গর্ভবতী গরীব নারীদের নির্ভরতার প্রতীক মেহেরুন্নেছা

65

সন্দ্বীপের মেহেরুন্নেছা একজন স্বাস্থ্য পরিদর্শক। দ্বীপের গ্রাম মগধরাতে তার জন্ম। এই গ্রাম তার বেড়ে ওঠা ও কর্মের ঠিকানা। এখানকার মানুষ যুগ যুগ ধরে চিকিৎসা সেবায় পিছিয়ে। ছোট বেলায় চিকিৎসার অভাবে গ্রামের সন্তানসম্ভবা অসহায় মায়েদের করুণ অবস্থা দেখেছেন নিজ চোখে। তখন থেকে স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে ডাক্তার হবেন। গ্রামের অসহায় ও গরীব মহিলাদের সেবায় এগিয়ে আসবেন। অল্প বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য হয়ে জীবনের সব স্বপ্ন এবং পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। তবে হাল ছাড়েনি মেহেরুন। শিক্ষক স্বামীকে বুঝিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যান। বি.এ. পাস করা মেহেরুন এক সময় নিয়োগ পান স্বাস্থ্য বিভাগে ‘স্বাস্থ্য কর্মী’ হিসেবে। ‘স্বাস্থ্য কর্মী’ হিসেবে গ্রামের মানুষের প্রতি তার দায়িত্ব পালনের সুনাম ছড়িয়ে পড়ায় এক সময় উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সুনজরে আসেন তিনি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এসবিএ(স্কিল বার্থ এটেনডেন্ট) ট্রেনিং-এর জন্য মেহেরুনের ডাক এলে তিনি সানন্দে যোগ দেন ওই প্রশিক্ষণে। ধাত্রীবিদ্যা ও প্রসূতিসেবার এই প্রশিক্ষণে মেহেরুন্নেছা ডেলিভারির কলা-কৌশলগুলো রপ্ত করতে সফলতার পরিচয় দেন। স›দ্বীপ উপজেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলুল করিম বলেন, ‘ প্রশিক্ষণ শেষে মেহেরুন বর্তমানে একজন ভাল ধাত্রী ও প্রসূতিসেবক হিসেবে পরিণত হয়েছেন। বেশ কিছুদিন ধরে তিনি ওই এলাকার অসহায় সন্তানসম্ভবা মায়েদের সফলতার সাথে সেবা দিয়ে আসছেন, এজন্য সরকারিভাবে আমরা তাকে পুরস্কৃতও করেছি’।
স্থলভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন সন্দ্বীপের চিকিৎসা সেবা বিভিন্ন কারণে অতি নাজুক। তাই যুগ যুগ ধরে এখানকার গর্ভবতী নারীদের জরুরি চিকিৎসার জন্য স›দ্বীপ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রাম যেতে হয়। এ ছাড়া স্বাভাবিক প্রসব রোগীদের ডেলিভারির জন্যও এখানে নেই উল্লেখযোগ্য সরকারি-বেসরকারি সেবাকেন্দ্র। গ্রামের সাধারণ পরিবারের নারীদের প্রসবে এখনও স্থানীয় ধাত্রী কিংবা প্রশিক্ষিত পরিবার পরিকল্পনা কর্মী বা স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর নির্ভর করতে হয়।
দ্বীপের প্রত্যন্ত মগধরা এলাকায় স্থাপিত মধ্য মগধরা কমিউনিটি ক্লিনিকে গ্রামের সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। সেবার পাশাপাশি এখানে গরীব রোগীদের বিনামূল্যে ২৯ আইটেমের ঔষধও দেয়া হয়। কিন্তু বিশেষত মেহেরুন্নেছা যোগদানের পর থেকে এ কমিউনিটি ক্লিনিকটি গরিব গর্ভবতী নারীদের প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য পরিচিত ও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তিনি ২০১১ থেকে এ ক্লিনিকে প্রসূতি নারীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। ২০১৪ থেকে এখানে গর্ভবতী মায়েদের ডেলিভারি শুরু করা হয়। এসবিএ ট্রেনিং প্রাপ্ত মেহেরুন্নেছা ডেলিভারির ক্ষেত্রে বেশ দক্ষতার পরিচয় প্রদর্শন করায় তার প্রতি দিন দিন সেবা গ্রহিতাদের আস্থা ও নির্ভরতা বাড়ছে ।
মগধরা ৪ নং ওয়ার্ডের রাসেলের স্ত্রী টুনি এ প্রতিবেদককে বলেন,‘ আমার প্রথম বাচ্চা হয় সিজারে। গত ৮/৯ মাস আগে ২য় বাচ্চা ডেলিভারির সময় হলে চিকিৎসকরা আমাকে চট্টগ্রাম হাসপাতালে চলে যাবার পরামর্শ দেয় কিন্তু আমার স্বামী দিনমজুর হওয়ায় খরচের অভাবে চট্টগ্রাম যাওয়া স¤ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত আল্লার ওপর ভরসা করে মেহেরুন্নেছা আপার আওতায় মগধরা কমিউনিটি ক্লিনিকে চলে আসি। আল্লার রহমতে আমি সুস্থভাবে সন্তান প্রসব করি’। গ্রামের গর্ভবতী নারীদের সেবায় অসামান্য অবদানের নিদর্শনস্বরূপ ক্লিনিকটিকে নির্বাচিত করে জেলা সিভিল সার্জন অফিসের নির্দেশে উপজেলা পর্যায়ে মেহেরুন্নেসাকে বিশেষভাবে পুরস্কৃত করা হয়। ক্লিনিকের সিএইচসিপি ইকবাল হোসেন জানান, প্রতিদিন কমপক্ষে ৮/১০ জন গর্ভবতী মা এখানে সেবা নিতে আসেন। তারা বেশির ভাগই গরিব। বিনামূল্যে তারা আয়রন, ক্যালসিয়াম, জিংক জাতীয় ঔষুধও নিয়ে যান। এ পর্যন্ত মেহেরুন্নেছার তত্ত¡াবধানে দুইশ’র অধিক গর্ভবতী নারীর সফল ডেলিভারি সম্পন্ন করা হয়েছে এ ক্লিনিকে। স›দ্বীপ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলুল করিম বলেন, ‘মেহেরুন্নেছার দক্ষতায় কমিউনিটি ক্লিনিকটি এলাকার গর্ভবতী মায়েদের নির্ভরতার কেন্দ্র হিসেবে পরিণত হচ্ছে’। মগধরা ইউপি চেয়ারম্যান এস.এম আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ মেহেরুন্নেছা এখানকার গর্ভবতী মায়েদের কাছে খুবই পরিচিত ও জনপ্রিয়’।
জানা গেছে, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দূরত্ব প্রায় ১৫ কিমি. হওয়ায় এলাকার গরিব রোগীরা এ ক্লিনিক থেকে প্রসূতি সেবা নিয়ে থাকেন। সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক মেহেরুন্নেছা এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘গ্রামের মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করেছেন। দুর্গম এ এলাকার গর্ভবতী মায়েদের সেবা পাওয়ার কোন সুযোগ নেই। তারা বেশিরভাগই গরিব অসহায়। আমি তাদের ভালবাসি, আমার উপর তাদের শতভাগ আস্থা। আমি ডাক্তার হতে পারিনি তবে স্বাস্থ্য বিভাগের বদৌলতে এসব অসহায় নারীদের প্রাথমিক সেবা দেয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছি, সাধ্য অনুযায়ী আমি তাদের সেবা দিয়ে যাচ্ছি’।