে গিলে খাচ্ছে এসব বর্জ্য।
বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, প্লাস্টিকসামগ্রী বাংলাদেশের একক সমস্যা নয়। এটিও বৈশ্বিক একটি সমস্যা। পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশের মানুষ নিত্যসামগ্রী বহনে প্লাস্টিক সামগ্রিই ব্যবহার করে থাকে। বাংলাদেশ বরং চীন ও ইন্দোনেশিয়া থেকে প্লাস্টিক ব্যবহারে পিছিয়ে। তবে উন্নত বিশ্বসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশ প্লাস্টিক ব্যবহারের পর বর্জ্য হিসাবে নদী বা সাগরে না ফেলে এর রিসাইক্লিং ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত করে আবারও প্লাস্টিক জাতীয় জিনিসপত্র তৈরি করে থাকে। এতে দেশগুলোর খাল, নালা, নর্দমা, নদী ও সাগর ভরাট ও দূষণ থেকে অনেকাংশই মুক্ত থাকে। সম্প্রতি বাংলাদেশে বেসরকারিভাবে ঢাকা-চট্টগ্রামে এ জাতীয় কিছু ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে উঠলেও সরকারি পর্যায়ে কোন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কিনা আমাদের জানা নেই। আমরা মনে করি, গোড়ায় গলদ রেখে যতই আগা ছাটানো হোকনা কেন সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। এরজন্য একদিকে যেমন প্রয়োজন জনসচেতনতা তেমনি প্লাস্টিকসামগ্রী উৎপাদনে অনুৎসাহিত করণসহ অবৈধ বাজারজাতের বিরুদ্ধে প্রশাসনের কঠোর অবস্থান গ্রহণ। পাশাপাশি বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নতুন ও আধুনিক পরিকল্পনা গ্রহণসহ সকল প্রকার বর্জ্যকে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে মানুষের দেশ ও জনগণের কল্যাণে ব্যবহার করার উদ্যোগ নিতে হবে।