খাগড়াছড়ির বিস্তীর্ণ জনপদে আমাদের বীরযোদ্ধারা

112

মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলিতে খাগড়াছড়ি মহকুমার বিস্তীর্ণ জনপদে আমাদের বীরযোদ্ধারা, গেরিলা তরুণ-যুবকরা পাকহানাদার বাহিনীর মোকাবেলা করেছে প্রবল বিক্রমে। ১৯৭১ সালের মার্চ-এপ্রিল-মে মাসে পাকহানাদার বাহিনীর সাথে প্রতিরোধ যুদ্ধ চলে সমগ্র খাগড়াছড়ি মহকুমায়। এই প্রতিরোধ যুদ্ধে অসীম বীরত্বের পরিচয় দিয়ে শহীদ হন নায়েক মুন্সি আব্দুর রউফ তাকে সরকার বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করে। ২৭ এপ্রিল মহালছড়িতে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে শহীদ হন ক্যাপ্টেন কাদের। এখানে তৎকালীন খাগড়াছড়ি মহকুমায় আমাদের অপারেশনের কয়েকটি সংক্ষেপে তুলে ধরা হল।
দেওয়ান বাজার অপারেশন
বর্তমান খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার মাটিরাঙ্গা থানার বাংলাদেশ সীমান্তে দেওয়ান বাজার বি ও পি’র বিপরীতে ঘোড়া কাফকায় আমাদের মিত্রবাহিনীর বিএসএফ ফাঁড়ি পাকহানাদার কর্তৃক আক্রান্ত হয়। তখন সম্ভবত ৭১ এর অক্টোবর মাস। তবলছড়ি হতে আমি ও মোবারক আলী মাস্টারসহ নিয়মিত বাহিনীর কিছু সেনা নিয়ে বিএসএফ এর সাহায্যার্থে ঘোড়া কাফকায় যাই। আনুমানিক রাত ১০টা হতে ১২টা পর্যন্ত গোলাগুলি বিনিময় হয়। আমাদের প্রবল আক্রমণ এর মুখে টিকতে না পেরে পাকহানাদার বাহিনী পিছু হঠতে বাধ্য হয়।
রামগড় মহামুনি পাড়া অপারেশন
৭১ এর অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে ক্যাপ্টেন মাহফুজের নেতৃত্বে রামগড় মহামুনি এলাকায় এক সফল গেরিলা অপারেশনে ১ জন কর্নেল সহ ১৭ জন পাকসেনাকে খতম করা হয়। এই অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধারা মর্টার ব্যবহার করে। এই যুদ্ধে হেমদা রঞ্জন গ্রæপের রামগড়ের বীর মুক্তিযোদ্ধা রনজিৎ ত্রিপুরা, ব্রজেন্দ্র প্রমুখ অংশগ্রহণ করে।
পাতাছড়া অপারেশন
বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় থানার পাতাছড়া ইউনিয়নের কালাপানি নামক স্থানে পাকবাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিল। মংশোয়ে অং (জুলুবাবু) ও হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা এবং আলী আশরাফ এই তিন গ্রুপ কমান্ডার যৌথ ভাবে মিলিত হয়ে ৯০/৯৫ জনের বাহিনী নিয়ে তিন দিক থেকে আক্রমণ করে, প্রায় দেড় থেকে দুই ঘণ্টা যাবত গোলাগুলির পর পাকবাহিনী পিছু হটে ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যায়।
রামগড় বিজয়
৭১-এর ৬ ও ৭ ডিসেম্বর রামগড়ে পাকবাহিনীর ওপর আমাদের মুক্তিবাহিনী স্থল ও বিমান আক্রমণ করে। আমাদের আক্রমণে পাকবাহিনী রামগড়, হেডকোয়ার্টার ছেড়ে পালিয়ে যায়। ৮ ডিসেম্বর বিকালে পার্বত্য চট্টগ্রামের রামগড়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হয়।
তবলছড়ি ও ভাইবোনছড়া বিজয়
মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে ১ নং সেক্টরে গিয়ে ৭১ এর ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। প্রশিক্ষণ শেষে আমি এফএফ সাব ডিভিশন কমান্ডার ও স্বাদ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হই। ৮ ডিসেম্বর তারিখে সেক্টর হেডকোয়ার্টারে আমার প্রেরিত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটি ট্রাকে হরিনা থেকে তবলছড়ি চলে আসি। সেখানে ক্যাপ্টেন অশোক দাসগুপ্ত ওরফে বাবুল চৌধুরীর সাথে সাক্ষাৎ করি। পূর্বে নিয়মিত বাহিনী ও আমার এফএফ মুক্তিযোদ্বাদের যৌথভাবে তবলছড়ি হতে পানছড়ি হয়ে ভাইবোনছড়া পর্যন্ত মুক্ত করি।
গাছবন অপারেশন ও খাগড়াছড়ি মুক্তকরণ
৭১ এর ১৪ ডিসেম্বর। বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলা সদরের একটি ইউনিয়ন ভাইবোনছড়া ক্যাপ্টেন অশোক দাস গুপ্ত ও আমি একটি প্রতিরক্ষা ঘাঁটি ভাইবোনছড়াতে রেখে প্রায় ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা ফাইটিং পেট্রোল পার্টি নিয়ে খাগড়াছড়ির দিকে অগ্রসর হই। কুকিছড়া পার হয়ে গাছবন (খাগড়াছড়িতে ও ভাইবোনছড়ার প্রায় মাঝামাঝি জায়গা) সেতুতে আমার প্রথম দল পা রাখার সাথে সাথেই বামদিকের পাহাড় থেকে পাকবাহিনীর দোসর ও মিজোরা গুলিবর্ষণ করতে থাকে, আমাদের মুক্তি সেনারাও সাথে সাথে পাল্টা জবাব দেয়, শেষ পর্যন্ত আমাদের গুলির মুখে টিকতে না পেরে মিজোরা পাহাড়ের দিকে পালিয়ে যায়। ১৫ ডিসেম্বর ভাইবোনছড়া হতে খাগড়াছড়ি পর্যন্ত মুক্ত করি। ঐ দিনেই সাব ডিভিশন কমান্ডার হিসেবে আমি মহকুমা শহর খাগড়াছড়িতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করি। সেই থেকে ১৫ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ি জেলা সদরে পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন করা হয়। ঐ সময় নিয়মিত সেনাবাহিনীর অধিনায়ক ক্যাপ্টেন অশোক দাস গুপ্ত (বাবুল চৌধুরী) তৎকালিন ই.পি.আর. বর্তমান বি.ডি.আর. বাহিনীর নায়েব সুবেদার খায়েরুজ্জামান, পুলিশের হাবিলদার আহম্মদ উল্লাহ্, এফ. এফ. এর যে কয়েকজন গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন, যথাক্রমে মোহাম্মাদ মোবারাক আলী, মোহাম্মাদ নুরুন্নবী, সুবোধ বিকাশ ত্রিপুরা, মংশেয়ে অং (জুলুবাবু) এবং আমি মহকুমা কমান্ডার হিসেবে ছিলাম। বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার ন্যায় আমাদের খাগড়াছড়ির মুক্তিযোদ্ধাগণও অসীম বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।