ক্রাইস্টচার্চে হামলার ভিডিও তুলে নেওয়া যাচ্ছে না কেন?

36

নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে বন্দুকধারীর হামলায় এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৯ জন। এতে আহত হয়েছেন আরও অন্তত ৪০ জন। গত শুক্রবার জুমার নামাজ আদায় করতে আসা মুসুল্লিদের উপরে অতর্কিতে হামলা করে হত্যা করার এই পুরো ঘটনাটি নিজের ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচার করেছে হত্যাকারী।
সরাসরি সম্প্রচারের ভিডিও ফুটেজটি দাবানলের মতন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সেখান থেকেই এই ভিডিওর স্থিরচিত্র ও হত্যাকান্ডের লাইভ ভিডিওর লিংক ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য মূলধারার সংবাদ মাধ্যমে।
হত্যাকান্ডের ভিডিওটি এতটাই ব্যাপক ভিত্তিতে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে যে, ভয়াবহ সেই ভিডিও সরিয়ে নিতে বা নামিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো।
ভয়ংকর এই ঘটনায় আবারো টুইটার, ফেসবুক ও ইউটিউব-এর মতন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দিকে অভিযোগের আঙুল উঠেছে। বলা হচ্ছে, এসব প্লাটফর্ম ব্যাবহার করে চরম ডানপন্থী এই সব কর্মকান্ড ছড়িয়ে দেয়া হলেও সাইটগুলো তা ঠেকাতে পারছে না।
শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী এই হামলাকারীর লাইভ ভিডিও দৃশ্য এতো ব্যাপক ভিত্তিতে ছড়িয়ে পড়েছে যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অনেক ব্যবহারকারীই এখন এই ভিডিও আর শেয়ার না দিতে অন্যদের প্রতি অনুরোধ করছেন। কারণ হিসেবে একজন ব্যবহারকারী বলেছেন, হত্যাকারী ঠিক এটিই চেয়েছিল। চেয়েছিল, এটি ছড়িয়ে পড়ুক।
হত্যাকান্ডের ভিডিওটি ব্যাপক হারে শেয়ার করা হয়েছে। এছাড়া, ঘটনার ঠিক ১০-২০ মিনিট আগে কেউ একজন সন্দেহভাজন ব্যক্তির ফেসবুক পেজটি শেয়ার করেছিল। সেই পেজে বলা ছিল যে, তিনি সরাসরি সম্প্রচার করবেন। আর সেই পেজে ঘৃণা-মাখানো একটি ডকুমেন্টও ছিল।
সেই ডকুমেন্টটি বিশ্লেষণ করে রবার্ট ইভান্স চিহ্নিত করে দেখিয়েছেন যে, সেখানে প্রচুর বিষয় ছিল, যার অধিকাংশই পরিহাসমূলক এবং অতি নিম্নমানের ট্রল ও মিম। মূলত মানুষকে বিভ্রান্ত ও দ্বিধান্বিত করতেই এরকমটি করা হয়েছিল বলে মনে করছেন রবার্ট ইভান্স।
হত্যাকারী ব্যক্তি তার লাইভ ভিডিওতে একটি মিম-এর রেফারেন্সও দিয়েছেন। হত্যাকান্ডের উদ্দেশ্যে গুলি শুরু করার আগে সাবস্ক্রাইব টু পিউডাইপাই বা পিউডাইপাই সাবস্ক্রাইব করুন বলে জোরে চিৎকার করে উঠেছেন।
হত্যাকান্ডটি সরাসরি ফেসবুকে সম্প্রচার হয়েছে। তবে, পরে আসল ভিডিও ফুটেজটি ফেসবুক সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু সেই ভিডিও ডাউনলোড করে অন্য আরো অনেক প্ল্যাটফর্মে শেয়ার করায় টুইটার ও ইউটিউবের মতন সাইটগুলোর মাধ্যমে সেই ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। সেই ভিডিও ফুটেজের কিছু অংশ অস্ট্রেলিয়ার কিছু গণমাধ্যম সহ পৃথিবীর আরো বিভিন্ন সংবাদপত্র এই ভিডিও প্রচার করে।
গণহারে মানুষ হত্যা করার এই সরাসরি সম্প্রচারের ভিডিও যদিও অসংখ্য মানুষ শেয়ার করেছেন, অনেকেই আবার এটিকে বিরক্তিকর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং ভিডিওটি না ছড়ানোর অনুরোধ করেছেন।
ওমর সোলাইমান বলে একজন টুইটারে লিখেছেন, একজন সন্ত্রাসী আমাদের ভাই ও বোনেদের গুলি মেরে ফেলার এই দৃশ্য তোমরা প্লিজ ছড়িয়ে দিও না। ওই সন্ত্রাসী ওটাই চেয়েছিল। আর চ্যানেল নিউজের উপস্থাপক কৃষ্ণান গুরু-মূর্তি দুটো ব্রিটিশ গণমাধ্যমের নাম নিয়ে তাদেরকে এই ভিডিও নামিয়ে নেবার তাগিদ দিয়েছেন।
এই ঘটনায় সকল প্রকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পক্ষ থেকে আন্তরিক সমবেদনা ও শোক জানিয়ে যত দ্রুত সম্ভব হত্যাকান্ডের সেই ভিডিওটি তাদের সাইট থেকে সরিয়ে দিয়েছে।
ফেসবুক বলেছে, হত্যাকান্ডটি সরাসরি সম্প্রচারিত হবার পর-পরই নিউজিল্যান্ডের পুলিশ তাদেরকে ঘটনাটি জানায় এবং জানার সঙ্গে সঙ্গেই তারা হত্যাকারীর ফেসবুক একাউন্ট ও ভিডিওটি সরিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি ফেসবুক এটিও বলেছে যে, এই হত্যাকান্ডকে যারা সমর্থন করে বা প্রশংসা করে কোনো কমেন্ট করবে তারা সেগুলোও সরিয়ে নেবে।
ইউটিউব-ও এক বার্তায় তাদের আন্তরিক শোক ও সমবেদনা জানিয়েছে সহিংস ভিডিও সরিয়ে নেবার কথা ঘোষণা করে।
সারে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিশেষজ্ঞ কিয়ারান গিলেস্পি বলেছেন, আসলে সংকটটা আরো গভীর। এটি শুধু একটি ভিডিওর ব্যাপার নয়। উগ্রপন্থী এরকম অজস্র কন্টেন্ট ইউটিউবে রয়েছে বলে তিনি ইউটিউবের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন। তাই, ইউটিউবে বর্ণবাদী ও ডানপন্থী বিষয়বস্তু বন্ধ করবার জন্য আরো তাগিদ বাড়বে বলেও তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন।
গিলেস্পির কথাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইন্সটিটিউটের গবেষক ড. ভারত গনেশের কথাতেও। এই ভিডিও নামিয়ে নেয়াটা অবশ্যই সঠিক কাজ। কিন্তু ডানপন্থী সংগঠনগুলো এমন সব বিষয়বস্তু নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় আলাপ করে যেগুলোর সাথে এখনো যথার্থভাবে ডিল করায় এসব মিডিয়া এখনো পারঙ্গম হয়ে ওঠেনি।
ড. গণেশ বলছিলেন ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ও মতাদর্শ ছড়ানো হলেও বাক স্বাধীনতার নামে সেগুলোকে চালিয়ে দেবার প্রবণতা দেখা যায়।