‘গলাকাটা’ ট্যাক্সিভাড়া অসহায় যাত্রীরা

42

স্কুল শিক্ষিকা রুজিনা নাসরিন রুমি আগ্রাবাদ এক্সেস রোডের শান্তিবাগ আবাসিক এলাকা থেকে ছেলেকে নিয়ে কোচিংয়ে আসেন মাদারাবাড়িতে। প্রায় সময় তিনি সিএনজি চালিত ট্যাক্সিযোগে একশ’ টাকা ভাড়া দিয়েই আসতেন। কিন্তু ঈদে চালকরা হঠাৎ বাড়িয়ে দেন ৫০ টাকা। এরপর আসা-যাওয়া বাবদ ভাড়া দিতে হচ্ছে ৩০০ টাকা। প্রতিবাদ করেও ফল নেই। আসা-যাওয়ায় ৩০০ টাকা ভাড়া দিতে বাধ্য হচ্ছেন তিনি। অবশ্য একদিন দাবি করলেন মিটারে আসবেন। ট্যাক্সিচালক প্রথমে রাজি না হলেও পরে রাজি হন। ভাড়া আসল ৭৫ টাকা। কিন্তু একবারই। কোন চালকই মিটারে আসতে কেউ রাজি নন। সিএমপি বা ট্রাফিক বিভাগসহ কারো নিয়ন্ত্রণ নেই ট্যাক্সিভাড়া তদারকিতে।
আন্দরকিল্লা মোড় থেকে ষোলশহর দু’নম্বর গেট যাবেন চাকরিজীবী ইমরান কাদের। তার কাছ থেকেও আদায় করা হয় ১৫০ টাকা। চেরাগী মোড় থেকে কাজীর দেউড়ি মোড় যেতেও আদায় করা হচ্ছে ৮০ টাকা। এভাবে ট্যাক্সিচালকদের কাছে জিম্মি নগরবাসী। যাত্রীরা তাদের কাছে অসহায়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ট্যাক্সিভাড়ায় কোন নিয়মের বালাই নেই। চালকরা ইচ্ছেমত ভাড়া আদায় করছেন। এ নিয়ে কথাকাটাকাটি, হাতাহাতি নিত্য ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
নগরীতে বৈধ ট্যাক্সি রয়েছে ১৩ হাজার। কিন্তু অবৈধ রয়েছে প্রায় ৫ হাজার। এসবের গ্যাস সিলিন্ডার ও ইঞ্জিন মেয়াদোত্তীর্ণ। যে কোন সময় বিস্ফোরণ ঘটে বিপদ ঘটতে পারে। এরই মধ্যে ঘটেছেও। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী বিআরটিএ মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার বাদ দিয়ে নতুন সিলিন্ডার সংযোজনের সিদ্ধান্ত নেয়। ইতিমধ্যে কয়েক হাজার ট্যাক্সি স্ক্র্যাপ করা হয়েছে এবং তা অব্যাহত রয়েছে।
নগরীতে সহজলভ্য বিধায় দ্রæত গন্তব্যে পৌঁছতে ট্যাক্সি ব্যবহার করেন নগরবাসী। কাছাকাছি হলে রিকশা এবং কিছুটা দূরে যেতে হলে ট্যাক্সিতেই যান লোকজন। কিন্তু এর সুযোগ নেন ট্যাক্সিচালকরা। শুরুতেই দেড়শ’-দু’শ’ টাকা ভাড়া হাঁকেন তারা। অনেকে দর কষাকষিও করতে চান না।
দেখা যায়, এক সময় নগরীতে ৫০-৬০ টাকার বেশি ট্যাক্সিভাড়া ছিল না। এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে গেলেও বড় জোর ৬০ টাকা নেয়া হত। শহরের বাইরে গেলে ১০০ টাকা পর্যন্ত নেয়া হত। বর্তমান চিত্র সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। মিটারের চাইতে দু’তিনগুণ বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।
কোতোয়ালী মোড় থেকে কদমতলী যেতে ভাড়া আদায় করা হয় ৮০ থেকে ১০০ টাকা, নিউ মার্কেট মোড় থেকে আগ্রাবাদ যেতে ১৫০ টাকা, পোর্ট কানেক্টিং রোড ১৫০ থেকে ২০০ টাকা, আন্দরকিল্লা মোড় থেকে বহদ্দারহাট মোড় ১৫০ টাকা আদায় করা হয়। মোট কথা ৮০-১০০ টাকার নিচে ভাড়াও নেই ট্যাক্সির। কোন কোন ক্ষেত্রে দ্বিগুণ থেকে আড়াইগুণ পর্যন্ত ভাড়া আদায় করা হয়।
ভাড়া নিয়ন্ত্রণে রাখতে ট্যাক্সিতে চালু করা হয়েছিল মিটার। ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে নগরীতে মিটারে ট্যাক্সি চলাচল বাধ্যতামূলক করে বিজ্ঞপ্তি জারি করে সিএমপি। কিন্তু পরবর্তীতে মিটার সংযোজনের সময় এক মাস বাড়িয়ে দেয়া হয়। সর্বশেষ ওই বছরের ২৭ জানুয়ারি সিএনজি ট্যাক্সি চালক-মালিক এবং বিআরটিএর প্রতিনিধিদের সঙ্গে পুলিশের বৈঠকে তারা সে বছরের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে মিটার সংযোজনের অঙ্গীকার করেন। পরবর্তীতে ১ ফেব্রæয়ারি থেকে নগরীতে মিটারে সিএনজি ট্যাক্সি চালানো বাধ্যতামূলক করা হয়।
প্রথমদিকে পুলিশ ও বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) রাস্তায় নেমে মিটারবিহীন সিএনজি ট্যাক্সির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে প্রায় ১৭শ সিএনজি ট্যাক্সির বিরুদ্ধে মামলা ও বেশকিছু ট্যাক্সি জব্দ করে। কিন্তু এর কিছুদিন পরই অভিযান আক্ষরিক অর্থে হয়ে পড়ে কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ।
সিএমপি’র উপ-কমিশনার (ট্রাফিক) হারুন অর রশীদ হাজারী বলেন, প্রতিটি ট্যাক্সিতে মিটার লাগানো হয়েছে। মালিক-চালকরা বলছেন, সেগুলো অকেজো হয়ে গেছে। বিষয়টি আমরা আবার নতুন করে দেখব। তবে কেউ অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করলে ট্রাফিক পুলিশের সহায়তা নিতে পারেন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য পুলিশ সদস্যদের নির্দেশ দেয়া রয়েছে।
জানা যায়, ২০০২ সালের শেষ দিক থেকে সিএনজি ট্যাক্সি চলাচল শুরু হয়। শুরুতে ট্যাক্সিগুলোর আয়ুষ্কাল (ইকোনমিক লাইফ) ছিল ৯ বছর। কিন্তু মালিকপক্ষের দাবির মুখে এগুলোর মেয়াদ তিন দফা বাড়িয়ে ১৫ বছর করা হয়। যাত্রী ভাড়া পাঁচবার এবং জমা (ভাড়া হিসেবে চালকদের কাছ থেকে মালিকপক্ষ যে টাকা নেন) বাড়ানো হয় তিন দফা। এমন সুবিধা দেওয়ার পরও সিএনজি ট্যাক্সি খাতটি বিশৃঙ্খলই থেকে যায়। এমন অবস্থায় ১৫ বছরের মেয়াদ শেষ করা ট্যাক্সিগুলো নতুন করে প্রতিস্থাপন করেছে বিআরটিএ।
দেখা যায়, নগরীতে চলাচলরত প্রতিটি ট্যাক্সিতেই অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। চালকরা কোন কথাই শুনতে চান না। গত ঈদে ভাড়া আরও বাড়ানো হলে, সে ভাড়া আর কমানো হয়নি। নগরীর কোন ট্যাক্সিই মিটারে চলে না বললেই চলে। মিটারবিহীন ট্যাক্সির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) ও নগর ট্রাফিক পুলিশের কোন অভিযান নেই ।
চট্টগ্রাম বেবিট্যাক্সি-টেম্পো ড্রাইভার ও সহকারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম সরকার বলেন, ট্যাক্সিগুলোতে যেসব মিটার সরবরাহ করা হয়েছে, সেগুলো নি¤œমানের। এসব লাগানোর কয়েকদিনের মধ্যেই অকেজো হয়ে গেছে। এ কারণেই দর কষাকষি করে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়।