কে এই সোলেমানি

29

সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির পর ইরানের ইসলামি প্রজাতন্ত্রের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে আলোচিত নাম কাসেম সোলেমানি। ইরানি রেভুলিউশনারি গার্ডের বিদেশি শাখার এই নেতা যুদ্ধক্ষেত্রে মিলিশিয়াদের উদ্বুদ্ধ করে ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরানের প্রক্সি যুদ্ধে সহায়তা করেছিলেন। অভিজাত বাহিনী ‘কুদস ফোর্সের’ অধিনায়ক হিসেবে এবং সিরিয়া ও ইরাক যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য দেশে-বিদেশে ‘সেলিব্রিটি’র খ্যাতি পেয়েছেন মেজর জেনারেল সোলেমানি।
তার সক্রিয় ভূমিকা ছিল মধ্যপ্রাচ্যে ইরানি প্রভাব বিস্তারে, যার মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র ও তেহরানের আঞ্চলিক শত্রু সৌদি আরব ও ইসরায়েলকে বেগ পেতে হয়েছে। সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের যুদ্ধ জয়, ইরাকে ইরানপন্থি আধাসামরিক বাহিনীর উত্থান, ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে যুদ্ধসহ আর অনেক যুদ্ধের ‘কুশলী’ হিসেবে তিনি সুপরিচিত।
কখনো ক্যারিশমাটিক, কখনো সুকৌশলী সাদা চুলের এই কমান্ডার কারো কাছে নন্দিত, কারোর কাছে ছিলেন নিন্দিত। তাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে অনেক রহস্য ও সোশাল মিডিয়ায় রয়েছে অনেক মেমে। দীর্ঘ দিন পর্দার আড়ালে থেকে গোপন অভিযান পরিচালনা করে ইরানে সুখ্যাতি ও জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর সাম্প্রতিক বছরগুলিতে তিনি প্রকাশ্যে আসেন। তাকে নিয়ে তৈরি হয়েছে তথ্যচিত্র, সংবাদ, এমনকি পপ সংগীতও। ২০১৩ সালের কথা উল্লেখ করে বিবিসি লিখেছে, সাবেক সিআইএ কর্মকর্তা জন ম্যাগুইয়ার দ্য নিউ ইয়র্কারকে বলেন, সোলেমানি ছিলেন ‘মধ্যপ্রাচ্যে সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর একক অপারেটিভ’।
গত ২০ বছরে পশ্চিমা দেশ, ইসরায়েল ও আরব সংস্থাগুলোর একাধিক বার হত্যাচেষ্টাকে বিফল করে দিয়েও তিনি বেঁচেছিলেন বলে আল-জাজিরা লিখেছে। কিন্তু হঠাৎ সহিংসতার মধ্যেই তার জীবনের যবনিকাপাত হলো। প্রেসিডেন্ট ডলাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে শুক্রবার ভোরে চালানো সফল বিমান হামলায় তিনি নিহত হন বলে পেন্টাগন ঘোষণা দিয়েছে। ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় এক মার্কিন সামরিক ঠিকাদারের মৃত্যুকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র, ইরান ও ইরানসমর্থিত ইরাকি গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে টান টান উত্তেজনার মধ্যে চালানো হলে এ হত্যা অভিযান। ওই ঘটনার জন্য যুক্ত ইরানকে দায়ী করে আসছিল। ঘটনাটির পর ইরান সমর্থিত কাতাইব হেজবুল্লাহর উপর বিমান হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। জবাবে মিলিশিয়া সমর্থকরা বাগদাদে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে হামলা চালায়।
বিবিসি লিখেছে, সোলেমানি খুব দরিদ্র পরিবার থেকে অল্প শিক্ষা নিয়ে এসেছিলেন মনে করা হয়। কিন্তু ইরানের সবেচেয় অভিজাত ও শক্তিশালী বাহিনীর ভেতর দিয়েই তার উত্থান ঘটেছিল। তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খোমেনির ঘনিষ্ঠও হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৯৮ সালে কুদস ফোর্সের অধিনায়ক হওয়ার পর গোপন অভিযান পরিচালনা, মিত্রদের অস্ত্র সরবরাহ এবং ইরানের অনুগত মিলিশিয়াদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছিলেন সোলেমানি।
বিস্তৃত কর্মজীবনে তিনি সাবেক স্বৈরশাসক সাদ্দাম হুসেনের বিরুদ্ধে ইরাকে লড়াইয়ে থাকা শিয়া মুসলিম ও কুর্দি গোষ্ঠীগুলিকে সহায়তা করেছিলেন বলে মনে করা হয়। পাশাপাশি লেবাননের শিয়া জঙ্গি সংগঠন হিজবুল্লাহ এবং ফিলিস্তিনের ভূখন্ড ইসলামী সংগঠন হামাসসহ এ অঞ্চলের অন্যান্য গোষ্ঠীগুলোকেও সহায়তা করেছেন। বিবিসি লিখেছে, ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরাক দখলের পরে তার নির্দেশে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো মার্কিন সেনাবাহিনী ও সেনা ঘাঁটির উপর হামলা চালিয়ে শত শত লোককে হত্যা করে।
২০১১ সালে শুরু হওয়া সশস্ত্র বিদ্রোহ মোকাবেলায় বাশার আল-আসাদকে রণকৌশলের যোগানদাতা হিসেবে তাকে ব্যাপক কৃতিত্ব দেওয়া হয়। রুশ বিমান হামলা ও ইরানি প্রতিরোধের সহায়তায় পরিস্থিতি বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে চলে যায়; বাশার সরকার সিরিয়ার মূল শহরগুলি পুনরায় দখল করতে সক্ষম হয়। সোলেমানিকে মাঝে মাঝেই সিরিয়া ও ইরাকে ইরানিদের শেষকৃত্যে দেখা যেত। দুই দেশে ইরান কয়েক হাজার যোদ্ধা এবং সামরিক উপদেষ্টা মোতায়েন করেছিল। গত এপ্রিলে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ইরানের রেভুলিউশনারি গার্ডস ও কুদস ফোর্সকে ‘বিদেশী সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে ঘোষণা করেন।
ট্রাম্প প্রশাসন বলছে, লেবাননের হিজবুল্লাহ ও গাজাভিত্তিক ফিলিস্তিনের ইসলামি জিহাদি গোষ্ঠীসহ যুক্তরাষ্ট্রঘোষিত মধ্যপ্রাচ্যের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলিকে তহবিল, প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ও সরঞ্জাম সরবরাহ করছিল কুদস ফোর্স। পেন্টাগন এক বিবৃতিতে বলেছে, ইরাকসহ আশপাশের অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিক এবং কর্মকর্তাদের উপর হামলার সক্রিয়ভাবে পরিকল্পনা করছিলেন সোলেমানি। “জেনারেল সোলেমানি ও তার কুদস ফোর্স যুক্তরাষ্ট্র ও জোট বাহিনীর কয়েকশো সদস্যদের মৃত্যু এবং আরও কয়েক হাজার আহত হওয়ার জন্য দায়ী ছিল।”