গণতান্ত্রিক ধারায় যোগ্যতার বিচারে একজন রাজনৈতিক নেতা নির্বাচন জরুরি

84

এবারের বিশ্বকাপ ফুটবল একটি উপমা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। যেখানে সারা বিশ্বে দ্বন্দ্ব সংঘাত লেগে আছে, গণতন্ত্রের নামে গণতন্ত্রের মূলমন্ত্রকে কালিমাময় করা হচ্ছে, ধর্মকে অপব্যবহার করা হচ্ছে, সংস্কৃতিকে বিকৃত করা হচ্ছে সেখানে এই বিশ^কাপ আসরটি বিশ্বভ্রাতৃত্বের উদাহরণ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। ফুটবল ঋড়ড়ঃনধষষ বাংলায় বলি অথবা ইংরেজিতে বলি এই শব্দটির মত অধিক উচ্চারিত অথবা লিখিত শব্দ হয়ত নাই। সবার মুখে মুখে শুধুই এই একটি শব্দ। কোন ভেদাভেদ নেই। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র সবাইকে এক কাতারে এনেছিল এই আসর। এই একটি অদম্য শক্তি এই শব্দের মধ্যে বিরাজ করছিল। বিশ্বায়নের এই যুগে এই ফুটবল শব্দটি সারা বিশ্বকে আরো বেশি কাছে নিয়ে এসেছিল। এই একটি শব্দের মধ্যে উন্নত দেশ, উন্নয়নশীল দেশ, অনুন্নত দেশ প্রতিটি দেশের ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে, সাদা-কালো, লম্বা-খাটো, স্থুল-পাতলা গঠনে কোন ধরনের ভেদাভেদের চিহ্ন এই খেলা উপভোগের সময় লক্ষ্য করা হয় না। শুধুমাত্র যোগ্যতার বিচারে বিশ্বব্যাপী খেলোয়াড়দের নির্বাচনা করা হয়েছে। ধনী-দরিদ্রের মাপকাঠিতে নয় আবার সাদা-কালোর মাপকাঠিতে খেলোয়াড় নির্বাচন করা হয় নাই। এক্ষেত্রে কোন ধরনের সুপারিশও গ্রহণ করা হয় নাই। সম্পূর্ণ নিজগুণে ও গণতান্ত্রিক ধারায় একজন খেলোয়াড়কে নির্বাচন করা হয়। এমনকি বিশ্বকাপ খেলার সাথে জড়িত প্রতিটি সদস্যকে গণতান্ত্রিক মনমানসিকতায় কাজ করতে হয়। তবে স্বীকার করতে হয়, একটি গণতান্ত্রিক দেশে এভাবে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক খেলা চালিয়ে যাওয়া অনেক কষ্টকর। রাশিয়ায় খেলা চলাকালীন সময়ে কোন ধরনের পক্ষে বিপক্ষে প্রচারণা দেখা যায়নি। কিন্তু গত বিশ্বকাপে ব্রাজিলের পরিবেশটা ছিল বেশ উত্তপ্ত। এর পক্ষে ও বিপক্ষে বেশ জোড়ালো সমর্থন ছিল। একটি কার্টুন ব্রাজিলের বিশ্বকাপ আসরকে বিশ্বদরবারে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। ক্ষুদা-দারিদ্র্য পীড়িত ব্রাজিলের একজন কার্টুনিষ্টের আঁকা ছবিতে ‘একটি বাচ্চা খাবার টেবিলে ফুটবল খেতে বসে আছে’ বেশ আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় তুলেছিল। আবার ধর্মীয় দিকটি নিয়েও বেশ আলোচনা-সমালোচনা ছিল। একমাত্র ব্রাজিলেই আযান দেওয়া নিষেধ থাকায় মুসলিম সমর্থকদের এক অংশ ব্রাজিলকে সমর্থন করতে রাজি ছিল না।প্রজেক্টর এর মাধ্যমে খেলা দেখার কী যে আনন্দ তা এখনো সরাসরি উপভোগ করার ভাগ্য এখনো হয়নি। আমি নারী বলেই হয়ত এমনটি হয়েছে। নারী বলেছি কারণ নারীর অবস্থান একমাত্র নারীই জানে। এই সত্যটি আরো বেশি উপলব্ধি করেছি বিশ্বকাপ ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে। আমার বিল্ডিং এর তিন তলা জানালার পাশেই প্রজেক্টর বসিয়ে এলাকার ছেলেরা বিশ^কাপের খেলাগুলো উপভোগ করত। আমার বিল্ডিং থেকে মাত্র চার/পাঁচ হাত ব্যবধানে প্রজেক্টর বসানো হয়েছিল। আর আমি তিন তলার জানালা দিয়ে ছেলেদের আনন্দ উল্লাস উপভোগ করতাম। প্রজেক্টর সানসিটের নিচে থাকায় খেলা দেখতে পারতাম না। আমার বেড রুমের বিশাল স্কিনের টিভিতে বেশ ভাল করেই খেলা উপভোগ করতাম। বেশ উচ্চ ভলিয়মে খেলা দেখতে ভাল লাগত। কারণ যারা ধারাভাষ্য দেন তাদের প্রতিটি শব্দ শোনার চেষ্টা করতাম। এক একটি শব্দ, এক একটি ফাউল, এক একটি কীক অর্থাৎ প্রতিটি মুহূর্তকে ধারাভাষ্যকারেরা এমনভাবে বর্ণনা করেন তাতে খেলা দেখার আনন্দটা আরো বেশি বেড়ে যায়। আমি স্বীকার করছি, আমি খুব বেশি খেলা বুঝি না। তবে ক্রিকেট থেকে ফুটবল খেলা বেশি বুঝি। আর এই বেশি বুঝাটাকে আরো বেশি উপভোগ করি ধারাভাষ্যকারের কথাগুলোকে শুনে শুনে। যখন আমার টিভিতে উচ্চ শব্দে উল্লাস শুনি তখন ঘরের বাহিরে সেই একই অবস্থা। রাস্তায় ছড়িয়ে থাকা সেই সব ছেলেরা সবাই মিলে এমনভাবে উপভোগ করতে থাকে তখন নিজেও গিয়ে তাদের সাথে এক হতে ইচ্ছে করত।
কিন্তু বাস্তবতাকে অস্বীকার করা সহজ নয়। সংবাদ মাধ্যমে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা পড়তে পড়তে ও দেখতে দেখতে সেই সাহস আর হয় না। প্রতিদিন পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে এই ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনাগুলো প্রচারিত হয়ে থাকে। তখন জানালার ফাঁক দিয়ে ওদের পাগলামীগুলো উপভোগ করতাম। তবে একটা বিষয় বেশ ভাল লাগল, কোন দলাদলি নেই। যে দলেরই খেলা হোক না কেন সবাই একসাথে চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকত। কোন দল জিতলে সবাই একসাথে আনন্দ করত। আর কোন দল হারলে সবাই একসাথে ভুয়া ভুয়া বলে চিৎকার ও লাফালাফি করত। বিশেষ করে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের খেলায়। তাদের এমন অবস্থায় বুঝা যেত না কে আর্জেন্টিনা আর কে ব্রাজিলের সমর্থক। আমাদের দেশের নারী ফুটবলাররা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাদের এক একটি জয় আমাদের দেশের মেয়েদের যোগ্যতা প্রমাণ করে চলেছে। বিদেশের মাটিতে মারিয়া, তোহুরা, সানজিদা বেশ দাপটের সাথে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে। ভূটানে শেষ হওয়া সাফ অনূর্ধ্ব ১৮ টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এই নারী খেলোয়াড়দের সংবর্ধনা দেন। তাদের আরো এগিয়ে যেতে উৎসাহ দেন। মালেশিয়ায় এশিয়া কাপের শিরোপা জয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশের মেয়েরা ক্রিকেট অঙ্গনে যে সুনাম অর্জন করেছে তাতে তাদের অবস্থান অনেক দৃঢ় হয়। আমাদের দেশের নারী ক্রিকেটাররা আইসিসি টি ২০ বিশ^কাপে কোয়ালিফাই হয়েও আবার প্রমাণ করেছে ইচ্ছাশক্তি ও পৃষ্ঠপোষকতায় তারা তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে পারবে। আর দুঃখের বিষয়, ছেলে ক্রিকেটারদের যে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় তার সিকে পরিমাণ মেয়ে ক্রিকেটাররা পায় না। সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ক্রিকেট বোর্ড কিছুটা সদয় হয়েছে। একজন নারী হিসেবে নয় অথবা একজন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয় সেই সময়ের ফুটবল জগতের আরো একজন আলোচিত ব্যক্তিত্ব হচ্ছে ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট কলিন্দা গ্রাবার কিভারোভিচ। ক্রোয়েশিয়ার প্রতিটি ম্যাচেই দেখা গেছে তাঁর ঝলমলে উপস্থিতি। বিশ্বব্যাপী এই নারী প্রেসিডেন্টকে নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা কম হয়নি। এমনকি ক্রোয়েশিয়ার ব্যর্থতার পিছনে এই নারী প্রেসিডেন্টকে কেহ কেহ দোষারোপ করতে পিছপা হয় না। অথচ তার অনুপ্রেরণা ছিল একজন সাধারণ সমর্থকের পাশাপাশি একজন প্রেসিডেন্টের। কোন ধরনের প্রটোকল মেনে চলেনি। নিজেদের খেলোয়াড়দের সমর্থনে একজন মায়ের স্নেহ-মমতায় সমর্থন করেছেন। কিন্তু নারী বলে হয় বেশি আলোচিত ও সমালোচিত। সংবিধানের সপ্তদশ সংশোধনী বিলে নির্বাচনের বিধান না রেখে সংরক্ষিত নারী আসন ২৫ বছর বহাল রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অথচ নারী সংসদ সদস্যদের ব্যক্তিত্ব ও সামর্থ্য অনেকাংশে প্রভাবিত করতে পারে এই বিলটি। এই বিল পাশ হওয়ার ফলে ভবিষ্যতে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়া আরো দুর্বল হবে। অথচ এই বিল সরকারের দেওয়া বক্তব্য, গৃহীত নীতি, জাতিসংঘ ঘোষিত সিডও সনদ ও এসডিজির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এর ফলে পরবর্তী প্রজন্মের নারীসমাজ বঞ্চিত হবে। ধিক্কার জানাবে। বর্তমান বাংলাদেশ এখন নারী সংসদের যোগ্যতা ও সামর্থ্য খাটো করে গণতান্ত্রিক উপায়ে এগোতে পারবে না। এখন নারীরা অনেক এগিয়ে। নিজ গুণে ও নিজ যোগ্যতায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে তাহলে একজন সংসদের সত্যিকারের মর্যাদা লাভ করতে সক্ষম হত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বীয় উদ্যোগেই নারী খেলোয়াড়দের মূল্যায়ন আরো অনেক বিজয় এনে দিতে পারে।
‘খেলাকে বলুন হ্যাঁ, মাদককে বলুন না’। এই স্লোগানকে সামনে রেখে দেশব্যাপী বড় পর্দায় দেখানো হয়েছিল বিশ^কাপ ফুটবলের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য খেলা। এই উদ্যোগটি গ্রহণ করেছিল ফিফা বিশ্বকাপ ২০১৮ এর অফিশিয়াল পার্টনার কোলা-কোলা। এই উদ্যোগে ২০টি জেলার ৪৫টি স্থানে সরাসরি দেখানো হয়েছিল এই ফুটবল খেলা। এই আয়োজনের সহযোগী প্রথম আলো বন্ধুসভা, প্রায় ৩৯-৪০টি স্থানে খেলা দেখানো হয়েছিল। বর্তমান প্রজন্মের পাশাপাশি বয়স্করা নানাভাবে নানা অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অভাবে মাদকের মত ভয়াবহ জিনিসের প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়ছে। তাই এক মাসব্যাপী বিশ্বকাপের আয়োজনে অনেকেই একটি নিয়মমাফিক সৃষ্টিশীলতার সাথে জড়িত ছিল। তাদের আলাপ-আলোচনার বেশ সময় জুড়ে ছিল বিশ্বকাপের বিষয়। অনেকে এই ক্ষেত্রে নিজেকে অনেক অপরাধমূলক কাজ থেকে বিরত রাখতে সক্ষম হয়েছিল। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে আমাদের দেশের কৃতী সন্তান জাওয়াদ চৌধুরী স্বর্ণপদক, ৩টি ব্রোঞ্জ ও অনারেবল মেনশন পদক জয় করেছে। এই অর্জন আমাদের তরুণ শক্তিকে বিশ^দরবারে পরিচিত করেছে। তাছাড়া ফ্রান্সের এমবাপেও ১৯ বছর বয়সী আরেক ফুটবল তারকা। এই তরুণের জয়গান এখন বিশ্বব্যাপী। আমাদের তরুণ সমাজ এখন একটি অস্থির সময় পার করছে। এই তরুণ সমাজ নিয়ে একদিকে যেমন অভিভাবক অন্যদিকে সমাজ ও রাষ্ট্র চিন্তিত। বন্ধু নির্বাচন হতে শুরু করে তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ এখন সকলকে বেশ নজরদারি করতে হচ্ছে। অথচ তারাই আমাদের ভবিষ্যৎ। তাছাড়া আমাদের দেশে কতিপয় রাজনীতিক ও শিক্ষাবিদ আছেন যারা নিজেদের স্বার্থে তরুণ প্রজন্মকে নেতিবাচক কাজে চালিত করে। অথচ বিশ^কাপের খেলাকে কেন্দ্র করে কোথাও কোন মারামারি ও দলাদলির সংবাদ প্রকাশিত হয়নি। খেলাকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে রেখে বরং আনন্দ ভাগাভাগি করছে। বিশ্বকাপে স্টেডিয়ামে সকলের সক্রিয় সমর্থনে কোন খেলাকে বিঘ্ন ঘটায় না। কিন্তু রাজনৈতিক দলের সক্রিয় সমর্থনে দেশের রাজনীতিতে অস্থিরতার সৃষ্টি করে। সক্রিয় সমর্থন বলতে অন্ধ সমর্থন। বিবেক বিবেচনা ও যুক্ত তর্কের ঊর্ধ্বে উঠে এই ধরনের সমর্থন দেশকে ও দলকে জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলে। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণে দেয়া যায়, গণতন্ত্র উদ্ধারের নামে যেসব ঐক্য প্রক্রিয়া চলছে তা গণতন্ত্র চর্চাকে আরো জটিল করে তুলছে। ক্ষমতাকে নয়, জনগণ ও দেশকে ভালোবেসে গণতন্ত্র চর্চা করলে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়বে।
লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক