ক্লাসমেট ফড়িং

68

উড়তে উড়তে জানালার গ্রিলে এসে বসলো ফড়িং। জানালার পাশেই নদীর পড়ার টেবিল। টেবিলে এলোমেলো বই। ভাগ্যিস জানালার একটা অংশ খোলা ছিলো। সন্ধ্যা হলেই মশা ঢোকার ভয়ে মা সব দরজা জানালা বন্ধ করে দেয়। নদী চুপিচুপি একটা অংশ খোলা রেখেছে। এখান দিয়ে হাসনাহেনা, মধুমন্জরীর গন্ধ ঢোকে ঘরে। সন্ধ্যাটা মাতাল করে রাখে।
হাসনাহেনার গন্ধের সঙ্গে আলতো খোলা জানালা দিয়ে ফড়িংটা ঘরে ঢুকলো। পড়ার টেবিলের উপর এক চক্কর খেয়ে অঙ্ক বইয়ের উপর বসলো ফড়িং। পড়া শুরু করবে এমন সময় নদী এসে তার রঙিন ডানা দুটি ধরে ফেললো।
ফরফরে রঙিন দুটি ডানা। যেন মসলিন কাপড়ের ওড়না। ফড়িংটা খুব ব্যাথা পেলো। এতো সুন্দর ফড়িং নদী কখনও দেখেনি। লাল টকটকে মিষ্টি ফড়িং। ফড়িংটাকে বেঁধে ফেললো সে।

রাত বাড়তে বাড়তে মধুমন্জরীর গন্ধ আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। নদী শুয়ে পড়লো ঠিকই, কিন্তু ফুলের গন্ধ আর ঘুঘুর ডাকে ঘুম আসছে না। চারিদিক স্তব্দ হয়ে আছে। হঠাৎ একটা শব্দ এসে কানে লাগলো তার। কাতর কন্ঠ, আমাকে ছেড়ে দাও, আমাকে ছেড়ে দাও প্লিজ।
নদী ভাবলো স্বপ্ন। পরে আরও কয়েকবার শোনার পর সে উঠে বসলো। আলো জ্বালিয়ে দেখলো, শব্দটা টেবিল থেকেই আসছে। বুঝতে আর বাকি রইলো না কিছু।

প্রথমে কিছুটা অবাক হলো নদী। কথা বলছে ফড়িং! ফড়িংটার মুখোমুখি এসে বসল সে। কাঁদো কাঁদো গলায় ফড়িং বলল, আমাকে ছেড়ে দাও বোন। নদীর খুব মায়া হলো।
– অনেক রাত এখন। এতো রাতে একা একা কোথায় যাবে তুমি?
– কোথাও যাবো না। তোমার ঘরেই থাকবো। বাঁধনটা খুলে দাও শুধু। একটু পড়াশোনা করবো।
নদী অবাক হলো। পড়াশোনা মানে?
– কাল পরীক্ষা আছে। সন্ধ্যা থেকেই বেঁধে রেখেছো। একটা অঙ্কও মুখস্ত করতে পারিনি।
নদী কিছুই বুঝতে পারছে না ফড়িঙের কথা। কৌতুহল তার বেড়েই চলছে। ফড়িংটাকে সব খুলে বলতে বলল সে।

লেজের বাঁধন খুলে দিতেই কয়েকবার ডানা ঝাপটালো ফড়িং। বলল, আমি তোমার ক্লাসমেট। তুমি যে স্কুলে পড়, আমিও একই স্কুলে পড়ি। তুমি যে ক্লাসে পড়, আমিও একই ক্লাসে পড়ি। কাল তোমার অঙ্ক পরীক্ষা, আমারও অঙ্ক পরীক্ষা। অবাক হয়ে নদী বলল, কই, তোমাকে তো ক্লাসে কখনো দেখিনি।
– দেখবে কিভাবে? আমি কি তোমার মত বেঞ্চে বসি নাকি! যখন ক্লাস চলে, জানালায় বসে থাকি। মাঝে মাঝে ম্যাডামের চুলেও বসি। তোমরা হয়তো মনে কর ক্লিপ।

সত্যিই তো। ওদিন ম্যাডামের চুলের ক্লিপটা নিয়ে দ্বিধায় পড়েছিল নদী। ম্যাডাম ক্লাসে ঢোকার সময় সে স্পষ্ট দেখেছে চুলে কোন ক্লিপ নেই। কিছুক্ষণ ক্লাস চলার পর হঠাৎ দেখলো ম্যাডামের চুলে ক্লিপ। একদম ফড়ি!টার মত ক্লিপ। ফড়িঙের কথা বিশ্বাস করলো নদী। বললো, তোমার বই-খাতা, ব্যাগ কোথায় থাকে?
ফড়িংটা এবার হেসে ফেলল। বলল, ব্যাগ খাতা লাগে না। শুনে শুনেই সব মুখস্ত করে ফেলি। স্কুলে মুখস্ত করি, জানালায় বসে তোমার পড়া শুনেও মুখস্ত করি।
– তো আজ একদম ঘরে ঢুকে পড়লে যে?

ফড়িং বলল- অনেকক্ষণ জানালার বাইরে বসে ছিলাম। তোমার কোন শব্দ পাচ্ছিলাম না। পরে উঁকি দিয়ে দেখি তুমি অঙ্ক করছ কোন শব্দ ছাড়াই। শুনতে না পেলে আমি মুখস্ত করবো কিভাবে বল? তুমি যখন পাশের রুমে গেলে এই সুযোগে ঘরে ঢুকে পড়েছিলাম অঙ্ক মুখস্ত করতে।
নদী অবাক হয়ে বলল, তুমি অঙ্ক মুখস্ত কর?
-হ্যাঁ। আমার মুখস্ত বিদ্যা ভালো। বাংলা, অঙ্ক, ইংরেজি সব মুখস্ত করে ফেলি।একবার শুনলেই আমার মুখস্ত হয়ে যায়।
নদী আবারও অবাক হলো। কারণ সে কিছুই মুখস্ত করে না। সব বুঝে বুঝে পড়ে।
নদীকে বারবার অবাক হতে দেখে ফড়িং বলল, আর কথা বাড়িও না। অনেক রাত হয়ে গেছে। তুমি যদি বইটা একটু দাও, কয়েকটা অঙ্ক মুখস্ত করতে পারবো। কাল নইতো নির্ঘাত ফেল।

নদী বইটা খুলে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। ফড়িঙটা সারারাত পড়ল। যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ, নামতা মুখস্ত করল। খুব ভোরে জানালার ফাঁক দিয়ে ফড়িঙটা বেরিয়ে গেল। নদী ঘুম থেকে ওঠার অনেক আগে।

দুপুরে পরীক্ষা শেষে দুজনের দেখা হল স্কুলের মাঠে। খুব দুঃখ দুঃখ মন নিয়ে নদীর পাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলো ফড়িং। নদী জিজ্ঞেস করল, পরীক্ষা কেমন হল ফড়িং সাহেব?
পাখা স্থির করে দাঁড়াল ফড়িং। বলল, একদম ভালো হয়নি। রাতে যে অঙ্কগুলো মুখস্ত করেছিলাম একটাও প্রশ্নে আসেনি।

-আসেনি মানে! তোমাকে যে পৃষ্ঠাগুলো দেখিয়ে দিয়েছিলাম ওখানে থেকেই তো প্রশ্ন এসেছে। কি হয়েছে একটু বুঝিয়ে বলতো?
ফড়িংটা নদীর চুলের উপর বসলো। সবাই ভাবলো ক্লিপ। হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছে দুজনে। ফড়িং বলল, আমি মুখস্ত করেছিলাম দুই যোগ তিন সমান পাঁচ। পরীক্ষায় এলো তিন যোগ চার সমান কত? সবগুলো প্রশ্নই এরকম এলোমেলো।
হাসতে হাসতে মাঠের মধ্যেই বসে পড়ল নদী। বলল, বোকা। অঙ্ক কেউ মুখস্ত করে? অঙ্ক শিখতে হয় বুঝে বুঝে। শুধু অঙ্ক নয়, সব বিষয়ই শিখতে হয় বুঝে বুঝে।
– বুঝে বুঝে সেটা আবার কেমন?
– কাল থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমার কাছে চলে আসবে। সব বুঝিয়ে দেবো তখন।
ফড়িং পাখা দোলাতে দোলাতে বলল, আচ্ছা। তারপর উড়ে গেল। সবাই অবাক হয়ে দেখল, নদীর চুল থেকে একটা ক্লিপ ফড়িঙের মতো উড়ে যাচ্ছে জঙ্গলের দিকে।