কোদালা চা বাগানে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার আশংকা

242

বছরের এপ্রিল মাস থেকে দীর্ঘ খরায় দেশের প্রথম চা বাগান কোদালা চা বাগানে কমপক্ষে ৭ হাজার চারা মরে গেছে। যা ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সের উৎপাদনশীল গাছ। এ ছাড়াও বাগানে বন্য হাতির আক্রমণে বছরজুড়েই হাতির দলের আক্রমনে বাগানকে লন্ডভন্ড করে দেয়। বছর জুড়েই বাগানে অবস্থান করে কযেক ভাগে বিভক্ত হয়ে বন্য হাতির দল। একেকটি দলে থাকে ১৪/১৮টি বন্য হাতি। এ পর্যন্ত বাগানে অবস্থান করে নতুন হাজার হাজার চা গাছ উপড়ে ফেলে। এ পর্যন্ত পায়ে পৃষ্টে কমপক্ষে ১২ চা শ্রমিককে হত্যা করে।
এ বছরে চাবাগানের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা বাৎসরিক লক্ষ মাত্রায় মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটবে। কৃত্রিমভাবে সেচের পানি দিয়ে বিশাল চা বাগান বছরের এপ্রিল মাস থেকে দীর্ঘ খরায় দেশের প্রথম চা বাগান কোদালা চা বাগানে খরা থেকে মুক্ত রাখা যায়নি। ২৬শ ৫০ একর জায়গা জুড়ে কোদালা চা বাগান এ বছরে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৫০ হাজার কেজি চা পাতা। করোনা রোগেও চা শ্রমিকদের হাত দোয়ার সাবান, সবকিছু দেওয়া হয়েছে। ১০ ফুট নিরাপদ দুরত্বে রেখে চা পাতা তোলছে। সব মিলিয়েবছরের লক্ষমাত্রা অর্জন না হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে।
জানা যায়, কর্ণফুলী নদীর তীরে মনোরম পরিবেশে দৃষ্টিনন্দন, সবুজ সমতল আর উচু পাহাড় ঘিরে কোদালা চা বাগানের মনমাতানো দৃশ্য যেকাউকে আকৃষ্ট করতে পারে। ১৮৬৪ সালে চাবাগনটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। দেশের চা বাগানের মধ্যে কোদালা চাবাগানই সর্বপ্রথম। বর্তমানে গুণগত মান বজায় রেখে দেশের চা শিল্পে ৩ নং স্থানে অবস্থান করছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে অপারপর চা বাগান গুলো থেকে সুনাম ও গুণগত মান বজায় রেখে শীর্ষ স্থান ধরে রেখেছে। দেশের প্রথম চা বাগান হিসেবে তার ঐতিহ্য ও গুণগত মান বজায় রেখে সম্ভাবনাময় চা বাগান হিসেবে ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। গুণগতমান ও উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কোদালা চা-বাগান ব্র্যাক নেওয়ার পর বছরের পর বছর লাভের মুখ দেখে আসছে। গত ২/৩ মাস ধরে বন্য হাতির আক্রমনে কোদালা চা বাগানকে নষ্ট করে দেয়। ইতিমধ্যে ১২ হাজার আগর চারার মধ্যে বন্য হাতির দল পায়ে পিষ্ট করে কমপক্ষে ৭ হাজার চারা বিনষ্ট করে। সরকার এ বাগান থেকে বছরে বড় ধরনের রাজস্ব পায়।
অপর দিকে নগর জীবনের একপেশে ক্লান্তিময় জীবনকে মুহুর্তে প্রশান্তিতে ভরিয়ে তুলার জন্য অবাক করা এক পর্যটন কেন্দ্রের নাম রাঙ্গুনিয়ার কোদালা চা বাগান। একদিকে পাহাড় ঘেরা সবুজের সাথে মেঘের লুকোচুরির অপূর্ব সন্ধির দৃশ্য অন্যদিকে চা বাগানের পাশ ঘেঁষে লুসাই কন্যা কর্ণফুলীর মন মাতানো ঢেউ যে কাউকে মুহুর্তে সতেজ করে দেবে। এছাড়াও চা বাগানের দৃষ্টিনন্দন ব্রিটিশ বাংলো, পাখির কিচিমিচির শব্দ আর চা শ্রমিকদের প্রতিদিনকার ক্লান্তিহীন কর্মযজ্ঞ বিনোদন প্রেমিকদের স্বপ্ন দেখাবে রূপকথার অজানা এক রাজ্যের। রাঙ্গুনিয়া উপজেলার কোদালা ইউনিয়নে গড়ে উঠা এই চা বাগানটি দেশের প্রথম ও শীর্ষ চা-বাগান গুলোর মধ্যে অন্যতম।
উৎপাদন ছাড়াও চা বাগানটি ইতিমধ্যেই বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে পর্যটন র্স্পট হিসেবে। প্রতিদিনকার শত শত পর্যটকদের আনাগোনা আর বাগানের আর্কষনীয় মনোরম দৃশ্য ধারণ করতে ছুটে আসছে বিভিন্ন টেলিফিল্ম, চলচ্চিত্র নির্মাতারা। বাংলাদেশের চলচিত্রে চাবাগানের মনোরম দৃশ্যের অংশ নিয়ে সফল সিনেমা নির্মিত হয়েছে।
কোদালা চাবাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক মো. ফেরদোস জানান, ২০ সালে কোদালা চা বাগান কর্তৃপক্ষ বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৫০ হাজার কেজি। তার ধারবাহিকতায় চা উৎপাদনের কাজ প্রতিনিয়ত এগিয়ে চলেছে। পুরো বাগান আধুনিক পদ্ধতিতে সেচ ব্যবস্থা স্থায়ী ইরিগেশেন সিষ্টেমের আওতায় নিয়ে আসায় পরও ব্যাপক পানির সংকটের কারণে ১২/ ১৪ বছরের চা গাছ মওে গেছে। এতে অর্থনেতিক ভাবে বাগানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
জানা যায়, ১৯৭৬ সালে তৎকালীন সরকার ব্যক্তিমালিকানায় লিজ দিয়ে চা-বাগানগুলো ছেড়ে দেন। এর মধ্যে প্লান্টাস বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে কোদালা চা-বাগান পরিচালনা করে আসছে। লোকসানের কবলে ১৯৯৩ সালে প্লান্টাস বাংলাদেশ থেকে আনোয়ার গ্রূপ চা-বাগানটি লিজ নিয়ে নেন। আনোয়ার গ্রæপও লাভের মুখ দেখতে না পাওয়ায় ২০০৪ সালে ৭ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে ব্র্যাক কোদালা চা বাগানের লিজ নেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ চা বোর্ডের আওতায় কোদালা চা বাগান সরকার থেকে লিজ গ্রহণ করে ব্র্যাক ২৬শ ৫০ একর জায়গা। তার মধ্যে ৮শ একর জায়গায় চা বাগান হচ্ছে। বর্তমানে ব্র্যাক বাংলাদেশ ৮শ ৭২ একর জায়গায় চা চাষ ৯শ একর জমিতে রাবার চাষ করেছেন। পরীক্ষামূলক ৫একর জায়গায় আগর চাষ হচ্ছে। এছাড়া চা ও রাবার বাগানের পাশাপাশি নানা প্রজাতির গাছের চারা বনায়ন করা হচ্ছে। এছাড়াও নিম ও মুলি বাঁেশর চাষও করা হচ্ছে। জানা যায়, প্লার্ন্টাস বাংলাদেশ ও আনোয়ার গ্রæপ কোদালা চা বাগান করে লাভের মুখ না দেখলেও ব্র্যাক কোদালা চা বাগান লিজ নেওয়ার পর থেকে বিভিন্ন পরিকল্পনার মাধ্যমে দক্ষ পরিচালনায় চাবাগানটি এখন ব্র্যাকের লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। দেশের চা শিল্পে কোদালা চা বাগানের চা গুণগত মান ও শীর্ষ চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে দেশে এবং বিদেশে ব্যাপক সুনাম অর্জন করে।
কোদালা চা বাগান সূত্রে জানা যায়, কোদালা চাবাগানে স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ৭শ জন। শ্রমিকদের বেতনের পাশাপাশি সপ্তাহে সাড়ে আটা, শ্রমিকদের শ্রমিক বস্তিতে ঘর নির্মান করে দেওয়া, চিকিৎসা ভাতা ফ্রি। চাবাগানের ভিতরে কমিউনিটি প্রাইমারী স্কুলে ছেলে মেয়েদের লেখা পড়া করার ব্যবস্থা রয়েছে। শ্রমিক কর্মচারীদের জন্য চা বাগানের ভিতরে এমবিবিএস ডাক্তারদের সমন্নয়ে একটি হাসপাতাল রয়েছে। হাসপাতালে চা শ্রমিকদের পরিবার পরিজন হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে থাকে।
কোদালা চা বাগানের চা শ্রমিক শ্রমিক শৈলেন রায় (৫৫) জানান, আমরা অশিক্ষিত লোকেরা চা বাগানে পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছি। অন্যান্য চা বাগানের তুলনায় কোদালা চা বাগানের পরিবেশ খুবই ভাল। মালিক শ্রমিকের মধ্যে সম্পর্ক একই পরিবারের মত। প্রতিদিন বন্য হাতির দলের আক্রমনের ভয়ে চা বাগানে কাজ করতে হচ্ছে। সরকারীভাবে চা বাগানে বন্য হাতীর আক্রমন থেকে রক্ষার জন্য কার্য্যকরী পদক্ষেপ নিলে চা বাগানের উৎপাদন ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে। চা বাগানের যাওয়ার প্রধান সড়কটি একেবারেই নাজুক। সড়কটি সংস্কার জরুরী হয়ে পড়েছে। সড়কটি দিয়ে যানও জন চলাচল করা যায় না।
কোদালা চাবাগানের ব্যবস্থাপক আবদুল লতিফ জানান, এবারের লম্বা খরায় বাগানের ১২/১৪ বছরের ব্যপক গাছ মরে গেছে। যা বাগানের জন্য ক্ষতি হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে বন্য হাতির আক্রমণ। এতে চা শ্রমিকদেও জীবনের ঝুকি নিয়ে চা পাতা তুলে। বছরের সব সময় বাগানে বন্য হাতির দল বসবাস করে। বাগানের যে পাহাড়ে বন্য হাতি থাকে সেখােেনর ধারেকাছেও চা শ্রমিকরা যেতে পারেনা। বাৎসরিক লক্ষ্যমাত্রায় এ বছরে ব্যাঘাত ঘটবে। এরপরেও আমরা বাগানে উৎপাদন সচল ও ক্ষতি পুষিয়ে নেবার লক্ষ্যে বিরামহীন কাজ করে চলেছি।