গোবিন্দ চন্দ্র দেব (১৯০৭-১৯৭১)

433

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ১৯০৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের আসাম প্রদেশের পঞ্চখন্ড পরগনার (বর্তমানে সিলেটের বিয়ানীবাজার) লাউতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জি সি দেব নামেই বেশি পরিচিত। এছাড়া সম্বন্বয়ী দর্শনের জন্যও পরিচিত। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে তাকে হত্যা করা হয়। জি সি দেবের পূর্বপুরুষ ছিলেন উচ্চগোত্রীয় ব্রাহ্মণ। তারা গুজরাট থেকে সিলেট এসেছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর তিনি স্থানীয় মিশনারিদের তত্ত্বাবধানে বড় হন। শৈশবেই মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯২৫ সালে বিয়ানীবাজার উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে এন্ট্রাস পরীক্ষায় ও কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ১৯২৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯২৯ সালে সংস্কৃত কলেজ থেকে ব্যাচেলর অব আর্টস ও ১৯৩১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে মার্স্টাস সম্পন্ন করেন। জিসি দেব ১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
জি সি দেব কলকাতা রিপন কলেজে শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে রিপন কলেজ দিনাজপুর স্থানান্তরিত হলে তিনিও চলে আসেন। যুদ্ধ শেষে কলকাতা না ফিরে সুরেন্দ্রনাথ কলেজের (দিনাজপুর) প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেব যোগদান করেন। ১৯৫৩ সালের জুলাইয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ঢাকা হলের (বর্তমানে শহীদুল্লাহ হল) হাউস টিউটর হিসেবে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত দ্বায়িত্ব পালন করেন, একই বছর জগন্নাথ হলের প্রভোস্টের দ্বায়িত্ব পান। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের চেয়্যারম্যানের দ্বায়িত্বভার গ্রহণ করেন ও ১৯৬৭ সালে প্রফেসর পদে পদান্নতি লাভ করেন।
ষাটের দশকের শেষের দিকে ড. দেব পেনসেলভেনিয়ার wilkes-Barre কলেজে শিক্ষকতা করেন। স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন, সেখানে তার গুণমুগ্ধরা তার মানবিক দর্শন প্রচারের লক্ষে The Govinda Dev Foundation for World Brotherhood প্রতিষ্ঠা করে।
ড. দেব ১৯৬০ থেকে আমৃত্যু পাকিস্তান দর্শন সমিতির নির্বাচিত সম্পাদকের দ্বায়িত্ব পালন করে গেছেন। এছাড়া তার সমস্ত সম্পত্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েকে দান করে গেছেন। যা দ্বারা ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন কেন্দ্র (উঈচঝ) প্রতিষ্ঠিত হয়।
গোবিন্দ চন্দ্র দেবের মোট গ্রন্থ নয়টি, যার মধ্যে দুইটি বাংলায় ও সাতটি ইংরেজিতে। জীবদ্দশায় প্রকাশিত বইগুলো হল Idealism and Progress (1952), Idealism : A New Defence and a New Application (1958), আমার জীবন দর্শন (১৯৬০), Aspirations of the Common Man (1963), The Philosophy of Vivekananda and the Future of Man, তত্ত্ববিদ্যা-সার (১৯৬৬), ও Buddha : the Humanist (1969)। মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয় Parables of the East (1984) I My American Experience (1993).
জি সি দেব এমএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্বর্ণপদক ও হেমচন্দ্র মুখার্জি রৌপ্যপদক লাভ করেন। আরও পান পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষিত সমাজের ‘দর্শন সাগর’ উপাধি (১৯৬১), একুশে পদক (১৯৮৫, মরণোত্তর) ও স্বাধীনতা পুরস্কার (২০০৮, মরণোত্তর)।
পালিত মেয়ে রোকেয়া বেগম ও তার স্বামী জি সি দেবের বাসায় থাকতেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সারারাত তার বাড়ির উপর গুলিবর্ষিত হয়। ভোরের দিকে দরজা ভেঙে পাকিস্তানি সেনারা ঘরে প্রবেশ করে ব্রাশ ফায়ার করে গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও রোকেয়া বেগমের স্বামীকে হত্যা করে।