বাবুল কান্তি দাশ
অবিভক্ত ভারতের নদীয়া জেলার তেহট্ট থানার খাসপুর গ্রামে প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ এম.এ হান্নানের জন্ম ১৯৩০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। ১৯৪৮ সালে পরিবারের সাথে চলে আসেন মেহেরপুর জেলার আমঝুপিতে। জগন্নাথ কলেজে বি.এ অধ্যয়নের সময় ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে চলে আসেন চট্টগ্রামে। যুক্ত হন শ্রমিক লীগে। জেলা শ্রমিক লীগ, জাতীয় শ্রমিকলীগ এর পর ১৯৬৪ সালে জেলা আওয়ামীলীগের দপ্তর সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ এর ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৮ এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বিরোধী আন্দোলনে কার্যকর ভূমিকা রাখেন এই রাজনীতিবিদ। ১৯৭০ সালে জেলা আওয়ামীলীগ এর ভারপ্রাপ্ত এবং পরবর্তী সময়ে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে তিনি ২৪ মার্চ চট্টগ্রাম বন্দরে সোয়াত জাহাজ থেকে পাকিস্তানিদের অস্ত্র খালাসের বিরুদ্ধে ছাত্র, শ্রমিক জনতাকে নিয়ে প্রতিরোধ সৃষ্টি করেন। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের সেই নির্দেশনার পর থেকে চট্টগ্রামের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে পরবর্তী করণীয় নিয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ চট্টগ্রামে খবর এলো বঙ্গবন্ধু কিছুক্ষণ আগে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। ঐ সময়ে চট্টগ্রাম আওয়ামী পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন গ্রæপে বিভক্ত হয়ে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন। সভা চলাকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার ওয়্যারলেস কপিটি চট্টগ্রামের নেতাদের হাতে এসে পৌঁছায়। টেলিগ্রাফ অফিসের এক কর্মচারী জহুর আহমেদ চৌধুরীর হাতে কপিটি দিয়ে যান। নেতা কর্মীরা এটি হাতে লিখে, সাইক্লোস্টাইল করে বিভিন্ন জায়গায় বিতরণ করেন। এবং সিদ্ধান্ত নিলেন ঘোষণাটি বেতারের মাধ্যমে জনগণকে জানানো প্রয়োজন। কারণ সবাই ঐ সময়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে উৎকন্ঠায় ছিলেন। কোথায় আছেন, কিভাবে আছেন। আদৌ বেঁচে আছেন কিনা। প্রথমেই আগ্রাবাদ বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণাটি দেওয়ার কথা থাকলেও ঐ কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ চিন্তা করে নেতৃবৃন্দ মত পরিবর্তন করে কালুরঘাট থেকে ঘোষণাটি প্রচার করার সিদ্ধান্ত নেন। ঘোষণাটি পাঠ করার কথা ছিল জহুর আহমেদ চৌধুরীর। ব্যক্তিগত অসুস্থতায় তিনি সরে দাঁড়ান। নেতারা সবাই রওনা দেন কালুরঘাট বেতার ট্রান্সমিটার এর দিকে। এখান থেকেই ২৬ মার্চ দুপুরের দিকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন তৎকালীন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামীলীগের বিপ্লবী সাধারণ সম্পাদক এম.এ হান্নান। ঘোষণাটি প্রচারিত হওয়ার পরদিন ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা ফলাও করে ছাপা হয়। এবং ঐ সময়ে সংবাদটি বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ায় বিশ্বনেতৃবৃন্দের নিকট এই বার্তা পৌঁছে যায় যে আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন এবং তিনিই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। যা আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।
স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে অনেক ইতিহাস বিকৃতির স্বাক্ষী আমরা। ইতিহাসের চাকাকে উল্টো ঘোরাতে চেয়েছিল ষড়যন্ত্রকারীরা। খলনায়ককে নায়ক বানানোর হীন চক্রান্ত আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। ইতিহাসের নির্মম সত্য এই ১৯৭১ সালে এম.এ হান্নান জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন। ২০১৩ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্ত এই নেতা ১৯৭৪ সালের ১২ জুন এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। প্রয়াণ দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক : বাবুল কান্তি দাশ (শিক্ষক)