খুব কম সময়ের মধ্যে উপরের দিকে জাম্প দিবে

67

এক.
এখন আমি যে কথা বলছি, তা বুঝেশুনে, চিন্তাভাবনা করে বলছি। আবেগতাড়িত হয়ে বা কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে বলছিনা। আমার মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের সামনে আরো অনেক বেশি বাণিজ্য সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হতে যাচ্ছে। যদি আওয়ামীলীগ বাণিজ্যিক সম্ভাবনার বিষয়টি বুঝতে পারে, সরকারের চিন্তায় এসব বিষয় অগ্রাধিকার পায়, আমরা হয়ত কম সময়ের মধ্যে শক্তিশালী অর্থনীতির এক বাংলাদেশ দেখতে পাবো। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকার এবং উদ্যোক্তাগণ নানারকম সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হন। সকলবাধা ও সীমাবদ্ধতার পেছনে থাকে সম্ভাবনা। ভাল রাষ্ট্রনায়ক এবং দুরদর্শী উদ্যোক্তারা সম্ভাবনার হাতছানি দেখতে পান। আকাশ যতই ঢাকা পড়ুক মেঘের আড়ালে তার সূর্য হাসে। সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে আমরা আরেক বাংলাদেশ দেখতে পাবো, যা কারো কাছে হাত পাতবেনা, মাথানত করবেনা।
দুই.
আমার এক ছাত্র গার্মেন্ট্স ফ্যাক্টরীর মালিক। সে আমাকে বলে, স্যার রিয়েলি বাংলাদেশ অফুরান সম্ভাবনার দেশ। আমরা শুধু প্রাকৃতিক সম্পদের খনি, তা নয়, আমাদের ভার্চুয়াল সাইডে ও আমরারিচ্। আমাদের ম্যানপাওয়ার এক অস্বাভাবিক সম্ভাবনাময় সম্পদ। কেউ আমাদের পেছনে ফেলে যেতে পারবে না। ভিয়েলটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যানের বক্তব্য আমার কাছে আরো ভাল লেগেছে। কে এম রেজাউল হাসনাত একজন প্রতিথযশা উদ্যোক্তা। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যা হয়, মানুষের সাথে যে মিল- এটা একটা আর্শিবাদ। এ দেশের প্রায় সকল মানুষ একই ভাষায় কথা বলে। খুব কম সংখ্যক উপজাতি আছেন, তারা ছাড়া প্রায় সকলের ভাষা বাংলা। আমরা একই সংস্কৃতি অনুসরণ করি। এর সুবিধা অনেক। এর ফলে শ্রমিকরা বিভাজিত হন না। হোমোজিনিটি এক পজিটি ভফ্যাক্টর। ভারতে যান, চীনে যান, রাশিয়াতে যান- সেখানে এই সুবিধা উদ্যোক্তারা পাবেননা। আমি হায়দ্রবাদে যে হোটেলে থাকতাম, সেখানে দেখেছি হোটেলের কর্মচারীরা কেউ এসেছে উড়িষ্যা থেকে, কেউ নাগপুর থেকে, কেউ এসেছে দেরাদুন থেকে- কেউবা এসেছে আসাম থেকে। তাদের ভাষাগত, সংস্কৃতিগত, আচরন গত ফারাক লক্ষ্য করতাম। কিশোরের ভাষা একরকম, আর রামা কিষনের ভাষা অন্যরকম। আমরা অনেক হোমোজিনাস। এজন্য আমাদের দেশে শ্রম ঘন শিল্পের সম্ভাবনা অনেক বেশি। নৃতাত্ত্বিক ভিন্ন তার কারণে পৃথিবীর অনেক দেশে কারখানায় অসন্তোষ দেখা দেয়, বাংলাদেশে সে রকম আশংকা নেই।
বাংলাদেশের মানুষ সহজসরল ধর্মপ্রাণ। বাজে অভ্যাস মানুষের মধ্যে কম। মানুষ পরিশ্রমী। ধৈর্য্যশীল এই দেশের মানুষ। এই কারণে শ্রমিক কম মজুরি পেলেও সে চলতে পারে। কম আয় থেকে সে সঞ্চয় ও করে। শ্রমিকের মনে সন্তুষ্টি থাকে। অনেক দেশের মানুষ মজুরি পেলে তা অকারণে খরচ করে ফেলে। আজেবাজে অভ্যাস তাদের আছে। পয়সায় কুলায় না। এই অঞ্চলে আমাদের শ্রমিকরা খুব ভাল। আমাদের শ্রমিক শ্রেণী দেশের বড় সম্পদ।
আমাদের চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ব্যাংককে চিকিৎসা করতে গিয়ে ছিলেন। ব্যাংকক থেকে সুস্থ হয়ে চট্টগ্রামে আসার পর আমাকে গল্পচ্ছলে বলেছিলেন, আচ্ছা বলত, বাংলাদেশ গার্মেন্টে এত ভাল করছে কেন? মূল কারণ কি? কিছুক্ষণ পর তিনি বল্লেন, ব্যাংককে এক বৃটিশ ব্যবসায়ীর সাথে মহিউদ্দিন ভাইয়ের সাক্ষাৎ হয়েছিল। বৃটিশ ব্যবসায়ী মহিউদ্দিন ভাইকে বলেছিল, তোমাদের দেশে পোশাক শিল্প এত লাভজনক কেন জান? কারণ তোমাদের দেশে গার্মেন্টে যে মেয়ে শ্রমিক আছে, তাদের সকলের হাতের আঙ্গুল ফাউন্টেন পেনের নিবের মতো আগা চিকন। ফলে সেলাইয়ের ক্ষেত্রে এই মেয়েরা পারদর্শী। ন্য দেশের মেয়ের আঙ্গুলের আগা মোটা। তদুপরি তোমাদের মেয়ে শ্রমিকদের মজুরি স্বল্প। তোমাদের মেয়েদের প্রডাক্টিভিটি বেশি। গার্মেন্ট উদ্যোক্তাদের নানারকম কমপিটিশনের ভেতরে কারখানা চালাতে হয়। অধিক মজুরি এবং কম প্রডাক্টিভিটির ধাক্কা উদ্যোক্তারা সামলাতে পারবেনা। মহিউদ্দিন ভাই বলতেন, আমাদের মেয়েরা আমাদের সম্পদ। আমি দেখেছি, মহিউদ্দিন ভাই গার্মেন্ট শ্রমিকদের আদর যত্ন করতেন। মহিউদ্দিনের চিন্তা অনেক সুদূরপ্রসারী।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্য যুদ্ধের কথা আপনারা জানেন। এ কারণে চীন থেকে কিছু কারখানা সরতে পারে। এক্ষেত্রে জাপান বা চীনের পছন্দের শীর্ষে আছে ভিয়েতনাম। ভিয়েতনামের সাথে চীনও জাপানের সংস্কৃতিগত মিল আছে। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা খবর রাখে, যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টট্রাম্প চীনের পরে ভিয়েতনামের উপরও শুল্ক আরোপ করতে পারে। এজন্য বিনিয়োগকারীরা তৃতীয় আরেকটি দেশকে তাদের পণ্য কেনার উৎসহিসাবে রাখতে চাইবে। যদি বাংলাদেশের সরকার ততটুকু স্মার্ট হয়, তাহলে এ সুযোগ বাংলাদেশ নিতে পারে। সরকারের যৌক্তিক সমালোচনা করা ভাল। বুদ্ধিজীবীদের তাই করা উচিৎ। সরকারকে শলাপরামর্শ দেয়া আরো ভাল। সরকারকে সহযোগিতা দিন।
তিন.
আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে নতুন ক্রেতা। দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় (২৫/৭/১৯) একটি হেডিং দেখলাম, “দেশের দুয়ারে নতুন ক্রেতা।” কাস্টমার বা খদ্দের হচ্ছে লক্ষী। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের সামনে নতুন সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের আগ্রহ বাড়ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা এই সুযোগ কতটুকু কাজে লাগাতে পারব?
যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের উপর উচ্চ হারে শুল্ক বসিয়েছে। এখন বাংলাদেশে নতুন ক্রেতা আসছেন- প্লাস্টিক, জুতা, সাইকেলসহ বিভিন্ন খাতে। যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের পোশাক রফতানি বাড়ছে। জুতা, প্লাস্টিক, সাইকেল, সিরামিক্স খাতে নতুন ক্রেতা আসছে।
দৈনিক প্রথম আলো (২৫/৭/১৯) পত্রিকার এক রিপোর্ট থেকে জানতে পারি, “ডলার জেনারেল” হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের মনিহারিপণ্যের চেইন স্টোর। এরা বাংলাদেশের “প্রাণ- আরএফএল” গ্রুপের সাথে যোগাযোগ করেছে, তারা প্লাস্টিক পণ্য কিনতে চায়। “ডলার জেনারেল” স্টোরের বছরে কত টাকার পণ্য বিক্রি হয় জানেন? বছরে তাদের বিক্রির পরিমাণ ২ লক্ষ কোটি টাকার বেশি- ২ হাজার ৫৬০ মার্কিন ডলার। আপনারা ইবলুন, বাংলাদেশ কি আগের মত থাকবে?
চার.
আমি মনে করি, মার্কিন-চীনবাণিজ্য যুদ্ধ বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকারক হবে না। বাণিজ্য যুদ্ধ এখন নানা ফ্রন্টে ছড়িয়ে পড়েছে। মার্কিনীরা শুল্ক বসিয়েছে, ভারত, কানাডা, মেক্সিকো, ইইউ এর উপরও। যুক্তরাষ্ট্র- “আমেরিকা ফার্স্ট” নীতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ২০১৮ সালে চীনা পণ্যের উপর বাড়তি শুল্ক বসানো শুরু করে। কমেছে সিংগাপুর, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও কোরিয়ার বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি। সিংগাপুর হোঁচট খাওয়ায় সামনে আরো খারাপ দিন আসতে পারে। এর মধ্যে রফতানি বাণিজ্যে নতুন এক মাইলফলক স্পর্শ করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের রফতানি আয় ৪ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশি টাকায় বাংলাদেশ বর্তমানে বছরে চার লক্ষ কোটি টাকা আয় করতে সক্ষম। বড় দেশগুলি বিপদে পড়লেও চলমান বাণিজ্য যুদ্ধ বাংলাদেশের রফতানি আয় আরো বাড়বে বলে উদ্যোক্তারা মনে করেন। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের বড় বাজার। এই বাজারে বড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা আগের চাইতে অনেক বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। নতুন ক্রেতা আসা শুরু হয়েছে। ২০০৮ সালের বিশ্ব মন্দার সময়েও বাংলাদেশ ভাল করেছিল। বাংলাদেশের রপ্তাণি আয়ের ৮৫ শতাংশ আসে পোশাক খাত থেকে। বাংলাদেশ নিত্য ব্যবহার্য বেসিক পোশাক বেশি রপ্তাণি করে। এগুলি সস্তা। সব সময় চাহিদা থাকে। মন্দার সময় চাহিদা আরো বাড়ে। আয় কমে যায় বলে, অনেকে উচ্চ ফ্যাশনের পোশাক ছেড়ে সাধারণ পোশাক কেনা বাড়িয়ে দেয়। এটা বাংলাদেশের জন্য আল্লাহর রহমত।
পাঁচ.
২০০৯ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সরকার পরিচালনা করে আওয়ামী লীগ দেশের অর্থনীতিকে শক্ত সবল অবস্থানে নিয়ে এসেছে। এখন বাংলাদেশের অর্থনীতি আরো জোরদার হওয়ার লক্ষন দেখা যাচ্ছে। আমি আশা করি, সরকার এই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারবে। সরকারকে বিচক্ষন তার সাথে অর্থনৈতিক পলিসি গ্রহণ করতে হবে। যোগ্য লোককে যোগ্য যায়গায় বসাতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় মনযোগী হতে হবে। বৈষম্য কমাতে হবে। দুর্নীতি দূর করতে হবে।
ছয়.
আমার মনে হচ্ছে, সরকার বিরোধী একটি মহল বুঝতে পেরেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি কম সময়ের মধ্যে উপরের দিকে জাম্প দিবে। আগামী নির্বাচনে আওয়ামীলীগের সাফল্যের সামনে বিরোধীরা হালে পানি পাবেনা। তারা এখন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে।
লেখক : সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ,
অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ
ঊ-সধরষ: ভধুষঁষযড়য়ঁবথ৭@ুধযড়ড়.পড়স