কোরআন শিক্ষার মর্যাদা

19

ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী

দুনিয়ার কোন ধর্ম মতের প্রধান গ্রন্থের নাম ‘অধ্যয়ন নেই, কোরআন অর্থ অধ্যয়ন। ক্বেরাত ও তেলাওয়াত অর্থ অধ্যয়ন। কোরআনের প্রথম শব্দ ‘ইকরা’ অর্থ পড়। প্রথম নাজিলকৃত পাঁচটি আয়াত জ্ঞান বিজ্ঞানের।
পবিত্র কোরআন মহান আল্লাহ পাকের মহা ঐশীগ্রন্থ যা তিনি তাঁর প্রিয় হাবীব হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর নাজিল করেছেন। কোরআন, ইসলাম এবং আল্লাহর পরিচয়ের প্রকাশ মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে হওয়া মহান আল্লাহাপাক পছন্দ করেছেন, কারণ আল্লাহ তাঁর হাবীবকে ভালোবাসেন। কোরআন বহু আয়াত ও সূরার সমষ্টি, যে গ্রন্থে পূর্ববর্তী নবীগণের উপর অবতীর্ণ কিতাব ও সহিফাসমূহের শিক্ষণীয় সারসংক্ষেপ নিহিত রয়েছে। এই গ্রন্থে জ্ঞান বিজ্ঞানের কথা ব্যাপক ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
‘কোরআন’ শব্দটি পবিত্র কোরআনে ৬৬ বার উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন : দয়াময় আল্লাহ! তিনি শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন। (৫০ : ১-২)
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহপাক চারটি নামে উল্লেখ করেছেন। (১) আল কোরআন (২) আল কোরআন (৩) আল কিতাব (৪) আয্-জিকির।
‘কোরআন’ শব্দটি বর্ণিত একটি আয়াত বর্ণনা করা হলো। মহান আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন, আমি আপনার নিকট উত্তম কাহিনী বর্ণনা করেছি, ওহীর মাধ্যমে আপনার নিকট এই কোরআন প্রেরণ করে, যদিও এর আগে আপনি ছিলেন অনবহিতদের অন্তর্ভুক্ত। (কোরআন : ১২:৩)
পবিত্র কোরআন যেহেতু সত্য মিথ্যা পার্থক্যবারী ঐশী গ্রন্থ তাই মহান আল্লাহপাক কোরআনকে কোরআন (সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী) নামে অভিহিত করেছেন। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, কত মহান তিনি যিনি তাঁর বান্দার প্রতি ‘ কোরআন’ নাজিল করেছেন যাতে তিনি বিশ^জগতের জন্য সতর্ককারী হতে পারে। (কোরআন : ২৫ : ১)
লিখিত গ্রন্থকে কিতাব বলা হয়। যেহেতু পবিত্র কোরআনকে একটি লিখিত গ্রন্থ এবং লিখিত গ্রন্থ হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। তাই এই পবিত্রকে কিতাব নামে অভিহিত করা হয়েছে। মহান আল্লাহ পাক ঘোষণা করেছেন, এটি যে কিতাব ; এতে কোন ধরনের সন্দেহ নেই। কোরআন : ২:২)
মহান আল্লাহপাক তাঁর বান্দার জন্য বিভিন্ন আদেশ উপদেশ প্রদান করেছেন, এটি বন্দার প্রতি আল্লাহর নির্দেশনামা, তাই এটিকে আয্-জিকির নামে উল্লেখ করা হয়েছে।
মহান আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, এবং নিশ্চয়ই কোরআন আপনার ও আপনার সম্প্রদায়ের (জিকির) সদুপদেশ (কোরআন : ৪৩ : ৪৪)।
তা ছাড়াও পবিত্র কোরআনের অনেকগুণবাচক নাম রয়েছে। যথা : আল-মুবারক, আল-হাকীম, আল-মুবিন, আলিফ লামরা, আল আরবী, আল আজাব, আল-মজীদ, আল আজিজ, আল আজিম, আল-নূর, আল বুরহান, আল বায়ান, আল হুদা। এ ধরণের পঞ্চাশের কাছাকাছি গুণবাচক নাম রয়েছে। কারো কারো মতে কোরআনের গুণবাচক নামের সংখ্যা এক শতের কাছাকাছি।
পবিত্র কোরআন পাক অবস্থায় তেলাওয়াত করলে সওয়াব অর্জিত হয়। অজু নিয়ে পাঠ করলে আরো বেশি পূর্ণ অর্জিত হয়। নামাজে পাঠ করা আরো অধিক সওয়াব, রমজানে আরো অদিক। কোরআনের অর্থ অত্মস্থ করে তেলাওয়াত আরো বেশী পুণ্য পাওয়া যায়। কোরআনের দুটি অর্থ আছে তা আমরা হাদিস হতে জানতে পারি। একটি প্রকাশ্য অর্থ আর একটি অপ্রকাশ্য অর্থ।
অপ্রকাশ্য অর্থ বুঝতে পারে আধ্যাত্মিক সাধকগণ। আর কোরআনের আলোকে জীবন গড়া সবচেয়ে বড় কাজ। তাই কোরআনের শিক্ষা গ্রহণ করা এবং মানুষকে শিক্ষা দেওয়া একটি মহান কাজ। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেছেন, ঐ ব্যক্তি উত্তম যে কোরআনের শিক্ষা গ্রহণ করেছেন এবং মানুষকে শিক্ষা দেয়। (বোখারী, তিরমিজী, আবু দাউদ)
প্রিয় নবী মাহবুবে খোদা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমাদের মধ্যে কে আছো, যে ভোরে ‘আকীকের বাজারে গিয়ে পাপাচার কিংবা সম্প্রীতি নষ্ট না করে উচ্চ কুঁজ বিশিষ্ট দুইটি উট নিয়ে আসবে ? সাহাবীগণ বললেন, আমরা তা সবাই পছন্দ করি। প্রিয় নবী (দ.) ঘোষণা করলেন, তোমাদের মধ্যে যদি ভোরে মসজিদে গমন করে কোরআনের দুইটি আয়াত, পাঠ করে অথবা অপরকে শিক্ষা দেয়, তা হবে তাঁর জন্য দুটি উটের চেয়ে উত্তম। তিন আয়াত পাঠ করলেন তিনটি, চার আয়াত পাঠ করলে চারটি উটের চেয়ে উত্তম। আর এভাবে যত আয়াত পাঠ করবে তত উটের সংখ্যাও বাড়তে থাকবে। (মুসলিম ও আবু দাউদ)
কোরআনের শিক্ষা প্রত্যেক মুসলমান অর্জন করা ফরজ। যার কাছে কোরআনের জ্ঞান আছে তাঁকে ইর্ষা করা বৈধ। এই জ্ঞানীর সমমর্যাদায় সমাসীন হওয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া পুণ্যের কাজ। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেছেন, দুই প্রকার লোকের সাথে প্রতিযোগিতা করা যায় (১) যাকে মহান আল্লাহ পাক কোরআনের জ্ঞান দিয়েছেন এবং সে সারারাত জ্ঞান চর্চায় লিপ্ত থাকে। (২) যাঁকে আল্লাহপাক সম্পদ দিয়েছেন সে সম্পদ তিনি দিন রাত আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করেন। (বোখারী)
এই হাদিশ দ্বারা বুঝাযায় যে, কোরআন শিক্ষা গ্রহণ করলে চলবে না তদনুসারে আমলও করতে হবে। পবিত্র কোরআন মর্যাদা এত বেশি যে, এই মহাগ্রন্থের পাঠক কেবল উপকৃত হয় না, কিয়ামতের দিন তার পিতা মাতাও উপকৃত হবেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘ যে ব্যক্তি কোরআন অধ্যয়ন করবেন এবং তা আমল করবেন তার পিতা-মাতাকে কেয়ামতের দিন নুরের টুপি পরান হবে, যদি সূর্য তোমাদের গৃহে প্রবেশ করতো তবে ঐ সূর্যের আলো অপেক্ষাও ঐ টুপির আলো উজ্জ্বলতর হতো। চিন্তা করে দেখুন, যে ব্যক্তি নিজে কোরআনের নির্দেশ অনুসারে আমল করে তার মর্যাদা ও অবস্থান কত উত্তম হবে। (মুসনদে আহমদ, আবু দাউদ)
এ হাদিস হতে আত্মস্থ হতে পারা যায় যে, কোরআন অধ্যয়নকারীর পিতা মাতাই যদি এত উচ্চ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হন তাহলে অধ্যয়নকারীর সম্মান ও মর্যাদা আরো কত বড় স্থানে অধিষ্ঠিত হবেন তা চিন্তা করা কঠিন।
হযরত মাওলা আলী (রা.) হতে বর্ণিত, মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, কেয়ামতের দিন কোরআন তেলাওয়াতকারী ও হাফিজগণ এত উচ্চতর মর্যাদা লাভ করবেন যে, তারা নিজ বংশের দশ ব্যক্তির জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করতে পারবেন। অবশ্যই তাদেরকে ইসলামী শরীয়তের পাবন্দী হতে হবে।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) ইরশাদ করছেন, যে ঘরে কোরআন তেলাওয়াত করা হয় সে ঘরে কল্যাণ বৃদ্ধি পায়। ফেরেস্তাদের আগমন ঘটে এবং শয়তানের প্রভাব হতে নিরাপদ থাকে। যে ঘরে কোরআন তেলাওয়াত করা হয় না, সে ঘর বরকতহীন ও আমদলের শিকার হয়ে পড়ে। রহমতের ফেরেস্তা সে ঘর হতে বিদায় নেয়, এটি শয়তানের গৃহে পরিণত হয়। মহান আল্লাহ পাক আমাদের ঘরকে শয়তানের আবাসস্থলে পরিণত হওয়ার চেয়ে মুক্ত রাখুক।
লেখক : কলাম লেখক, রাজনীতিক