ক্রোকের তালিকায় দুর্নীতির সম্পদ

44

সন্দেহভাজন কোনও ব্যক্তির স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের ব্যাপারে তদন্ত কিংবা অনুসন্ধান চলাকালীন দুর্নীতির প্রমাণ পেলেই তা ক্রোকের মাধ্যমে নিজেদের জিম্মায় নিতে আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কেবল দুদকই নয়, মানি লন্ডারিং বা মুদ্রাপাচার আইনে দায়ের হওয়া মামলা তদন্তাধীন অবস্থায় পুলিশও আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে অভিযুক্তের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ নিজেদের হেফাজতে নিচ্ছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ হাতবদল বা বিক্রি ঠেকাতে এমন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। গ্রহণের ঘটনা বাড়ছে। এতে দীর্ঘ হচ্ছে ক্রোক করা সম্পদের তালিকা।
দুদক ও পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রামে এরই মধ্যে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত বা বৈধ আয়ের উৎসের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণভাবে অর্জিত কয়েকজনের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ আদালতের নির্দেশে ক্রোক করে নিজেদের জিম্মায় নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন ও পুলিশ। এসব সম্পদের বাজারমূল্য কয়েকশ’কোটি টাকা। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ ক্রোক হওয়া অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে আবাসন ব্যবসায়ী, পুলিশ কর্মকর্তা, তালিকাভুক্ত ইয়াবা চোরাকারবারি ও মুদ্রাপাচারকারী রয়েছেন। তবে, দুর্নীতিবিরোধী একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা হিসেবে দুদকের আইনে অবৈধ উপায়ে বা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ তুলনামূলকভাবে বেশি হওয়ায় সংস্থাটির হাতে ক্রোক করা সম্পদের পরিমাণও বেশি। আরও কয়েকজন অভিযুক্তের সম্পদ ক্রোকের অনুমতি চেয়ে করা আবেদন দুদকের পাইপলাইনে রয়েছে। অন্যদিকে, ফৌজদারি কার্যবিধি বা সিআরপিসি অনুযায়ী কেবল মানি লন্ডারিংয়ের মত সুনির্দিষ্ট আইনে দায়ের হওয়া মামলায় আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে অভিযুক্তের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোক করে নিজেদের জিম্মায় রাখার সুযোগ পুলিশেরও রয়েছে। সে হিসেবে পুলিশের ক্রোক করে জিম্মায় নেয়া সম্পদের তালিকাও তুলনামূলক ছোট, নজিরও কম।
পুলিশের জিম্মায় নেয়ার প্রথম নজির ঃ ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট তালিকাভুক্ত শীর্ষ ইয়াবা পাচারকারী টেকনাফের নাজিরপাড়ার এজাহার মিয়া (৭০) এবং তার দুই ছেলে নুরুল হক ভুট্টো (৩২) ও নূর মোহাম্মদ ওরফে মংগ্রীর (৩৫) বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় মুদ্রা পাচার প্রতিরোধ দমন আইনে মামলা করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। দুই ছেলের মধ্যে নুর মোহাম্মদ ওরফে মংগ্রী গত এপ্রিলে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। এ মামলায় সিআইডির আবেদনের ভিত্তিতে গত ২৩ মে তিনজনের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ দেন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ খোন্দকার হাসান মো. ফিরোজ। আদেশে ক্রোকবদ্ধ সম্পত্তিসমূহ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কক্সবাজারের পুলিশ সুপার তত্ত্বাবধায়ক (রিসিভার) নিয়োগ করা হয়। মূল মামলা নিস্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ওই সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ করবেন তত্ত্বাবধায়ক। আদালতের আদেশ পাওয়ার পর গত পয়লা জুন ওই তিন ইয়াবা কারবারির মালিকানাধীন দোতলা দুটি বাড়ি ও জমিজমা ক্রোক করে নিজেদের হেফাজতে নেয় টেকনাফ থানা পুলিশ। এসব সম্পদের আয়-ব্যয় সংক্রান্ত হিসাবও প্রতিবছরের ২৪ মে আদালতে উপস্থাপন করবে পুলিশ। মানি লন্ডারিং আইনের মামলায় আদালতের আদেশে কোনও ইয়াবা কারবারির সম্পদ পুলিশের নিজেদের জিম্মায় নেয়ার নজির এটিই প্রথম। প্রাসাদোপম বাড়ি ও জমি-জমা মিলিয়ে ক্রোক করা সম্পদের বাজারমূল্য আনুমানিক ৩০ কোটি টাকার বেশি হতে পারে বলে পুলিশের ধারণা।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি এডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী দুর্নীতির সম্পদ জিম্মায় নেয়ার ঘটনাকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন। তিনি পূর্বদেশকে বলেন, ‘যে কোনও দুর্নীতির মধ্য দিয়ে আসলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা শিকার হয় রাষ্ট্র ও সাধারণ মানুষ। লাভবান হয় ব্যক্তি বা গোষ্ঠী। সেদিক থেকে মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তিতে রায় সংস্থাগুলোর পক্ষে গেলে রাষ্ট্র ও জনগণের ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তি সহজ হতে পারে। একধরনের সুরক্ষা দিতে পারে। তবে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ এখনও জনপ্রত্যাশার মাত্রায় পৌঁছাতে পারেনি।’
দুদক সূত্র জানায়, দুর্নীতি দমন কমিশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সর্বশেষ গত ১৮ সেপ্টেম্বর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতের বিচারক মো. আকবর হোসেন মৃধা এ আদেশ দেন। সম্পদ বিবরণীতে মিথ্যা তথ্য প্রদান ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের মামলায় অভিযুক্ত চট্টগ্রামভিত্তিক আবাসন প্রতিষ্ঠান আরএফ প্রপার্টিজ লিমিটেড ও আরএফ বিল্ডার্স লিমিটেডের স্বত্ত¡াধিকারী দেলোয়ার হোসেনের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ও ব্যাংক হিসাব ক্রোকের আদেশ দিয়েছেন।
দুর্নীতি দমন কমিশন জেলা সমন্বিত কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এর উপ-সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ জাফর সাদেক শিবলী পূর্বদেশকে বলেন, ‘দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার পর তার বিভিন্ন সম্পদ বিক্রি করার চেষ্টা করছেন মর্মে নির্ভরযোগ্য সূত্রে দুদক জানতে পারে। এ অবস্থায় তার সম্পদ বা সম্পত্তির বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে তা বেহাত হয়ে রাষ্ট্রের ক্ষতির শঙ্কা রয়েছে। দুদক আইন-২০০৭ এর বিধি ১৮ ধারামতে তার বিরুদ্ধে বিজ্ঞ আদালতের মাধ্যমে মোট দুই কোটি ৫৩ লাখ নয় হাজার ২০ টাকার মূল্যের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোকের আবেদন করা হয়। আদালত ক্রোকের অনুমতি দিয়েছেন।
এর আগে গত ১৭ জুলাই দুদকের করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে একই আদালত নগরীর পাঁচলাইশ থানার মুরাদপুর মৌজার চিটাগাং কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটির নাসিরাবাদ আবাসিক এলাকায় অর্ধকোটি টাকায় কেনা পুলিশের এক কর্মকর্তার ফ্ল্যাট ক্রোকের নির্দেশ দেন। ওই পুলিশ কর্মকর্তার নাম মো. রেফায়েত উল্লাহ চৌধুরী। প্রথম স্ত্রীর দায়ের করা নারী নির্যাতন মামলায় কারাভোগকারী পুলিশৈর এই কর্মকর্তা কয়েকবছর আগে পটিয়া থানার ওসি ছিলেন। বর্তমানে তিনি পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ে সংযুক্ত আছেন।
উল্লেখ্য, দুর্নীতি দমন কমিশন চলতি বছরের গত ২৪ জানুয়ারি দুদক আইনের আওতায় নবগঠিত ‘অপরাধলব্ধ সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা ইউনিট’-এর কার্যক্রম সংক্রান্ত জরুরি সভায় অনুসন্ধান চলাকালেই অবৈধ সম্পদের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে অভিযুক্ত ব্যক্তির সম্পদ জব্দ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এছাড়া, ফৌজদারি কার্যবিধি বা সিআরপিসি অনুযায়ী, মুদ্রাপাচার আইনে পুলিশ আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে অভিযুক্ত ব্যক্তির স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দ করতে পারে। মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সেসব সম্পদ সংশ্লিষ্ট সংস্থার (রিসিভার) জিম্মায় থাকবে। আদালত থেকে চূড়ান্তভাবে সেসব সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্তের আদেশ পাওয়ার পর সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তা ব্যবহার কিংবা অথবা প্রকাশ্যে নিলাম ডেকে বিক্রি করে বিক্রয়লব্ধ অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয়ার বিধান রয়েছে।