খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর ও মামলার বিচার কার্যক্রম দ্রুত করতে হবে

37

অর্থনীতি ও উন্নয়নের অন্যতম চালিকাশক্তি ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজ করছে অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা। চরম অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে দেখা যায়, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৯৯ হাজার কোটি টাকার অধিক ঋণ, যা মোট ঋণের ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ। গত জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮৯ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। গতকাল দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ খেলাপির তালিকায় চট্টগ্রামের প্রায় ৬৪জন ব্যবসায়ীর নাম রয়েছে, যাদের ঋণের টাকার পরিমাণ ১২ হাজার কোটি টাকা। ব্যবসা পরিচালনার নামে দেশের তফসিলি ব্যাংক কিংবা বেসরকারি ব্যাংক থেকে এ বিশাল অঙ্কের টাকা নিয়ে হজম করে ফেলেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। ব্যাংকতৃপক্ষ এসব খেলাপি ঋণ আদায়ে নানারকম চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর আদালতের শরনাপন্ন হলেও তাতে সহজেই সমাধান হচ্ছেনা সমস্যার। বরং মামলার পরিচালনার দীর্ঘসূত্রতা এবং আইনের ফাঁকফোকরে ঋণ খেলাপিরা গা বাঁচিয়ে বেড়াচ্ছে। আমরা মনে করি, এ অবস্থার সহসা পরিবর্তন জরুরি। যেহেতু ব্যাংকিং খাতের টাকা জনগণের কষ্টার্জিত অর্থের আমানত, তাই এ খাতের দুর্বৃত্তদের কোনো ধরনের ছাড় দেয়ার অবকাশ নেই। জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে রাজনৈতিকভাবেই পরিবর্তন আসে। এতেকরে ব্যাংকগুলোতে রাজনৈতিক প্রভাব তো রয়েছেই, এ ছাড়া কোটি কোটি টাকা লেনদেন ছাড়া এমডি ও সিইও নিয়োগ হয় না। নিয়োগের পেছনে যারা টাকা ব্যয় করে তারা মূলত কোটি কোটি টাকার ঋণখেলাপি। রাষ্টায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে রাজনৈতিক দলের নেতারা আর বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে ব্যাংকের পরিচালকরা অনেক সময় প্রভাব বিস্তার করে ঋণ অনুমোদন করে। জানা যায়, এর পেছনে মধ্যস্বত্বভোগী কিছু দালালও সক্রিয় থাকে। এদের তৎপরতায় অনেক সময় যথাযথ প্রতিষ্ঠানকে ঋণ প্রদান না করে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে ঋণ প্রদান করা হয়। এসব ঋণ সময়ের ব্যবধানে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের নানা সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতির এবং সমৃদ্ধির উজ্জ্বল চিত্র আমাদের আশান্বিত করলেও আমাদের সব আশা ও উচ্ছ¡াস থেমে যায় ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধির অঙ্ক দেখলে। এ বিষয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে সবাই সচেতন এবং ওয়াকিবহাল। বিষয়টি সবাইকে বিব্রত করে, এ নিয়ে সরকারি বিভিন্ন মহলে এবং ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টদের মধ্যে দারুণ অস্বস্তি রয়েছে। বর্তমান অর্থমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণের পর খেলাপি ঋণের ব্যাপারে কঠোর মনোভাব পোষণ করেছিলেন। এক্ষেত্রে তার বেশ কিছু উদ্যোগও আমরা লক্ষ্য করেছিলাম। কিন্তু ধারণা করা হচ্ছে, উদ্যোগগুলো ক্রমান্বয়ে আগের অবস্থানে হারিয়ে যাচ্ছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, রাজনৈতিক ছত্রছায়া, উচ্চ আদালতে রিট, সর্বোপরি বিচার না হওয়ার কারণেই শেয়ারবাজার, হলমার্ক, যুবক ও ডেসটিনির মতো বড় বড় অর্থ আত্মসাৎ ও ঋণখেলাপির ঘটনা বাড়ছে। এমনকি নিয়ন্ত্রক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বলতা, রাঘব-বোয়ালদের বাঁচাতে উচ্চপর্যায়ের হস্তক্ষেপ এবং তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ না করার কারণে আর্থিক খাতের লুটেরারা উৎসাহিত হচ্ছে।
ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছাড়া অর্থ আত্মসাৎ সম্ভব নয়। অনেক ক্ষেত্রে ভুয়া কাগজপত্র ও অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে মোটা অঙ্কের ঋণ দেয়াই এর প্রমাণ। আমরা মনে করি, ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনতে হলে প্রথমেই ঋণখেলাপিসহ প্রতিটি অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তা-পরিচালকদের সাজা নিশ্চিত করতে হবে। একইসাথে খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত মামলার বিচার কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করার উদ্যোগ নিতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাবের কাছে বা মধ্যস্বত্বভোগী দালালদের কাছে যেন রিকভারি এজেন্টরা জিম্মি হয়ে না পড়ে সেদিকেও গভীর মনোযোগ দিবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ-এমনটি প্রত্যাশা আমাদের।