খাবার পানি: সমস্যা ও সমাধান

177

২২ মার্চ ২০১৯ পানি দিবসের বিবৃতিতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বলেছেন, ‘পানি ব্যবস্থাপনার উপর খাদ্য নিরাপত্তা অনেকাংশে নির্ভরশীল’। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘জীবন ও পরিবেশের মৌলিক উপাদান পানি’। পৃথিবীতে মানুষ কিংবা প্রাণীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে পানির উৎসকে সংরক্ষণ করতে হবে। যতœবান হতে হবে পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে। পানি দূষিত হয় এবং চলাচলে বাধাপ্রাপ্ত হয় এমন ধরনের সকল কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে হবে নিজেদের বাঁচার তাগিদেই।
মানুষের বেঁচে থাকার জন্যে পানি জীবনের একটি মৌলিক চাহিদা এবং অপরিহার্য অনুষঙ্গ। তাই যেখানে পানির উৎস বেশি সেখানে প্রাণী এবং উদ্ভিদের উপস্থিতি বেশি হতে দেখা গেছে। মানুষের খাওয়া, ব্যবহার, শস্য উৎপাদন, পণ্য উৎপাদন, নির্মাণ ও অগ্নিনির্বাপণে পানির ব্যবহার ছাড়া উপায় নেই। তাই অতীতে পানি সংকটের কারণে কোটি কোটি মানুষ নিজেদের বসতবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। জাতিসংঘের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিশ্বের অন্তত চল্লিশ শতাংশ মানুষ পানি ঘাটতির কারণে সমস্যায় পড়েছে। ২০৩০ সালের দিকে তীব্র পানি সংকটে প্রায় সত্তর কোটি মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে অন্যত্র সরে যেতে বাধ্য হবে।
আমাদের দেশের পানির উৎস ক্রমান্বয়ে সংকোচিত হয়ে আসছে। শহর, উপ-শহর, নদ-নদী, খাল-বিল, ডোবা, জলাশয়, পুকুর দিঘি সমূহ প্রতিনিয়ত দখল, দূষণ কিংবা ভরাট হচ্ছে। এ দেশের সবচেয়ে করুণ চিত্র হচ্ছে নদ-নদী ও খাল-উপখাল দখল, ভরাটসহ বিভিন্ন বর্জ্য যেমন: মানব, জীবজন্তু, পাহাড়, শিল্প, কৃষি ও রাসায়নিক, হাট-বাজার, এমনকি গৃহস্থালির বর্জ্য সরাসরি পানিতে ফেলে নদীর পানিকে ব্যপক হারে দূষিত করা। এক তথ্য থেকে জানা যায়, দেশের ২৯টি নদীর পানি বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে রয়েছে কর্ণফুলি নদীও। মৎস অধিদপ্তর ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ওয়ার্ল্ড ফিস’ সমীক্ষা করে দেখেছে যে, মাছের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ৯টি নদী মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে। ডড়ৎষফ ঐবধষঃয ঙৎমধহরুধঃরড়হ বলছে, বাংলাদেশে এক-তৃতীয়াংশ পানির উৎসে নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে অধিক মাত্রার ম্যাঙ্গানিজ বিদ্যমান। টঘওঈঊঋ এর মতে, বাংলাদেশের প্রতি ৫ পরিবারের মধ্যে ২টি পরিবার নোংরা দূষিত পানি ব্যবহার করে।


সম্প্রতি জলবায়ু ও পানি সংক্রান্ত এক আন্তর্জাতিক সাময়িকী ওয়াটার পলিসিতে প্রকাশিত ‘ঙৎমধহরুধঃরড়হ ্ ধিঃবৎ রহংবপঁৎরঃু রহ ঃযব ঐরহফঁশঁংয ্ ঐরসধষধুধ: রহংরমযঃং ভৎড়স ইধহমষধফবংয, ওহফরধ, ঘবঢ়ধষ ্ চধশরংঃধহ শিরোনামের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হিমালয় অঞ্চলে ক্রমেই বাড়ছে অপরিকল্পিত নগরায়ন। এ অপরিকল্পিত নগরায়নের প্রভাব যে আটটি দেশের উপর পড়বে বাংলাদেশ তার অন্যতম। অন্যদিকে ‘ওহঃবৎহধঃরড়হধষ পবহঃৎব ভড়ৎ রহঃবমৎধঃবফ সড়ঁহঃধরহ ফবাবষড়ঢ়সবহঃ’ তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, হিমালয় পর্বত অঞ্চল প্রায় ২০০ কোটি মানুষের জীবন জীবিকায় ভ‚মিকা রাখে। এ অঞ্চল থেকে পাওয়া পানি ব্যবহৃত হয় খাদ্য ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে। নিশ্চিত হয় বাস্তু সংস্থানের ভারসাম্য। আটটি দেশকে অন্তর্ভুক্ত করে পুরো হিমালয় অঞ্চল। ৪২ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকার এ অঞ্চলে রয়েছে বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, ভ‚টান, চীন, ভারত, মিয়ানমার, নেপাল ও পাকিস্তান।
দেশের ক্রমবর্ধমান মানুষের নিরাপদ পানি পান, কৃষি, শিল্প, কল কারখানা, অবকাঠামো উন্নয়ন ও বহুবিধ নতুন স্থাপনা নির্মাণসহ মানুষের নিত্য ব্যবহারের জন্যে পানির চাহিদা দৈনন্দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি আবাসন, শিল্প, কল কারখানা, দোকান-মার্কেট নির্মাণের কারণেও সারা দেশের নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর, দিঘি, জলাশয়, ডোবা দখল হয়ে যাওয়ার ফলে পানির উৎস আশঙ্কাজনকভাবে সঙ্কোচিত হয়ে পড়েছে। নদ-নদীর পানি তার গতিময়তা হারাচ্ছে দূষণ ও দখল পরবর্তী তার ভরাট করার কারণে। নদীমাতৃক বাংলাদেশে পানির উৎস ছিল। কিন্তু অযতœ, অবহেলা, খেয়ালিপনার কারণে সুপেয় পানি অপেয় হয়ে উঠেছে।
আমরা নিরাপদ খাবার পানি চাই। চাই জলস্থলের প্রাণীক‚ল নদী, খাল-বিল থেকে নিরাপদ পানি পান করতে পারার মত অবস্থা বা পরিবেশ। দেশের বিভিন্ন খাতে পানির চাহিদা প্রাপ্যতা ও যোগান নিশ্চিত করার জন্যে জনবান্ধব এবং দুর্নীতিমুক্ত সংস্থা। কিন্তু এ ধরনের আশা বা অধিকার দেশের মানুষের থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন। যার জন্যে হাইকোর্টের বিচারপতিও বলছেন, আমরা বিশুদ্ধ পানি চাই। উল্লেখ্য ঢাকা ওয়াসার ১০টি বিতরণ জোনের মধ্যে ৩টিতে জনস্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর ঈড়ষরভড়ৎস নধপঃবৎরধ পাওয়া গেছে। ৪ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ টিম জরিপ চালিয়ে হাইকোর্টকে দেয়া প্রতিবেদনে এ তথ্য জানান গত ৭ জুলাই ওয়াসার খুঁড়াখুঁড়ি এবং পানি সমস্যা নিয়ে জনগণ ক্ষুব্ধ ও হতাশ। গত ১৮ জুলাই দুর্নীতি দমন কমিশন ওয়াসার ১১ খাতে দুর্নীতি শনাক্ত করে ১২ দফা সুপারিশ পেশ করেছে। এ বছর ২১ মার্চ দৈনিক পূর্বদেশ প্রথম পৃষ্ঠায় বড় অক্ষরের শিরোনাম করেছে- কোটি টাকার ‘ওয়াসা নাইট’ নিয়ে মাতোয়ারা কর্মকর্তারা। এতে বলা হয়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসার নিজস্ব ১১শ জনসহ ৫০০০ লোককে নিয়ে সন্ধ্যায় যখন তারা ব্যস্ত থাকবে তখন নগরীর এক তৃতীয়াংশ মানুষ পানি সংকটে ভুগবে। মেহমানদারি কিংবা আতিথেয়তা ভাল। কিন্তু তার জন্যে যে আর্থিক সংকুলান প্রয়োজন তা যদি হয় সরকারি কোষাগারের তাহলে প্রশ্ন আসে যে, ঐ মেহমানদারির ফলে জনগণ কতটুকু লাভবান হল। কেন না সরকারি কোষাগারের অর্থ জনগণেরই অর্থ। নগরীর বাকলিয়া, পাথরঘাটা, ফিরিঙ্গিবাজার, হালিশহর, আগ্রাবাদ, রামপুরা, দেওয়ান বাজারসহ অনেক এলাকার মানুষকে পানি সংকটে রেখে সরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ওয়াসার মত জনগুরুত্বপূর্ণ খাতের কর্মকর্তাদের ভুঁড়িভোজের আয়োজন বা আমোদ আহ্লাদে পানির হাহাকারে নিপতিত জনগণ মোটেই খুশি নয়।
আগে বৃষ্টির পানি ছিল খাবার পানির অন্যতম উৎস। আমরা তখন দেখতাম গ্রামের বাড়ির আঙিনায় কলসীর উপর পরিষ্কার কাপড় দিয়ে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করছে। চল্লিশ বছর পূর্ব থেকে খাবার পানি হিসেবে নলক‚পের পানির ব্যবহার শুরু হয়। ফলে দেশের প্রায় ৯৯ ভাগ মানুষের খাবার পানি নলক‚প থেকেই সংগৃহিত হতো। শহরাঞ্চলে স্থাপিত হয় গভীর নলক‚প। কিন্তু ১৯৯৩ সালে নলক‚পের পানিতে আর্সেনিক ধরা পড়ার পর আমরা নিরাপদ পানির সংকটে পড়ি। তিনটি পার্বত্য জেলা ছাড়া বাকী ৬১ জেলার নলক‚পের পানিতে আর্সেনিক ঝুঁকি রয়েছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত প্রতিলিটার সুপেয় পানিতে অনুমোদিত আর্সেনিকের মাত্রা হচ্ছে ০.০১ মিলিগ্রাম। তবে বেশি দিন এ মাত্রার পানি পানে ত্বকের নানা বিকৃতিসহ পেট ব্যথা, বমি, ক্ষুধামন্দা, চোখ লাল হওয়া, পা ফোলা, হাত পা ঝিন ঝিন ও অবশ মনে হওয়ার মত রোগ দেখা দেয়। এমনকি লিভার, কিডনি, ইউরিনারি বøাডার এবং ফুসফুসে ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশিষ্ট আর্সেনিক বিশেষজ্ঞ ড. অ্যালান স্মিতের মতে, আগামী দশকে বাংলাদেশে পাঁচটি ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর একটি হবে আর্সেনিক দূষণ থেকে সৃষ্ট ক্যান্সারের ফলাফল স্বরূপ।
২০১৯ সালের ২২ জানুয়ারি বিভিন্ন সংবাদপত্রে বোতলজাত পানি নিয়ে ইধহমষধফবংয ঝঃধহফধৎফং ্ ঞবংঃরহম ওহংঃরঃঁঃরড়হ তথা ইঝঞও এর উদ্ধৃতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে বাজারে থাকা অনুমোদিত পাঁচটি কোম্পানির বোতল ও জারের পানি মানহীন ও পানের অযোগ্য। মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশে পনেরোটি কোম্পানির বোতল ও জারের পানি পরীক্ষা করে এ প্রতিবেদন দাখিল করে ইঝঞও.
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে এবং অযতœ, অবহেলা আর অপব্যবহারের ফলে পুকুর, দিঘি, জলাশয়গুলোর চিরায়ত রূপ আর নেই। নাগরিক জীবন থেকে হারিয়ে গেছে পুকুর দিঘির ব্যবহার। অবশিষ্ট যা আছে তার উপর চলছে অবিচার। অবিরাম চলছে দূষণ। যার ফলশ্রæতিতে পুকুর, দিঘি, জলাশয়ের পানি দূষিত অর্থাৎ ভ‚-পৃষ্ঠের পানি দূষিত, নলক‚পের পানিতে আর্সেনিক, ওয়াসার পানিতে ব্যাকটেরিয়া, বোতলজাত পানি নিরাপদ নয়। এমতাবস্থায় আমাদের নিরাপদ পানির বিকল্প উৎস হতে পারে বৃষ্টির পানি। ঢাকার একজন পানি বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ঢাকা শহরের ১০০ টি সরকারি ভবনের ছাদে যদি বৃষ্টির পানি ট্রিটম্যান্ট প্ল্যান্ট গড়ে তোলা যায় তাহলে ঢাকার পানি সমস্যার অনেকখানি সমাধান করা সম্ভব। উল্লেখ্য যে, শুধু ঢাকা নয় সমগ্র দেশের ৬৪ জেলায় উপরোক্ত কার্যক্রম গ্রহণ করা গেলে একদিকে যেমন খাবার পানির ব্যবস্থা হবে অন্যদিকে বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা হ্রাসেও সহায়ক হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক