গোপনবার্তার রহস্য ২

83

গত পর্বে আমরা জেনেছিলাম স্টেগানোগ্রাফি সম্পর্কে। আজ আমরা আরো কিছু গোপনবার্তার কৌশল জানব। প্রথমেই বলি মোর্স কোড-এর কথা। আমরা সোর্স কোড-এর নাম শুনেছি কিন্তু মোর্স কোড শব্দটি অনেকের কাছে নতুন মনে হতে পারে। এটি আসলে অনেক পুরাতন কৌশল যা টেলিযোগাযোগের জন্য ব্যবহার করা হয়। আপনারা হয়ত পুরাতন কিছু যুদ্ধের সিনেমাতে দেখে থাকবেন সেনাবাহিনীর অয়ারল্যাসে বিপ বিপ শব্দ করে মেসেজ আসে। সেটি শুনে তারা আবার সেই মেসেজের উত্তর দেয়। এই বিপ বিপ শব্দ করে যে মেসেজ আদান-প্রদান হয় সেটাই আসলে মোর্স কোড কৌশল। কোনো ভাষার বর্ণকে ছন্দের মাধ্যমে কোডে রুপান্তর করার কৌশলই হচ্ছে মোর্স কোড। প্রতিটি অক্ষরের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয় ডট [.] আর ড্যাস [-]। যেমন, ইন্টারন্যাশনাল মোর্স কোড চার্ট অনুযায়ী ইংরেজি বর্ণ অ-এর মোর্স কোড হচ্ছে ডট ড্যাস [. -], গুগলে সার্চ করেলে ইন্টারন্যাশনাল মোর্স কোডের চার্টটি পেয়ে যাবেন। এটি যখন টেলিযোগাযোগের জন্য প্রেরণ করা হয় তখন বুঝানোর জন্য বিপ শব্দের ব্যবহার করা হয়। ডট [.]- এর জন্য ছোট বিপ আর ড্যাস [-]-এর জন্য বড় বিপ শব্দের ব্যবহার করা হয়। কেউ যদি চান তাহলে এই সাইটে গিয়ে আপনার মেসেজটিকে মোর্স কোডে পরিবর্তন করে নিতে পারেন।
১৮৪০ সালে স্যামুয়েল মোর্স এই কোডটি তৈরি করেন। বর্তমানে মেসেজ আদান-প্রদানের পদ্ধতি পরিবর্তিত হলেও পেশাগতভাবে পাইলট, এয়ার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণকারী, জাহাজের ক্যাপ্টেন ও সামুদ্রিক স্টেশন চালনাকারীদের মোর্স কোড সম্পর্কে খুব ভালো জ্ঞান রাখতে হয়।
এবারে আসি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত কৌশল ক্রিপ্টোগ্রাফি নিয়ে। ক্রিপ্টোগ্রাফি আসলে কী? একটু উদাহরণ দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করছি। আচ্ছা বলুন তো ুঃরৎঁপবংৎবনুপ এইখানে কী লিখা আছে? কি হিজিবিজি মনে হচ্ছে? এখন আমার ইংরেজি লিখাটা উল্টো করে পড়–ন, তাহলে কী হয়? পুনবৎংবপঁৎরঃু। এই যে আমি উল্টো লিখার যে কৌশলটি ব্যবহার করলাম এবং এটি কীভাবে পড়তে হবে তা আপনাদের জানিয়ে দিলাম এটাই ক্রিপ্টোগ্রাফি অর্থাৎ লিখাটির এক ফরম্যাট থেকে অন্য ফরম্যাটে পরিবর্তন করার কৌশল যা শুধু প্রেরক ও প্রাপকই জানবে তৃতীয় কেউ এটা বুঝবে না সেটাই ক্রিপ্টোগ্রাফি বা তথ্যগুপ্তবিদ্যা। ক্রিপ্টোগ্রাফি ব্যাপারটা নতুন কিছু নয়। এটি অনেক পুরাতন পদ্ধতি। আগে এ ধরনের লেখার উদ্ভব ঘটে মূলত গোপনীয় কোনো বার্তা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পাঠানোর উদ্দেশ্যে। তবে বর্তমান যুগে গণিতশাস্ত্র, কম্পিউটার বিজ্ঞান, ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং এসব বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এর ব্যপক ব্যবহার হয়। ক্রিপ্টোগ্রাফির জন্য রটার মেশিন ও এনিগমা চর্চায়ও ক্রিপ্টোগ্রাফি ব্যবহৃত হয়। ১৯২০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ক্রিপ্টোগ্রাফির ব্যাপক প্রচলন ঘটে। মেশিনের ব্যবহার ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য।
কম্পিউটার-প্রযুক্তির দ্রæত উন্নয়নের কারণে জটিলতর হয়ে উঠেছে গোপন ভাষা। ফলে আগে পর্যন্ত যেসব পদ্ধতি ব্যবহার করে গোপন বার্তার পাঠোদ্ধার করা হতো এখন সেই পাঠোদ্ধার করার প্রক্রিয়াতেও ঘটছে পরিবর্তন। সাইবার জগতে ক্রিপ্টোগ্রাফির ভ‚মিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইন্টারনেটে আমরা যে তথ্য আদান-প্রদান করি সেটি নিরাপদ রাখার জন্য ক্রিপ্টোগ্রাফি কৌশল ব্যবহার করা হয়। হ্যাকিং-এর একটা পদ্ধতি আছে যাকে ম্যান ইন দ্যা মিডল এট্যাক বলা হয়। নাম শুনেই বুঝতে পারছেন দুই পক্ষের মাঝখানে তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি। মনে করুন, আপনি ব্যবসার লেনদেনের জন্য পাওনাদারকে আপনার ব্যাংকের একাউন্ট নম্বর ই-মেইল করলেন এবং ডিপোজিট করতে বললেন। এখন মাঝখান থেকে হ্যাকার কৌশলে আপনার ই-মেইলটি পড়ে ফেলল এবং আপনার একাউন্ট নম্বরের জায়গায় তার একাউন্ট নম্বরটি বসিয়ে দিল তাহলে ফলাফল কী হবে বুঝতেই পারছেন। আর ব্যাপারটি যদি এমন হতো যে আপনি ক্রিপ্টোগ্রাফি কৌশল ব্যবহার করে পাঠাতেন হ্যাকার মেইলটি পড়তে পারলেও সেখানে কী লিখা আছে তা বুঝতে পারত না। তেমনই আপনি ইন্টারনেটে কোনো সাইটে পাসওয়ার্ড দেয়ার সময়ও একই ঘটনা ঘটতে পারে। আপনার সমস্ত তথ্য চলে যেতে পারে হ্যাকারের কাছে। ওয়েবসাইটের ট্রাফিকের জন্য ২ ধরনের প্রটোকল ব্যবহার করা হয়। এইচটিটিপি আর এইচটিটিপিএস। এইচটিটিপিএস প্রটোকল তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। তাই যখনই আপনি দেখবেন ওয়েব ব্রাউজারে এইচটিটিপিএস দেখাচ্ছে তখনই আপনি মোটামুটি নিশ্চিন্ত মনে পাসওয়ার্ড দিতে পারবেন। ক্রিপ্টোগ্রাফি একটি জটিল বিয়য়। এটি মূলত নির্ভর করে এলগরিদম-এর ওপর। এটি নিয়ে পড়াশোনা করে আলাদা ডিগ্রি অর্জন করা যায়। যারা ক্রিপ্টোগ্রাফি নিয়ে গবেষণা করে তাদের বলা হয় ক্রিপ্টোনালিস্ট। ক্রিপ্টোগ্রাফির কিছু বেসিক টার্ম যেগুলো জানা প্রয়োজন। সাধারণ অবস্থায় ডাটা বা তথ্যকে বলা হয় প্লেইন টেক্সট। প্লেইন টেক্সটটাকে দুর্বোধ্য একটা রূপ দেয়ার প্রক্রিয়াটা হলো এনক্রিপশন। আর রূপান্তর ঘটার পর তার নাম হয় ‘সাইফার টেক্সট’। ডিক্রিপশন হচ্ছে সাংকেতিক বার্তাটিকে উদ্ধার করে পাঠযোগ্য অবস্থায় নিয়ে আসা। আর ‘কি’ হচ্ছে এমন একটি পদ্ধতি যা জানা থাকে শুধু বার্তাপ্রেরক আর গ্রহীতার এবং যার মাধ্যমে ওই গোপন লেখাটি ডিক্রিপ করা যায়। তবে ক্রিপ্টোগ্রাফিও যে সবসময় শতভাগ সুরক্ষিত তা কিন্তু নয় কারণ পদ্ধতিটি মানুষেরই তৈরি আর মানুষই জানে এটাকে কীভাবে ডিক্রিপ করতে হয়। ক্রিপ্ট্যানালাইসিস করে ক্রিপ্টোগ্রাফি ব্রেক করা সম্ভব। এটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বেআইনী। ক্রিপ্টোগ্রাফি নিয়ে আগ্রহী হলে দ্যা ইমিটেশন কোড এবং দ্যা ভিঞ্চি কোড এই দু’টা চলচ্চিত্র দেখে নিতে পারেন। আশা করি গোপনবার্তার রহস্য কিছুটা হলেও জানাতে পেরেছি।