ক্ষমতা ভাব দেখানোর জন্য নয় : রাষ্ট্রপতি

46

সরকারি-বেসরকারি সব বিভাগের সংশ্লিষ্টদের জনকল্যাণে কাজ করার তাগিদ দিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, ক্ষমতা জনগণের খেদমতের জন্য, ভাব দেখানোর জন্য নয়।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট দিবস উপলক্ষে গতকাল বুধবার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আজ আমি রাষ্ট্রপতি, মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে আমি সাধারণ মানুষ। রাষ্ট্রপতি হয়েছি জনগণের কল্যাণের জন্য। আমাদের একটা পজিশনে গেলে ভাব চলে আসে। ক্ষমতা হচ্ছে জনগণের কল্যাণের জন্য। ক্ষমতা দেয় জনগণ তার কল্যাণের জন্য। তাদের ভালো করার জন্য, ভাব দেখানোর জন্য নয়। যত বিভাগ আছে সরকারি-বেসরকারি সব জনগণের পয়সা দিয়ে চলে। জনগণের ভালোর জন্য ক্ষমতা,অন্য কোনো ভাব দেখানোর জন্য নয়। এটা মনে রাখতে পারলে বাংলাদেশ আসলেই সোনার বাংলা হবে’।
সুপ্রিম কোর্ট জাজেস লাউঞ্জে ওই অনুষ্ঠানে রাজনীতিতে আইনজীবীদের প্রাধান্য কমে ব্যবসায়ীদের সামনে চলে আসা নিয়ে আক্ষেপ করেন পেশায় আইনজীবী আবদুল হামিদ। তিনি বলেন, ‘একটা জায়গায় আমি হতাশ। এক সময় দেখেছি সব জায়গায় আইনজীবীরা নেতৃত্ব দিত। ’৭০ সালের নির্বাচনে ৫১ শতাংশ আইনজীবী ছিলাম। এখন কমতে কমতে অবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে। খুবই কম। যাও আছেন বেশিরভাগ নন-প্রাকটিসিং। এখন ব্যবসায়ীরা সামনে চলে এসেছে। ব্যবসায়ীরা যদি সব কিছু দখল করে নিয়ে যায় তাহলে পরিবেশটা ভালো হওয়ার লক্ষণ মনে করি না। এ রকম কেন হচ্ছে, সেটা ভেবে দেখতে হবে। আমাদের কোনো আচরণের কারণে এ রকম হচ্ছে কি না? আমরা কি মানুষের কাছে যাচ্ছি না। এখানে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে’।
অনুষ্ঠানে মামলার রায় হওয়ার পর বিচারপ্রার্থীদের রায়ের অনুলিপি পেতে যেন দেরি না হয় সেদিকে বিচারকদের ‘খেয়াল’ রাখতে বলেন রাষ্ট্রপতি। তিনি বলেন, ‘সরকার বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে এবং বিচারকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত আন্তরিক। কিন্তু বিচারকদের খেয়াল রাখতে হবে মামলার রায় হওয়ার পর রায়ের কপি পাওয়ার জন্য বিচারপ্রার্থীদের যেন আদালতের বারান্দায় ঘোরাঘুরি করতে না হয়’।
মামলার দ্রæত নিষ্পত্তিতে বিচারকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আবদুল হামিদ বলেন, ‘আমি জানি বিচার কাজ কত কঠিন বিষয়। আমি নিজে আইনজীবী বিধায় বুঝতে পারি বিচারকগণ সারা দিন কি পরিমাণ পরিশ্রম করেন। কিন্তু তারপরও আমি বলব মামলার পরিমাণ দিন দিন যে হারে বাড়ছে সেটাকে আয়ত্তে¡র মধ্যে আনতে হলে বিচারকদের আরও বেশি কাজ করতে হবে। মামলার রাশ টেনে ধরতে বিকল্প নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিতে হবে’।
আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘আইনজীবীগণ বিচার ব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অংশ। আইনজীবীদের সহায়তা ছাড়া বিচারের কাজ কিছুতেই অগ্রসর হতে পারে না। আমাদের সংবিধান প্রণয়নের সময় যেমন দেশের প্রথিতযশা আইনজীবীগণ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, তেমনি যখনই প্রয়োজন হয়েছে তখনই আদালতের ডাকে সাড়া দিয়ে আইনজীবীগণ এমিকাস কিউরি হিসাবে তাদের মতামত প্রদান করে আদালতকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করেছেন। তাই একথা বলা অতিরঞ্জন হবে না যে, আইনজীবীগণ বিচার ব্যবস্থার একটি অন্যতম স্তম্ভ। সুপ্রিম কোর্ট দিবস উদ্যাপনের এই অনুষ্ঠানে আমি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আইনজীবীদের অবদান অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি এবং আশা করছি যে জ্ঞানের চর্চায় আইনজীবীগণ পূর্বের চেয়ে আরো এগিয়ে যাবেন এবং তাদের মেধা, প্রজ্ঞা, সততা ও আন্তরিকতা দিয়ে বিচারপ্রার্থীদের দ্রুত ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে সাহায্য করবেন’। খবর বিডিনিউজের
অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সাক্ষ্য গ্রহণের ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘তথ্য প্রযুক্তি আমাদের দৈনন্দিন কার্যক্রমকে সহজ ও ত্বরাণ্বিত করেছে। তাই মামলা ব্যবস্থাপনায় গতিশীলতা আনতে তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। আমি জেনেছি সুপ্রিম কোর্টে ইতোমধ্যে অনলাইন কজলিস্ট চালু হয়েছে এবং অনলাইন বেল কনফার্মেশন ব্যবস্থা কার্যকরভাবে চলছে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট যেহেতু কোর্ট অব রেকর্ড সেহেতু এর সকল নথিকে ডিজিটাল নথিতে পরিণত করার উদ্যোগ গ্রহণ এবং মামলা দায়ের থেকে রায় ঘোষণা পর্যন্ত সমস্ত কার্যক্রমকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে’। তিনি বলেন, ‘ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে জেলখানা হতে আদালতে আসামিদের উপস্থিত করা এবং একই পদ্ধতিতে দূর হতে সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণের ব্যবস্থা করা যায় কি না তা ভেবে দেখতে হবে। সরকার এসব বিষয়ে অত্যন্ত আন্তরিক এবং ইতোমধ্যে সরকার ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ হাতে নিয়েছে’।
রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগের মধ্যে যাতে ভারসাম্য বজায় থাকে সেদিকেও খেয়াল রাখতে বিচার বিভাগের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। তিনি বলেন, ‘বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের রক্ষক এবং চূড়ান্ত ব্যাখ্যা প্রদানকারী। আপিল বিভাগ সংবিধান ও আইনের যে ব্যাখ্যা প্রদান করে সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তা দেশের সকল আদালতের জন্য প্রযোজ্য ও অনুসরণীয়। একইভাবে হাই কোর্ট বিভাগের আইনের ব্যাখ্যা অধস্তন সকল আদালতের জন্য অনুসরণীয়। সুপ্রিম কোর্টের রয়েছে জুডিশিয়াল রিভিউয়ের ক্ষমতা। তবে এই ক্ষমতা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে প্রয়োগ করতে হবে যাতে রাষ্ট্রের অন্য দু’টি অঙ্গের কার্যক্রম ও মর্যাদার হানি না হয়। দেশ, জনগণ ও সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে বিচারকগণ তাদের মেধা ও মনন প্রয়োগের মাধ্যমে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবেন, দেশবাসী তা প্রত্যাশা করে’।
সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে ওই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। অন্যদের মধ্যে আরও বক্তব্য রাখেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান মুহাম্মদ ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন।