কোভিড-১৯ সংক্রমণের পঞ্চম থেকে পরের ১০ দিন কেন গুরুত্বপূর্ণ

41

মারাত্মক ছোঁয়াচে নভেল করোনাভাইরাসজনিত কোভিড-১৯ ঠেকানোর ভ্যাকসিন কিংবা ওষুধ যেহেতু এখনও তৈরি হয়নি, তাই কেউ আক্রান্ত হলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো রোগের উপসর্গের দিকে নজর দেওয়া। অর্থাৎ উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়াটাই এখন একমাত্র উপায়।
কোভিড-১৯ হলে একেবারে শুরুতে কার কোন উপসর্গ দেখা দেবে তা এখনও নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। তবে শরীরে ভাইরাসের প্রকোপ বাড়তে থাকলে কোনো না কোনো উপসর্গ গুরুতর হয়ে দেখা দেয়।
এই ভাইরাসে আক্রান্তদের সর্দি, হাঁচি-কাশি, জ্বর, গলাব্যথাসহ সাধারণ নিউমোনিয়ার মতো লক্ষণ দেখা গেলেও এসব এখন আর মোটেই হেলাফেলা করা যাবে না। কারণ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হলে রোগের লক্ষণের এসব তথ্যই চিকিৎসার ধরণ বুঝতে কাজে দেয়। এতে সিদ্ধান্ত নেওয়াও সহজ হয়, রোগী কি ঘরে সঙ্গনিরোধে থাকলেই সেরে উঠবেন না কি তাকে হাসপাতালে সেবা দিতে হবে?
নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদন বলা হয়েছে, লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা দেওয়ার প্রথম দিনটি ক্যালেন্ডারে দাগ কেটে রাখতে হবে। মেপে নিতে হবে জ্বর আর শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ। এর সবই শরীরে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে কিনা তা বোঝার জন্য খুবই জরুরি।
ইউনিভার্সিটি অফ আলবার্টার সংক্রামক রোগ বিভাগের অধ্যাপক আইলান স্কয়ার্জ বলেন, বেশিরভাগ রোগীই এক সপ্তাহের মধ্যে সেরে ওঠেন।
“অসুস্থতার প্রাথমিক লক্ষণগুলো কিছুদিনের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে আসে। তারপর দ্বিতীয় দফায় রোগী ভয়ানক অসুস্থবোধ করেন।”
সবার উপসর্গ ও অসুস্থতার মাত্রা একই রকম না হলেও উপসর্গ দেখা দেওয়ার পরের পাঁচ থেকে ১০ দিনের মধ্যে শ্বাসতন্ত্রের জটিলতা ভোগাতে পারে কোভিড-১৯ রোগীকে; বিশেষ করে বয়স্ক রোগী এবং যাদের উচ্চ রক্তচাপ, স্থুলতা ও ডায়াবেটিস রয়েছে।
যারা বয়সে কিছুটা তরুণ যাদের বেলায় শারীরিক জটিলতা একটু পরেই দেখা দেয়; ১০ থেকে ১২ দিনের মধ্যে। সামান্য অস্বস্তি ও ক্লান্তি বোধ করলেও আক্রান্তদের মধ্যে যারা গুরুতর অসুস্থতা ছাড়াই ১৪ দিন কাটিয়ে দেন, তারা সুস্থ হয়ে ওঠার পথে বলেই ধরে নেওয়া যায়।
যারা সাত দিন পেরোতে না পেরোতই ভেবে নেন সুস্থ হয়ে উঠেছেন, তাদের কিছুটা হুঁশিয়ার করে এনওয়াইইউ লানগন হেলথ প্রতিষ্ঠানের পপুলেশন হেলথ ও মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক লিওরা হরউইজ বলেন, “কোভিড-১৯ রোগীদের প্রথম সপ্তাহে নিজের শারীরিক অবস্থার দিকে কড়া নজর রাখতে বলি আমি। সেরে উঠেছি ভেবে আত্মতুষ্টিতে ভোগা যাবে না এ সময়।”
যদি শ্বাসকষ্ট দেখা দেয় তাহলে অতি দ্রæত একজন চিকিৎসককে ফোন দিতে হবে। সপ্তাহখানেক পরেও রোগী শারীরিকভাবে দুর্বল বোধ করলে তাতে তাহলে ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই। এই ভাইরাসে সংক্রমিত রোগীর বেলায় এমন ক্লান্তি বোধ এক সপ্তাহের বেশি দেখা গেলেও হাসপাতালে ভর্তি হওয়া জরুরি নয়।
রোগীর জন্য দ্বিতীয় সপ্তাহ গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই এ সময় নিউমোনিয়ার মত লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা। স্ক্যানিং করালে এ ধরনের রোগীর দুই ফুসফুসের নিচের অংশ অস্বচ্ছ দেখা যায়। শরীরে একটু একটু করে অক্সিজেনের ঘাটতিও দেখা দেয়, যা অনেক সময় রোগী নিজেও বুঝতে পারেন না। শরীরে অক্সিজেন ঘাটতি প্রকট হওয়ার পর শ্বাস-প্রশ্বাস অস্বাভাবিক হতে শুরু হলেই কেবল রোগী ডাক্তারের কাছে ছুটে যান। শরীরে অক্সিজেন ঘাটতির এই দশাকে বলে ‘নীরব হাইপোক্সিয়া’।
ভাইরাস আক্রান্ত সন্দেহ হলে সাবধান থাকতে ঘরে বসে পালস অক্সিমিটার ব্যবহার করে নিজেকে পর্যবেক্ষণে রাখা জরুরি।
পালস অক্সিমিটার একটি ক্ষুদে ডিভাইস, যা আঙ্গুলে আটকে শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা মাপা যায়। কিছু মোবাইল অ্যাপও রয়েছে; তবে এগুলো এখনও খুব একটা সঠিক ফলাফল দিতে পারছে না।
একজন সুস্থ ব্যক্তির শরীরে ৯৬ থেকে ৯৯ শতাংশ অক্সিজেনের উপস্থিতি থাকে। তাই যদি কেউ অক্সিজেন মেপে দেখে ফলাফল ৯২ শতাংশ পায়, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
শরীরে শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখতে ঘরে বসেও প্রাথমিক কিছু চিকিৎসা করা সম্ভব; রোগী তা নিজে নিজে করতে পারেন। এজন্য রোগীকে পেটের উপর ভর করে শুয়ে পড়তে হবে। পিঠে ভর করে শুয়ে থাকলে ফুসফুস ততটা সম্প্রসারিত হতে পারে না। তবে উপুড় করে শুয়ে থাকলে ফুসফুস সহজে স¤প্রসারিত হতে পারে; আর তাতে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া সহজ হয় রোগীর জন্য।
মাঝে মাঝে ডান ও বামে কাত হয়েও শোয়া যেতে পারে। আবার সারাক্ষণ শুয়ে থাকাটাও ঠিক নয় বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা; মাঝে মাঝে চেয়ারে সোজা হয়ে বসে থাকতে হবে।
টমাস জেফারসন ইউনিভার্সিটির জরুরি ওষুধ ও ক্লিনিক্যাল গবেষণা বিভাগের অধ্যাপক আন্না মারি চ্যাংয়ের শরীরে বাসা বেঁধেছিল এই ভাইরাস। অসুস্থ হওয়ার নয়দিনের মাথায় শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ ৮৮ শতাংশে নেমে যায়। এরপরই তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে অক্সিজেন নেন। এরপরের চারদিন তাকে উপুড় করে শুইয়ে রাখা হতো মাঝে মাঝে। এতে করে শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয় চ্যাংয়ের।
চ্যাংয়ের বয়স মোটে ৩৮। এমন তরুণ বয়সীরা সংক্রমিত হলে কেন তাদের শারীরিক অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হয় তা এখনও স্পষ্ট নয় গবেষকদের কাছে।
বাড়িতে থেকেই শরীরের অক্সিজেনের পরিমাণ মেপে দেখায় সবাইকে পরামর্শ দিয়েছেন নিউ হ্যাম্পশায়ারের চিকিৎসক রিচার্ড লেভিটান।
তিনি বলেন, “শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে তবেই হাসপাতালে আসতে বলাটা ভুলই ছিল।”
পাঁচ থেকে ১০ দিনের ভেতর যাদের অবস্থা গুরুতর হচ্ছে তাদের পর্যবেক্ষণে নেওয়ার পর উপসর্গ দেখা দেওয়ার সময়ের বিষয়টাতে আগের মত জোর দিতে পারছেন না লেভিটান। কারণ প্রথম উপসর্গ ঠিক কোন দিন থেকে শুরু তা অনেক রোগীই বুঝতে পারেন না।
“কতদিন ধরে অসুস্থ তা রোগীর কাছে জানতে চাইলে উত্তর পাওয়া যায়, এই তো কয়েক দিন ধরে। কিন্তু দেখা যায়, রোগীর স্ত্রী বলে ওঠেন, রোগী এক সপ্তাহ ধরে অসুস্থ।”
তবে ঘরে পালস অক্সিমিটার না থাকলে একটা ছোট পরীক্ষা করে ফুসফুসের হাল বুঝে নেওয়া যেতে পারে বলে জানাচ্ছে নিউ ইয়র্ক টাইমস। এতে রোগীকে শ্বাস নিতে হবে তারপর ৩০ পর্যন্ত গুণতে হবে। যদি ১০ পর্যন্ত গুণতে (সাত সেকেন্ডের মত) আরেকবার শ্বাস নেওয়ার উপক্রম হয় তাহলে বোঝা যাবে শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ ৯৫ শতাংশে নেমে এসেছে। যদি সাত পর্যন্ত (পাঁচ সেকেন্ড) গুণতে পারা না যায়, এর অর্থ অক্সিজেনের পরিমাণ ৯০ শতাংশ।
তবে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকরা এই ‘রথ’ স্কোরের কোনো ভিত্তি দেখছেন না। তাদের আশংকা, এই পদ্ধতি পরীক্ষিত নয় এবং এর প্রয়োগে মানুষ বিভ্রান্ত হতে পারে।
অক্সিজেন অপর্যাপ্ত হলে অনেক সময় রোগীর ঠোঁটে ও ত্বকে নীল দাগ দেখা দিতে পারে। এসময় সম্ভব হলে চিকিৎসকের সাথে ভিডিও কলে কথা বলে নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে হাসপাতালে যেতে হবে কিনা।
শরীরের ভাইরাস প্রবেশের দিন থেকে পরে ১৪ দিন পর্যন্ত কী ধরনের উপসর্গ হতে পারে তা ধাপে ধাপে সাজিয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমস।
আর এর সঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়, নিজের শরীরের কথা শুনতে হবে মনোযোগ দিয়ে। তারপর প্রয়োজনে করণীয় জানতে চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করতে হবে।
সংক্রমণের প্রথম তিন দিন
গলা খুস খুস, কাশি, জ্বরের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। কেউ কেউ বুকে সামান্য চাপ বোধ করতে পারেন। কারো কারো বেলায় ডায়রিয়াও দেখা দেয়। অনেকেই এ সময় ক্লান্ত বোধ করতে পারেন। পাশাপাশি স্বাদ ও ঘ্রাণশক্তি কাজ নাও করতে পারে। জ্বর ছাড়াও বাকি উপসর্গগুলো দেখা দিতে পারে।
চতুর্থ-ষষ্ঠ দিন : এসময় অনেক রোগীর অসুস্থতার মাত্রা খুব একটা বাড়ে না। কিন্তু কারো কারো অবস্থা গুরুতর হতে শুরু করে; সেই সঙ্গে লাগাতার জ্বর ও কাশি তো থাকেই। শিশু ও তরুণদের ত্বকে র‌্যাশের মত দেখা দিতে পারে; চুলকানিও হতে পারে। হাত-পায়ের আঙ্গুল ফুলে যায়; ফ্রস্টবাইটেও ভুগতে পারেন অনেকে।
সপ্তম-অষ্টম দিন : অনেক রোগীর জটিলতা কমে আসে এই সময়। কিন্তু কারো কারো অসুস্থতা বেড়ে যায় এসময়। এমনকি কিছুটা সুস্থবোধ করা রোগীদের এই সময়ে আবার অসুস্থ হতে দেখা যায়।
অষ্টম-দ্বাদশ দিন : এই সময়টায় রোগীর শরীরের অবস্থা নজরদারিতে রাখতে হবে সব সময়।
মাউন্ট সিনাই-ন্যাশনাল জিউইশ হেলথ রেসপিরেটরি ইনস্টিটিউটের পরিচালক চার্লস এ পাওয়েল বলেন, “আট থেকে ১২ দিনের মাথায় এটা স্পষ্ট হয়ে যায়, কে সুস্থ হওয়ার পথে আর কার অবস্থা আশংকাজনক। যাদের অসুস্থতা জটিল হয় তাদের শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়, কাশিও বেড়ে যায় এই সময়।
“রোগী জন্য এসময় বাসায় থাকাটা স্বস্তিদায়ক নয়। আবার বাড়ির লোকদের পক্ষেও সব দেখভাল করা সম্ভব না। চিকিৎসকই পরামর্শ দিতে পারেন, রোগী এখন হাসপাতালেই আসতে হবে কিনা। রক্তে অক্সিজেনের ঘাটতি আরো খারাপের দিকে নিতে অপেক্ষা করতে চাই না আমরা।”
১৩ থেকে ১৪ দিন : মৃদু অসুস্থদের অধিকাংশই এই সময়ের মধ্যে সেরে ওঠেন। যাদের অসুস্থতা বেশি ছিল এবং অক্সিজেন চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল তাদেরও অনেকে সুস্থবোধ করতে পারেন। কিন্তু গুরুতর অসুস্থ রোগীরা দুই সপ্তাহ শেষেও ভালো বোধ নাও করতে পারেন। এই রোগীদের সেরে উঠতে আরো কিছু সময় লেগে যায়।