খাদ্য অপচয় রোধ করতে পারেন যে সাতটি উপায়ে

57

প্রতি বছর প্রায় ১৩০ কোটি টন খাবার অপচয় হয়, যার বেশিরভাগেরই স্থান হয় ভাগাড়ে এবং শেষমেশ যা জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে। খাদ্যের অপচয় ‘এই মুহূর্তে মানবতার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ’ বলেন নিউ ইয়র্কের শেফ ম্যাক্স লা মান্না।
‘বেশি উদ্ভিদ, কম অপচয়’ নামে একটি বই লিখেছেন তিনি। এখানে তিনি বলেছেন যে, কেউ কিভাবে চাইলেই এই অবস্থার পরিবর্তন আনতে সহায়তা করতে পারে। ‘বাবা একজন শেফ ছিলেন বিধায় বলতে গেলে অনেকটা খাদ্যের দুনিয়ায় বড় হয়েছি আমি। আমার বাবা-মা সবসময় আমাকে খাবার নষ্ট না করতে শেখাতেন’ বলেন মি. মান্না।
তিনি বলেন, ৯শ কোটি মানুষের এই পৃথিবীতে, প্রায় প্রতিটি স্তরেই আমরা খাদ্যে অনিরাপত্তার মুখোমুখি হচ্ছি এবং ৮২ কোটিরও বেশি মানুষের খাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য নেই।
ওয়ার্ল্ড ভিগান ডে: গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি বিষয়
ম্যাক্স লা মান্না নিউ ইয়র্কের খাদ্য অপচয় বিরোধী একজন শেফ যিনি জিরো-ওয়েস্ট নীতি অনুসরণ করেন। আজ খাদ্য সংকট মানবতার জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা- বিশ্বে উৎপাদিত খাবারের মধ্যে আনুমানিক প্রায় এক তৃতীয়াংশই হারিয়ে যায় বা নষ্ট বা অপচয় হয়। খাদ্যের অপচয় শুধু খাবারের অপচয় নয়, এর মানে হচ্ছে অর্থের অপচয়, পানির অপচয়, জ্বালানির অপচয়, ভূমির অপচয় এবং পরিবহণের অপচয়। এমনকি আপনার ফেলে দেয়া খাবার জলবায়ু পরিবর্তনেও নেতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। ফেলে দেয়া খাবারের স্থান হয় ভাগাড়ে যেখানে এগুলো পচে মিথেন গ্যাস তৈরি করে। খাদ্য অপচয় যদি কোন দেশ হতো তাহলে এটি গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণে আমেরিকা ও চীনের পর তৃতীয় বৃহত্তম দেশ হতো।
এটি ঠেকাতে আপনি যা করতে পারেন তা হলো-
কেনাকাটায় স্মার্ট হোন : অনেক মানুষই চাহিদার তুলনায় বেশি কেনাকাটা করে। স্মার্ট কেনাকাটার ক্ষেত্রে আগে একটি তালিকা তৈরি করুন এবং যা যা আপনার দরকার শুধু সেগুলোই কিনুন।
বোনাস: আরেকবার বাজারে গিয়ে কেনাকাটা করার আগে, আগের বার কেনা সব জিনিস ব্যবহারের জন্য একটি পয়েন্ট হিসাব করুন।
খাবার সঠিকভাবে সংরক্ষণ করুন : খাবার সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করলে অনেক বেশি পরিমাণ খাবার অপচয় হয়। অনেকেই জানেন না যে সবজি এবং ফলমূল কিভাবে সংরক্ষণ করতে হয়। এজন্য অনেক সময় ভালোভাবে পাকার আগে কিংবা বেশি পেকে গেলে তারপর সেগুলো সংগ্রহ করা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় – আলু, টমেটো, রসুন, শশা এবং পেঁয়াজ কখনোই ফ্রিজে রাখা উচিত নয়। এগুলো ঘরের তাপমাত্রায় রাখা উচিত। পাতাযুক্ত কান্ড বা শাক এবং লতানো খাবার পানি দিয়ে রাখতে হবে। রুটি ফ্রিজে রাখা যেতে পারে যদি মনে হয় যে সেগুলো একবারে খেয়ে শেষ করা সম্ভব নয়। সম্ভব হলে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে কেনাকাটা করার চেষ্টা করুন।
উদ্বৃত্ত খাবার সংরক্ষণ করুন : বেচে যাওয়া খাবার আবারো খাওয়ার উপযোগী করার অনেক উপায় রয়েছে- যেমন সবজির বেচে যাওয়া অংশগুলো একসাথে মিশিয়ে ভেজে ফেলুন। উদ্বৃত্ত খাবার শুধু ছুটির দিনের জন্য রেখে দেয়া উচিত নয়। যদি আপনি অনেক রান্না করেন এবং নিয়মিতই খাবার উদ্বৃত্ত থাকে, তাহলে একটি দিন ঠিক করুন যেদিন আপনি রান্না না করে ফ্রিজে জমে থাকা খাবার খাবেন। খাবার ফেলে দেয়া রোধে এটি অনেক ভালো একটি উপায়। এছাড়া এটি আপনার সময় এবং অর্থ-দুটিই বাঁচাবে।
ফ্রিজের সাথে সখ্যতা গড়ুন : খাবার সংরক্ষণের সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে তা ফ্রিজে রাখা। আর ফ্রিজে রাখলে ভাল থাকে এমন খাবারের তালিকাও বেশ লম্বা। যেমন, সালাদ হিসেবে যেসব সবুজ সবজি খাওয়া হয় সেগুলো সহজেই ফ্রিজে রাখা যায়। ব্যাগ কিংবা কন্টেইনারে করে এসব সবজি রেখে দিন এবং পরে সেগুলো স্মুদি বা অন্য রেসিপির জন্য ব্যবহার করুন। শাক বা লতানো খাবার অলিভ অয়েল আর টুকরো রসুনে মিশিয়ে বরফ তৈরির ট্রেতে করে সংরক্ষণ করা যায়। যা পরে ভেঁজে খাওয়া যায় বা অন্যান্য খাবার তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। অতিরিক্ত খাবার যেমন ফার্মে বেশি পরিমাণে উৎপাদিত কোন খাদ্য পণ্য, স্যুপ বা মরিচের মতো পরিমাণে বেশি হয় এমন খাবারও ফ্রিজে সংরক্ষণ করা যায়। এর মাধ্যমে সব সময় স্বাস্থ্যকর এবং ঘরে রান্না করা খাবারের চাহিদা পূরণও সম্ভব হয়।
দুপুরের খাবার বাসা থেকেই নিয়ে যান : বেচে যাওয়া খাবার প্যাকেট করা লাঞ্চ হিসেবে খাওয়া যেতে পারে। এতে অপচয় কম হবে। যদিও সহকর্মীদের সাথে খাবার খেতে বাইরে যাওয়া কিংবা পছন্দের কোন রেস্টুরেন্টে গিয়ে পছন্দের খাবারটি খাওয়া বেশ আনন্দদায়ক, কিন্তু এগুলো বেশ দামি এবং এতে খাবার অপচয়ের সম্ভাবনাও বেশি থাকে। অফিসের মধ্যাহ্নভোজ হিসেবে সাথে করে নিয়ে যাওয়া খাবার অর্থ সাশ্রয় এবং সেই সাথে কার্বন নিঃসরণ কমাতে সহায়তা করে। সকালে যদি হাতে সময় কম থাকে, তাহলে আগেই উদ্বৃত্ত খাবার ছোট-ছোট কন্টেইনারে করে ফ্রিজে রেখে সংরক্ষণ করুন। এভাবে, আগে রান্না করা এবং মুখরোচক খাবার মধ্যাহ্নভোজ হিসেবে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিদিন সকালে আপনার হাতের কাছেই থাকবে।
বাড়িতেই স্টক তৈরি করুন : বাসায় বেচে যাওয়া সবজি দিয়ে স্যুপ রান্না করলে খরচও বেশ কমে আসে। খাদ্য অপচয় কমানোর একটি সহজ উপায় হচ্ছে ঘরেই স্টক তৈরি করা। সবজির বিভিন্ন অংশ যেমন উপরের অংশ, ডাটা, খোসা বা অন্য যে কোন অংশ ছোট টুকরা করে কেটে অলিভ অয়েল বা মাখন দিয়ে মেখে তারপর পানি মেশান এবং পরে ফুটিয়ে এগুলো দিয়ে মজাদার সবজি ব্রথ বা স্যুপ তৈরি করা যায়।
পারলে সার তৈরি করুন : বেচে যাওয়া খাবার দিয়ে বাড়িতেই তৈরি করা যায় জৈব সার। উদ্বৃত্ত খাবার পুনরায় ব্যবহার করার একটি অন্যতম উপায় হচ্ছে এগুলো দিয়ে সার তৈরি করা, যা গাছের জন্য শক্তির যোগান দেয়। সবার যেহেতু বাড়ির বাইরে সার তৈরির ব্যবস্থা নেই, তাই রান্না ঘর বা অল্প জায়গাতেই সার তৈরির এক ধরনের ব্যবস্থা বা কাউন্টার-টপ কম্পোস্টার রয়েছে যা প্রায় সবাই চাইলে ব্যবহার করতে পারে। যাদের বড় বাগান রয়েছে তারা চাইলে বাইরেই একটি কম্পোস্টার ব্যবহার করতে পারেন। আর কাউন্টার-টপ কম্পোস্টার শহরের বাসিন্দা বিশেষ করে যাদের ছোট বাগান বা গাছ রয়েছে তাদের জন্য উপযোগী।
ছোট পদক্ষেপ, বড় অর্জন : টিকে থাকার অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে খাদ্য অপচয় কমানো, বলেন শেফ ম্যাক্স লা মান্না। সবশেষে যেটি বলতে হয় তা হলো, আমরা সবাই চাইলেই খাদ্য অপচয় কমাতে পারি কারণ এর হাজারো রকম উপায় রয়েছে।
আপনার বাড়ি থেকে প্রতিদিন যে পরিমাণ খাবার অপচয় হয় সে সম্পর্কে পদক্ষেপ নিয়ে বিশ্বের অন্যতম মূল্যবান এই সম্পদ বাঁচাতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে আপনি সহায়তা করতে পারেন। আপনার কেনাকাটা, রান্না এবং খাওয়ার বিষয়ে ছোট ছোট পরিবর্তন এনে পরিবেশের উপর চাপ কমানো যেতে পারে। আর এটা তেমন কঠিন কিছুই নয়।
ছোট ছোট প্রচেষ্টার মাধ্যমে আপনি আপনার খাদ্য অপচয় বহুলাংশে কমিয়ে আনতে পারেন, অর্থ ও সময় সাশ্রয় করতে পারেন, আর কমাতে পারেন প্রকৃতির উপর থেকে কিছুটা চাপ।