কোরবানি সেকাল একাল ও ভবিষ্যতকাল

125

পৃথিবী বড়ই পরিবর্তনশীল। প্রতিনিয়ত এখানে শুধু বিবর্তন ঘটে! ঈদ এলো আলহামদুলিল্লাহ্, গরু একটি কিনলাম। এবার হাটে গিয়ে গরু দেখতে দেখতে হঠাৎ অনেক বছর পূর্বে ফিরে গেলাম, সেই কিশোর বয়সে। ১৯৬৯-৭০ সালের কথা বয়স ছয় কি সাত হবে আমার, বাবা ৫০০ টাকা দিয়ে একটি গরু কিনেছিলেন এখনও পরিষ্কার মনে আছে গরুটির মুখ! যদি পটুয়া হতাম মনে হয় এঁকে ফেলতাম গরুটিকে, মনে থাকার কারণ হল, কোরবানির সপ্তাহ্ খানিক আগে কেনা হয়েছিল তাই চরানোর বেশি সময় পেয়েছিলাম। আমরা চাচাতো-জেঠাতো ভাইরা মিলে প্রতিদিন গরুটিকে মাঠে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে যেতাম আর সেখানে চরাতে নিয়ে আসা অন্য গরুগুলোর সাথে লড়াই দিতাম। সেকি আনন্দ তখন আমাদের কারণ আমাদের গরুটি সব গরুকে লড়াইতে হারিয়ে দিতÑ এ কারণেই গরুটির আকারসুদ্ধ চেহারাটা আমার মনে গেঁথে গেছে। হাটে গিয়ে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম ৫০০ টাকা মূল্যের সেই গরুটির সমান সাইজের গরুর আজকের দাম দেড় লক্ষ টাকা! অর্থাৎ ৫০ বছরে গরুর মূল্য বেড়েছে ৩০০ গুণ, মাশাল্লাহ্। তারপর ভাবনার রাজ্যে পাখা মেলে দিয়ে ভাসতে ভাসতে পৌঁছে গেলাম ৫০ বছর পরে। অবাক হলাম ভেবে, দাম বৃদ্ধির এ ধারা যদি অব্যাহত থাকে তবে সে গরুটির দাম তখন হবে সাড়ে চার কোটি টাকা, ভাবতেই যেন মগজ আমার হয়ে গেল ফাঁকা! এটি কেমন কথা টাকার মূল্য একেবারে হয়ে গেল যা-তা! আল্লাহ্ গো তোমার দুনিয়া তো দেখছি হয়ে যাবে ছেঁড়া কাঁথা।
বর্তমানে হাটে গরু কিনতে যাওয়ার বড় ঝামেলা হচ্ছে টাকা বয়ে নিয়ে যাওয়া। কারণ এতগুলা টাকা পকেটে করে নেওয়া বড় কষ্টকর, ব্যাগে নিলে বুঝে যাবে হাটে যাচ্ছে ফলে কেড়ে নিতে সুবিধা হবে। কথাগুলো মনে আসলেই বুক শুকিয়ে যায়, তাহলে ৫০ বছর পরে মানুষের অবস্থাটা কি হবে, তারা হাটে টাকা বয়ে নিয়ে যাবে কিভাবে? হতে পারে কোন না কোন সমাধান মানুষ তখন বের করবে, তবে পাকিস্তান আমলে বাজারে পাঁচশ টাকার নোট চালু ছিল। ফলে দু’য়েকটি নোট নিয়ে হাটে গেলে কাজ হয়ে যেত, কেউ বুঝতও না টাকা আছে কি নাই বা কোথায় রেখেছে। ৫০ বছর আগে মানুষ টাকা সাথে নিয়ে হাটে যেত, এখনও মানুষ তা-ই করে। তবে ৫০ বছর পরে কি মানুষ টাকা ছাড়া হাটে যাবে? গত ৫০ বছরে যা বদলায়নি আগামী ৫০ বছরে তার কি বদল হবে? হলেও হতে পারে, যদি না হয় অত টাকা নিয়ে মানুষ হাটে যাবে কি করে? হাজার টাকার নোট হলে ৪৫০ বান্ডিল আর ৫০০ টাকার ৯০০ বান্ডিল, গোটা একটি গাড়ি লাগবে টাকা বয়ে নিতে! আর গোনে নিতে সে টাকা গরুওয়ালার চারদিন লাগবে, গরু আর বেচতে হবে না একটা বেচেই শেষ, হাহাহাহা। আগামী দিনের বাজারের কথা ভাবতেই একটি কৌতুক মনে পড়ে গেল, আসলে সত্যি ঘটনা, ঘটনাচক্রে কৌতুক হয়ে গেছে। আমার এক বন্ধু গত ঈদের ১০-১২ দিন আগে তাদের প্রতিষ্ঠানের নামে ফেবুতে একটি স্টেটাস দিলো; অনলাইনে গরু বিক্রি, দ্রæত অর্ডার করুন পছন্দের গরুটি যথাসময়ে সরবরাহ করা হবে। ঈদের আগেরদিন দেখলাম স্টেটাস দিল বিশাল দুইটি গরুর ছবি, নিচে তার লিখা; আমাদের কোরবানির গরু বিবির হাট, সাগরিকা ঘুরে শেষ পর্যন্ত এক কিলোমিটার থেকে কিনেছি, আলহামদুলিল্লাহ। অতএব পাপারাজ্জিরা তার পিছু লেগেছে; দোস্ত অনলাইনের খবর কি, সহজ পথ ছেড়ে বাঁকা পথে গেলে কেন? এসব দেখে আমার সেই ডাক্তারের কথা মনে পড়ে গেল, চুলের ডাক্তার টাকের ঔষধ দেন। বড় বিজ্ঞাপনে লিখাÑ শত ভাগ নিশ্চয়তা, ১৫ দিন সেবনে টাক মাথায় নতুন চুল গজাবে, আর ডাক্তারের মাথায় পরচুলা।
আবু আবদুল্লাহ্ মহম্মদ, বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা নামে প্রসিদ্ধ, ১৩৪৬ খৃষ্টাব্দে বাংলাদেশে এসেছিলেন, ফখরউদ্দীন মুবারক শাহ তখন বাংলার স্বাধীন সুলতান। ইবনে বতুতার বর্ণনা মতে ১৩৪৮ খৃষ্টাব্দে বাংলাদেশে ৭ টাকায় ৮ মণ ত্রিশ সের চাল পাওয়া যেত আর একটি দুগ্ধবতী গাভীর মূল্য ছিল ২১ টাকা! তার প্রায় সাড়ে তিনশ বছর পর ১৬৮০-৯০ সালের দিকে সুবাদার শায়েস্তা খানের আমলে এসে বাংলায় এক টাকায় আট মণ চাউল পাওয়া যেত! আশ্চর্য, ৩৫০ বছর পর এসে বাংলাতে চালের দাম প্রায় ৭ গুণ কমে গেল, আর ১ টাকারও কম দামে, বার আনায় একটি গরু পাওয়া যেত! গরুর এ মূল্যটি প্রায় গত শতাব্দীর শুরুর দিকে পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল, কারণ আমাদের নানা-দাদাদেরকে বলতে শুনতাম উনারা মাত্র দুই-আড়াই টাকা দিয়ে গরু কিনেছিলেন! আগের গুলো যদি হয় ঐতিহাসিক সত্য নানা-দাদাদের মুখের কথা কিন্তু চাক্ষুষ সত্য, আশ্চর্য, মাত্র একশ বছরের ব্যবধানে দাম হয়েছে লক্ষ গুণ! ভবিষ্যতে যে কি হবে ভাবতেই গোলমেলে লাগছে তবে তার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছি গেলবার চামড়া বিক্রি করতে গিয়ে। এত টাকায় কেনা গরুর চামড়া বিক্রি করতে হয়েছে মাত্র ৩০০ টাকা! অথচ পরিষ্কার মনে আছে ৮৯-৯০ সালে ছ’হাজার টাকায় কেনা গরুর চামড়া বিক্রি করেছি ৫-৬শ টাকা দিয়ে! ভাবতে লাগলাম ৩০০ টাকা কি করব, কাকে দেব? ভেবেছিলাম চামড়ার টাকা কিছু রোহিঙ্গাদের, কিছু বন্যার্থদের পাঠাব। টাকা দেখে মনটাই খারাপ হয়ে গেল, আশ্চর্য দিনে দিনে জিনিসের দাম বাড়ে, চামড়ার বেলায় গেল তা পড়ে। বতুতা গিয়ে কোন শায়েস্তা যুগ শুরু হলো নাকি?
এবারও ঈদ এলো বন্যা নিয়ে, বন্যার্তদের দুঃখ দেখে মন খারাপ তার মধ্যে আবার ডেঙ্গু। মাগোÑ পুলিশ, ডাক্তার, সিভিল সার্জনও মারা গেলেন এ রোগে, কি ভয়ানক কাÐ! তাহলে আমাদের কি হবে, আমর যাব কোথায়? প্রতিদিন খবর আর মিডিয়ায় ডেঙ্গুর যে অবস্থা দেখছি ভয়ে বুক দুরুদুরু করছে, বারবার ইতালির ঘটনাটা মনে পড়ছে।
গতসপ্তায় আমার প্রবন্ধ ‘অন্তর মম বিকশিত করো’তে লিখেছি, সোয়াইনফ্লু চলাকালীন ইতালির বিচারক আদালতে শুধু বলেছিলেন, গতকাল মেক্সিকো থেকে এসেছি। তাতেই বিকট চিৎকারÑ গোটা আদালত ভবন মুহূর্তে খালি, বিচারক ছাড়া কোন মানুষই নাই সেখানে। কারণ সোয়াইনফ্লু অতি সংক্রামক ব্যাধি ও মৃত্যুর কারণ এবং তার উৎপত্তি মেক্সিকোতে। এখন কোথায় মেক্সিকো আর কোথায় ইতালি, মাঝে আটলান্টিক মহাসাগর বাদ দিলেও রয়েছে ভূমধ্যসাগর ও স্পেন-ফ্রান্স। অতএব মানুষগুলা আদালত ভবন থেকে বেরিয়ে গেলে সোয়াইনফ্লু তাদের আর পাবেনা। কিন্তু কোথায় ঢাকা আর কোথায় চট্টগ্রাম, এরমধ্যেই নাকি চট্টগ্রামে কয়েকশ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত, ফলে আমাদের অবস্থা কি, আমরা কোথায় পালাব? এদিকে শুনা যাচ্ছে স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাকি বিদেশ পালিয়েছেন ডেঙ্গুর ভয়ে আর অর্থমন্ত্রী তো নাকি অফিসই করছেননা। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অফিসে যাচ্ছেন না কারণ সেখানে নাকি মশা বেশি, ইতোমধ্যে দুইবার এরেস্টও নাকি হয়ে গেছেন ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া কর্তৃক। ঠিক আছে ডেঙ্গু, বন্যাÑ এসব হল প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানুষের কোন হাত নাই তাতে। কিন্তু মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগেও দেশ আজ উতালপাতাল, খুন, গুম, ছিনতাই, ইত্যাদি তো আছে সেই সাথে যোগ হয়েছে ধর্ষণ, ছেলেধরা, পদ্মাসেতুর কল্লাকাটা পার্টি, গণপিটুনি, কারসাজি ও ভাঁওতাবাজি, গুজব, আজব সব। আরো আছে আদালতে কোপাকুপি, রাজপথে কোপাকুপি, ভিআইপি, দুদক, হারপিক ও বিøচিং পাউডার, প্রিয়া সাহা, নুসরাত, মিন্নি, রিফাত সহ একটা টাল, গোটা দেশ টালমাটাল।
অবশেষে ভেবেছি গুজব কিছুটা প্রশমিত হয়েছে, ওমাÑ কিসের প্রশমন? যে প্রধানমন্ত্রী বললেন গুজব না ছড়াতে, সেই তাঁকে নিয়ে গুজব শুরু হল, তাঁর নাকি ক্যান্সার হয়েছে! পড়লি তো পড়লি একদম মালীর ঘাড়ে? মুসলিম বিশ্বে এখন চলছে কোরবানির সমারোহ, ত্যাগের মহামহিমা, আত্মবিসর্জনের মহান শিক্ষা, অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত! আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্যেই নবী ইব্রাহিমের (আঃ) ত্যাগ আর ইসমাঈলের (আঃ) আত্মবিসর্জনের পরীক্ষা মানবজাতির জন্যে আল্লাহর পক্ষ হতে এক মহান শিক্ষা। আমরা দেখি বন্ধুর জন্যে বন্ধুর ত্যাগ, সন্তানের জন্যে বাবা-মার ত্যাগ, ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যে জীবন উৎসর্গ, ইত্যাদি সব অনুপ্রেরণা কোরবানীর মহান শিক্ষার মধ্যেই নিহিত রয়েছে। কোরবানীর শিক্ষা যুগ যুগ ধরে মানবজাতির জন্য ত্যাগের এক মহানিদর্শন হয়ে থাকবে। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে নিজের সন্তান কোরবানী দিতে প্রস্তুত হয়েছিলেন! মুসলিম বিশ্ব সেই শিক্ষায় উজ্জীবিত হয়ে কোরবানীর মহান আদর্শে উদ্ভাসিত হবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। কিন্তু দুঃখের বিষয় মুসলমানরা আজ সে শিক্ষা হতে বহু দূরে সরে গেছে, ত্যাগ, ভ্রাতৃত্ববোধ মুসলমানরা আজ হারাতে বসেছে। আল্লাহ্ মুসলমানদের মধ্যে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ও হযরত ইসমাইল (আঃ)’র শিক্ষাকে সুদৃঢ় ভিত্তি দান করুন এবং বাংলাদেশকে প্রকৃতিসৃষ্ট ও মনুষ্যসৃষ্ট সকল দুর্যোগ হতে রেহাই দান করুন। ঈদ আমাদের জন্য বয়ে আনুক অনাবিল শান্তি ও সমৃদ্ধি এবং বিশ্ব মুসলিম ত্যাগের মহিমায় জাগ্রত হোক। কাশ্মীর নিয়ে সকল ষড়যন্ত্র বিনাশিত হোক, মুসলমানের বিজয় হোক।
বিগত কয় বছর যাবৎ দেশে চামড়া নিয়ে শুরু হয়েছে ষড়যন্ত্র, চামড়ার দাম পাওয়াই যাচ্ছে না। ৮৯ সালে ৬০০০ টাকায় কেনা গরুর চামড়া বিক্রি করেছিলাম ৬শ টাকায় আর গত বছর দেড়লক্ষ টাকার গরুর চামড়া বিক্রি করেছি মাত্র ৩শ টাকায়! অর্থাৎ ৮৯ সালে দশটা চামড়ার টাকা দিয়ে একটি গরু পাওয়া যেত, এখন ৫০০টি চামড়ার টাকায় একটি গরু। চামড়ার টাকা কোরবানি দাতা খায়না, তা পায় গরীবরা, অতএব গরিবের ভাগ্য মারা গেল। এখন আবার শুরু হয়েছে দুধ নিয়ে কারসাজি, বিক্রয় করতে না পেরে খামারীরা লাখ লাখ লিটার দুধ ফেলে দিয়েছেন, ঈদের খুশিটাই মাটি হয়ে গেছে। হাজারো অনিশ্চয়তা, না পাওয়ার বেদনা ও অনেক হতাশার মধ্যেও আবার ঈদ এলো। আশা করি সকল অশুভ কালোছায়া দূর করে দিয়ে ঈদ আমাদের ভবিষ্যতকে সুন্দর করে তুলবে, সবাইকে ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত করে হিংসা-লোভ হতে মুক্ত করবে। সবাকে ঈদ মোবারক, আস্সালামুয়ালাইকুম ওয়া রহমতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহু।

লেখক : কলামিস্ট