কোরবানির গুরুত্ব ও তাৎপর্য

123

কোরবান শব্দটি ‘র্কুব’ ধাতু হতে উৎপত্তি। অর্থ নৈকট্য। মহান আল্লাহ পাকের নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য শরীয়তের পরিভাষায় মহিষ, গরু, ছাগল, উট, দুম্বা মেষ জাতীয় পশু জিলহজ মাসের ১০, ১০, ১২ তারিখে কোরবানির নিয়তে উৎসর্গ করাকে কোরবানি বলে।
মুসলমান আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার কথা উচ্চারণ করে থাকেন কিন্তু আজ প্রশ্ন ভালোবাসার জন্য কতটুকু চরম ত্যাগের পরীক্ষা দিতে আমরা প্রস্তুত আছি ? পৃথিবীতে একটি চরম কঠিন কাজ পিতা নিজেই স্বীয় পুত্রকে জবাই করা। সেই অসম্ভব কঠিন কাজটি করে হযরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।


মুসলমানকে আজ পশু কোরবানির সাথে পশুত্বকেও কোরবানি দিতে হবে। কোরবানি আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন সকল মহৎ কর্ম সাধনায় ত্যাগী ও কোরবানি হতে হবে। ইসলামের সুন্দরতম আদর্শগুলো সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে চরম আত্মত্যাগ ছাড়া সম্ভব নয়।
মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কোরান মজিদে ইরশাদ করেছেন ‘ কোরবানির রক্ত মাংস আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না, তাঁর পৌঁছায় শুধুমাত্র তাক্ওয়া’। (সূরা আল-হজ্ব ঃ আয়াত : ৩৭)
কোরবানির বাজার হতে অনেকে বড় বড় গরু ছাগল ক্রয় করে বাহাদুরি করি। এটা কোরবানির চেতনাকে ¤øান করে। কোরবানির উদ্দেশ্য হলো আমাদের অহংকারকে মিটিয়ে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করা।
কোরবানি পশুকে কত বড় কিনলো সেটা বড় কথা ন, কোরনাবীদাতার হৃদয়ের বিশালতা কত সেটাই বড় কথা।
মহাবিশ্বের মালিক মহান আল্লাহ পাক সকল কিছু মানুষের কল্যাণের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। তাই মহান আল্লাহর নিকট তাঁর বান্দা সম্পূর্ণরূপে আত্মসম্পর্ণ করতে হয়। নিজেই ইচ্ছা অনুযায়ী মুসলমান চলা সম্ভব নয়। লোভ-মোহ, কাম-ক্রোধ ত্যাগ করে আল্লাহর দাসত্ব মেনেনিতে হয়। এই দুনিয়া হলো মুসলমানদের জন্য পরীক্ষার স্থান। পরীক্ষা ছাড়া ঈমান, ত্যাগ আল্লাহর নিকট গ্রহণীয় নয়। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ পাক-পরীক্ষা ব্যতিত কারো ঈমানের দাবি গ্রহণ করেন না। আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বড় পরীক্ষা প্রদান করে হয়রত ইব্রাহিম (আ.) ও ঈসমাইল (আ.) এর মত নবী রাসুলগণ।
মহান আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত পবিত্র কোরবানে ইরশাদ করেছেন ‘এবং আমি তোমাদেরকে অবশ্যই পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা, জান মাল ফসল ফলের নষ্টের মাধ্যমে। সুসংবাদ দাও যারা ধৈর্যধারণ করেন তাদেরকে। তাঁরা যখন বিপদে পড়ে তখন তাঁরা বলেন, নিশ্চয় আমরা সবায় আল্লাহর এবং সকলেই তাঁর কাছে প্রত্যাবর্তন করবে। (সূরা ঃ২, আয়াত ঃ ১৫৫-১৫৬)।
হয়রত ইব্রাহিম (আ.) এর হায়াতে জিন্দেগী ছিল ১৬৫ বছর। ৮৬ বছর তাঁর কোন সন্তান জন্মগ্রহণ করেনি। সন্তানের আশায় আশায় বৃদ্ধকাল আসতে লাগলো। একদিন আল্লাহ পাকের পক্ষ হতে হযরত ইব্রাহিম (আ.) জানতে পারলেন তাঁর পুত্র সন্তান জন্ম হবে। এতে বয়সে তো সন্তান জন্ম হয় না। কিন্তু যে আল্লাহ নামকাদের অগ্নিকুÐ হতে বাঁচিয়েছেন তিনি কী বৃদ্ধ বয়স সন্তান দিতে পারেন না ? অবশ্যই পারেন। কি ভাবে হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর সন্তান ঈসমাইল (আ.) কে ধ্বংস করবেন ? তাঁদের রক্ত প্রবাহের মধ্যে গুপ্ত আছে পৃথিবীর সেরা ইতিহাস। তাঁদের বংশে আবির্ভাব হতে মহাবিশ্বের মহানবী হযরত মোহাম্মদ (দ.)। ৮৭ বছরে হযরত হাজেরা (আ.) এর সন্তান হলো, তাঁর নাম রাখলেন ঈসমাইল।
বিবি সারা হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর আরেক স্ত্রী, তাঁর ঘরে জন্ম হয় হযরত ইসহাক (আ.)। ইসহাকের বংশধররা নবী ইসহাক, বনী ইসহাকের বংশধররা বনী ঈসরাইল। তারাই ছিলেন ইয়াহুদী ও খৃস্টান সম্প্রদায়। নবী ঈসরাইলের বংশধরের মধ্যে অনেক নবী আগমন করলেও বনী ঈসমাইলের বংশধরের মধ্যে অনেক নবী আগমন করলেও বনী ঈসমাইলের বংশধরের মধ্যে শুভ আগমন হয়েছে আমাদের নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
হযরত ঈসমাইল (আ.) জন্মের কিছুদিন পর আল্লাহ পাক ইব্রাহিম (আ.)কে নির্দেশ দিলেন ঈসমাইল ও তাঁর মা হাজেরা (আ.) কে বায়তুল মোকাদ্দাস হতে প্রায় এক হাজার মাইল দূরে আল্লাহর ঘর খানায়ে ক্বাবায় নির্বাসন দিতে। জনবসতিহীন মরুভূমিতে শিশু ঈসমাইল ও হাজেরা (আ.) কে রেখে হযরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে সিরিয়ার দিকে যাত্রা করলেন। বিদায়কালে হযরত হাজেরা (আ.) স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আল্লাহ পাকের হুকুমে আপনি আমাদেরকে ফেলে চলে যাচ্ছে সে আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতই আমাদেরকে হেফাজত করবেন।
হাজেরা (আ.) পুত্র ঈমাইল (আ.)কে লালন পালন করেন। পরীক্ষাও হলো জীবনে অনেক মাতা-পুত্রের পরীক্ষায় পিতার কোন অবদান দিল না। তারপরও হযরত ইব্রাহিম (আ.) একদিন হাজেরা (আ.)কে বললে স্বপ্নে পুত্র কোরবানির কথা। নবীদের স্বপ্ন তো অহী এবং সত্য। পিতা-মাতা-পুত্র এক কথায় সকলেই রাজী স্বপ্ন পুরণে কোরবানি করতে। পুত্রের কথায় পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.) নিজের চোখ বেঁধে আদরের সন্তানের গলায় ছুরি বসিয়ে দিলেন। মহান আল্লাহ পাক সাথে সাথে পিতা-পুত্রের ভালোবাসায় আনন্দিত হয়ে হযরত জিবরাইল (আ.) কে হযরত ঈসমাইলের পরিবর্তে দুম্বা কোরবানি হুকুম দেন।
ছেলের পরিবর্তে দুম্বা কোরবানি হওয়ার পর হযরত ঈমাইল (আ.) দাঁড়িয়ে হাসতে থাকেন। আল্লাহর নবী হযরত ইব্রাহিম (আ.) চিন্তিত হয়ে পড়লেন, আল্লাহ পাক তাঁর কোরবানি গ্রহণ করলো বলে। কি কারণে তাঁর কোরবানি কবুল হলোনা সে ভাবনায় মাটিতে সিজদায় পড়ে হযরত ইব্রাহিম (আ.) ফরিয়াদ করতে থাকেন মহান প্রভুর দরবারে। নবী ইব্রাহিম(আ.) এর মহান ভালোবাসা ও বিনয় দেখে আল্লাহ পাক হযরত জিব্রাইল (আ.) দ্বারা সংবাদ প্রেরণ করলেন, হে ইব্রাহিম আপনার সন্তান ঈসমাইলের বংশে সর্বশেষ ও সর্ব শ্রেষ্ঠ নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়াতে শুভ আগমন করবেন।
হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও হযরত ঈসমাইল (আ.) এর ত্যাগের স্মৃতিকে স্মরণ করে উম্মাতে মোহামদীগণের প্রতিবছর জিলহজ মাসের ১০ তারিখ কোরবানি করা ওয়াজিব। আল্লাহর কামেল বান্দার কোরবানি কোনদিন তারিখ সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তাঁরা আল্লাহর পথে নফসের সাথে জিহাদ করে বেঁচে থাকে। পবিত্র কোরানে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন, বলুন! আমার নামাজ ইবাদত, জীবন, মরণ সবই আল্লাহর জন্যে নিবেদিত। (সূরা ঃ ৬, আয়াত ঃ ১৬২)।

লেখক : কলাম লেখক ও রাজনীতিক