গাউছুল আজম মওলানা শাহ্ছুফী সৈয়দ আহম্মদ উল্লাহ(ক.)

648

মাইজভান্ডারী শরাফতের প্রাণপুরুষ অলিকুল শিরোমণি হযরত গাউছুল আজম শাহসূফি সৈয়দ মওলানা শাহ্ছুফী সৈয়দ আহম্মদ উল্লাহ (ক.)। সুগভীর দিব্যদৃষ্টির অধিকারী কাদেরীয়া ত্বরিকার অন্যতম খ্যাতিমান সাধক উচ্চ মর্যাদার অলিউল্লাহ আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ্ (র.) এর মতে, ‘গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী হলেন বেলায়তের কুলকিনারাহীন এক মহাসমুদ্র’। আরো উল্লেখ্য যে আহ্লে সুন্নাত ওয়াল জামাতের ইমাম, আশেকে রসুল (দ.) হযরতুল আল্লামা গাজী আজিজুল হক শেরে বাংলা (র.) তার বিখ্যাত দিওয়ানে আজিজ গ্রন্থে হযরত আহমদ উল্লাহ (ক.) এর নামের আগে “গাউছুল আজম” উপাধি শাহানশাহে মদিনার মহান দরবার থেকে এসেছে উল্লেখ করেছে। এছাড়া পয়গাম্বর কুলের সর্দারের হাতে দুটি নুরানী মুকুট ছিল, তৎমধ্যে একটি হুজুর গাউছুল আজম হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রা.) এর মাথায় অপরটি হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারীর মাথায় পরিয়ে দিয়েছে। সেজন্য তাঁকে পৃথিবীর পূর্বাঞ্চলীয় দেশসমূহের বা পূর্বাঞ্চলে জন্ম নেয়া গাউছুল আজম ও উম্মতে মুহাম্মদীর উজ্জ্বল প্রদীপ হিসাবেও আখ্যায়িত করেছেন। সে কারণে তার দরবার হতে কেয়ামত পর্যন্ত বিশ্বমানবতার জন্য দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ ধারা অব্যাহত থাকবে (দিওয়ানে আজিজ)। একটি কথা সর্বজন স্বীকৃত যে, এই ভারত উপমহাদেশে আউলিয়া কেরামরাই ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত ও প্রসারিত করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় আল্লাহ ও রসুলের অশেষ মেহেরবানীতে মানবের রূপ ধরে বাংলার জমিনে গাউছুল আজমের আগমনে বিশ্ববাসী ধন্য হয়েছে। বিশিষ্ট সুফীতাত্বিক গবেষক ও বুজুর্গ হযরত মুহিউদ্দীন ইবনুল আরবী তার “ফুছুছুল হেকম” গ্রন্থে হযরত গাউছুল আজম মাওলানা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (ক.) এর আগমন ও তার গাউছুল আজম হওয়ার ভবিষ্যৎবাণী করে গেছেন।
১৮২৬ সালে হিজরি ১২৪৪, ১২৩৩ বাংলা, ১লা মাঘ রোজ বুধবার হযরত মাওলানা শাহসুফী সৈয়দ আহম্মদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (ক.) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আওলাদে রাসুল ছিলেন। তার পিতার নাম সৈয়দ মতিউল্লা (র.) ও মাতার নাম সৈয়দা খায়রুননেছা বিবি (র.)।
গাউছুল আজম হযরত আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (ক.) তদানীন্তন ভারতবর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মীয় বিদ্যাপীঠ কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করার পর হিজরি ১২৬৯ সালে তিনি যশোর জেলায় কাজী (বিচারক) পদে যোগদান করেন। ১২৭০ হিজরীতে কাজী পদ থেকে পদত্যাগ করে কলকাতার মুন্সী বু-আলী মাদ্রাসার প্রধান মোদাচ্ছের পদে যোগদান করেন। আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী খোদা প্রাপ্তির পথে অর্থাৎ কাদেরিয়া তরিকার সাজ্জাদানশীন খলিফা হযরত আবু শাহমা মুহাম্মদ সালেহ লাহোরী (র.)এর হাতে বায়াতগ্রহণ এবং শাহ দেলোয়ার আলী পাকবাজ (র.) এর কাছ থেকে কুতুবিয়তের ফয়েজ অর্জন করেন এবং পরবর্তীতে কাদেরিয়া তরিকার উপর ভিত্তি করে নিজেই এক তরিকার প্রবর্তন করেন। যা মাইজভান্ডারী তরিকা হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। তিনি কোরআান ও সুন্নাহর আলোকে যুক্তির নিরিখে এবং আধ্যাতিœক উপলব্দির প্রেক্ষাপটে ইসলামে চিন্তা দর্শনকে একটি ব্যাপক ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়েছেন। এ ভিত্তির উপর যে দর্শন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাই মাইজভান্ডারী দর্শন। একবিংশ শতাব্দী এমনকি অনাগতকালের প্রেক্ষাপটে সর্ব মানুষের জন্য কল্যাণকর ও গ্রহণযোগ্য একটি বৈপ্লবিক চিন্তা দর্শন হিসাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। মাইজভান্ডারী দর্শনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যসমূহ বহুমুখী এবং ব্যাপক। এগুলোকে আবদ্ধ করে শেষ করা যাবে না। কারণ একজন মানুষের দেহ, মন, চিন্তাধারা , আত্মা তথা প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সর্ববিদ শুদ্ধাচার অনুশীলনই হচ্ছে মাইজভান্ডারী দর্শনের মূল কথা। ইসলামের আভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যহচ্ছে বিনয়, আদব ও মহব্বত।
আল্লাহর কাছে যে বিনীত, আল্লাহ তাকে জীবনে উন্নত করেন। আদব বুলন্দ নসীবের সোপান। মহব্বত দেয় সান্নিধ্য। মাইজভান্ডারী দর্শন মানুষকে, বিনয়, আদব ও মহবত শিখায়। মানব সভ্যতার বিস্ময় শাশ্বত মাইজভান্ডারী দর্শন। এ মহান ত্বরীকাপন্থীদের প্রধান অনুসঙ্গ সেমা বা সুগঙ্গীত চর্চা। ‘রুহে হাইওয়ানিয়াত’ বা কু-রিপু তাড়িত বিশ্বব্যাপী ভোগবাদী সংস্কৃতির প্রেক্ষিতে মাইজভান্ডারী মাহফিলের “সামা” শুধু একটি প্রস্তাবনা নয় বরং অনিবার্য। মাইজভান্ডারী গানের পবিত্র আবহ মানুষের হৃদয়ে প্রবিষ্ট করে বিবেককে নাড়া দেয়। পাশবিকতাকে করে সুপ্ত, মানবিকতাকে করে উজ্জ্বীবিত।
হযরত ‘গাউছুল আজম’ মাইজভান্ডারী (ক.) এর বেলায়তের পরশ পেয়ে অসংখ্য অগনিত খোদা সন্ধানী মানুষ অলিউল্লাহ হয়েছেন এবং কেয়ামত পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত থাকবে। তিনি এমন এক খোদা-প্রদত্ত শ্রেষ্ঠত্ব অলি, যিনি খোদার ইচ্ছা শক্তিতে তার গাউছে আজমিয়তের প্রভাবে জনগণের না হওয়ার মত কাম্য বস্তুকে হওয়ার রূপ দিয়াছে। তার অসংখ্য কেরামত লিপিবদ্ধ করে শেষ করা যাবে না। তারপরও দু-চারটি উল্লেখ না করলে নয়।
১. তার আধ্যাত্মিক প্রভাবে মোহছেনিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা ও মোদারেছ নিযুক্তি। ২. হযরতের আধ্যাত্মিক প্রভাবে একরাতে মক্কা শরীফ হতে চট্টগ্রাম শহরে হাজীর প্রত্যাগমন। ৩. হযরতের আদেশে রেয়াজউদ্দিন উকিলের ভূ-সম্পত্তি খরিদ ও রেয়াজউদ্দিন বাজারের পত্তন। ৪. হযরতের বেলায়তী প্রভাবে মৃত্যুকালে আজরাইল ফেরত ও ষাট বছর আয়ু বৃদ্ধি। এই ধরনের উচ্চমার্গীয় কেরামত তার গাউছে আজমিয়তের পরিচয় বহন করে। তার সমসাময়িককালে শরীয়তের উচ্চ স্থরের জ্ঞান সম্পন্ন আলেমরা মাইজভান্ডারী ত্বরিকার বিরোধীতা করতে গিয়ে তার রূহানী ফয়েজের মাধ্যমে জগত বিখ্যাত অলিউল্লাহ হয়েছে অসংখ্য। তাই বর্তমান বিশ্বে হানাহানি, খুন, খারাবী, ফেৎনা ফ্যাসাদে লিপ্ত না হয়ে মাইজভান্ডারী দর্শনকে অনুসরণ ও অনুকরণ করে বর্তমান বিশ্বমানবতাকে আমরা সুন্দর ও শান্তির পথে এগিয়ে নিতে পারি। এই মহান গাউছুল আজম মানবজাতির জন্য অশেষ কল্যাণের ধারা অব্যাহত রেখে ৭৯ বছর বয়সে ২৩ জানুয়ারি ১৯০৬ ইং ১০ মাঘ ১৩১৩ বঙ্গাব্দ সোমবার দিবা গত রাতে মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভে ইহধাম ত্যাগ করেন। আল্লাহ যেন গাউছুল আজম মাইজভান্ডারীর উছিলায় আমাদেরকে মৃত্যুর সময় ও কবর, হাশর, পুলসিরাতে, ক্ষমা করেন, আমিন।

লেখক: প্রাবন্ধিক