কেমন পৃথিবী রেখে যাবে করোনা

39

এম এ হাশেম রাজু

বিশ্বজুড়ে চলছে করোনাভাইরাসজনিত মহামারী কোভিড-১৯। মানব সভ্যতার বিকাশকে থমকে দিয়ে এ মহামারী সম্পূর্ণ অচেনা এক পৃথিবীর ছবি এঁকে দিচ্ছে আমাদের চোখের পর্দায়। বোধের সীমায়ও ধরা দিচ্ছে অচেনা অনুভব। মানুষ হযত ভাবেনি কোনো অচেনা অণুজীব মানুষের শ্রেষ্ঠত্বকে এভাবে থামিয়ে দেবে। এর আগে মাত্র কয়েকবার ছাড়া মানুষের অভিযাত্রা পথে মানুষ ভেবেছে শুধুই মানুষকে নিয়ে, ভেবেছে স্বজাতিকে ঠেকানোর কৌশল প্রণয়নে ও প্রয়োগে। সীমাহীন ভোগের বশবর্তী হয়ে প্রকৃতিও হয়েছে মানুষের লক্ষ্যবস্তু। প্রকৃতির নির্যাস নিয়ে বেড়ে ওঠে যে মানুষ সেই প্রকৃতিকেই আবার মানুষ ধ্বংস করেছে নির্মমভাবে। প্রকৃতিকে সেবাদাস বানাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে প্রায়শ। মানবসভ্যতা ধ্বংসের সম্ভাব্য কারণ হিসেবে যুদ্ধ ও মহাজাগতিক অথবা প্রাকৃতিক পরিবর্তনকেই মানুষ চিহ্নিত করে আসছিলো। কোনো অদৃশ্য অণুজীবের কথা মানুষের ধারণায় আসেনি। অথচ তাই ঘটলো মানুষের সভ্যতার অগ্রযাত্রায়। অপরিচিত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাস চ্যালেঞ্জ জানালো মানুষের পরাক্রমকে, ব্যর্থ হয়ে গেলো সকল প্রকার প্রাণঘাতি অস্ত্রশস্ত্র যেসব প্রয়োগে একমুহূর্তেই পৃথিবীকে নিশ্চিহ্ন করা যাবে। একপ্রকার বিধ্বস্ত হয়ে গেলো মানবসভ্যতা।
ইতিহাসের দৃষ্টান্ত থেকে বুঝা যায়, একদিন এ মহাবিপর্যয়, মহামারী শেষ হবে। কিন্তু তার আগে পৃথিবীকে সম্পূর্ণ অচেনা এক জায়গায় এসে দাঁড় করিয়ে দেবে নিঃসন্দেহে বলা যায়। অনেককিছুই আবার উৎসমুখ থেকে যাত্রা শুরু করবে। ব্যাপক পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে যাত্রা করে বিশ্বের পরিবেশ, জীবনযাত্রা, মনন, শিল্প, সংস্কৃতি ভিন্ন একটা জায়গায় এসে দাঁড়াবে। অক্ষেত্রে নিয়ামক হয়ে উঠবে মানুষের মনন-চিন্তা-দৃষ্টিভঙ্গীর ত্রয়ী অবস্থান। অনেককিছুই মানুষকে আবার শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। এ শুরু মোটেও মানুষের উন্মেষপরবর্তী যাত্রার মত হবে না। সভ্যতার ঊষাকালে মানুষের মধ্যে একধরনের সাম্য ছিল। এ সাম্য ছিল মনোদৈহিক। কিন্তু সে সাম্য করোনাপরবর্তী বিশ্বে পাওয়া যাবে নাÑবলাই বাহুল্য। তাহলে কেমন হবে পৃথিবী ও জীবনযাত্রা, করোনাপরবর্তী সময়ে?
এ প্রশ্নের উত্তর সম্পর্কে ধারণা করতে গেলে দেখতে হবে এ মহামারী কেমন পরিবর্তন সাধন করবে বিশ্বজুড়ে। প্রকৃতিতে কী পরিবর্তন আসবে, জীবনকে অজেয়, অজর করে তোলার জন্য মানুষের কর্মতৎপরতা ও চিন্তার ক্ষেত্রে কী ও কেমন পরিবর্তন আসবেÑএসব। প্রকৃতির সাধনা প্রাকৃতিক হয়ে ওঠা, মানুষের অনুধ্যান মানবিক হয়ে উঠা। এ হয়ে উঠার প্রবণতা অবশ্যই সহজাত শ্রেয়বোধের ভিত্তিতে হতে হয়। করোনাপরবর্তী বিশ্বে মানুষ কতখানি মানুষ থাকবে, কতখানি সে অভিযোজিত হতে পারবে নিজেদের ও পরিপার্শ্বের সাথে। ইতোমধ্যেই প্রকৃতিতে দৃশ্যমান ও ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। বোদ্ধারা বলছেন, প্রকৃতি আজ থেকে প্রায় ৫০ কিংবা তদুর্ধ্ব বছর পূর্বের অবস্থানে ফিরে যাবে, যা ছিল এখনকার চেয়ে অনেক বেশি মনুষ্যবান্ধব। আকাশ আগের চেয়ে অনেক বেশি নির্মল ও বায়ু, পানি আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিশুদ্ধ হয়ে উঠছে ক্রমশ। জীববৈচিত্রেও এসেছে অভাবনীয় ও ইতিবাচক পরিবর্তন। পাশাপাশি প্রকৃতির প্রতি ইতোপূর্বে কৃত অপরাধবোধ মানুষের একাংশের চিন্তার জায়গাকে নাড়া দিচ্ছে। বিপর্যয় কাটিয়ে বেঁচে উঠার ক্ষেত্রে অলৌকিকত্বের অসারতাও ইতোমধ্যে প্রতীয়মান। তবুও পৃথিবীর মানুষের একটা বড় অংশজুড়ে এসবের ক্রমবর্ধমান প্রাবল্য লক্ষণীয়। এ মহামারীতে আক্রান্তদের এক বড় অংশ প্রবীণ এবং এ প্রবীণদের একটা বড় অংশ অগ্রসর চিন্তার মানুষ। আক্রান্ত হয়ে তাঁদের বড় একটা অংশ পৃথিবী ছেড়ে যাচ্ছে। বৈশ্বিক মানবসম্পদের ভাÐারে এটি একটি বড় রকমের ধাক্কা। এ ধাক্কা আগামী পৃথিবীতে তৈরি করবে প্রায় অপূরণীয় শূন্যতা।
করোনাকালে ঘনবসতির দেশসমূরে মানবিক বিপর্যয় প্রকট হয়ে উঠেছে। নিকটজনও নিকটজনকে ছেড়ে যাচ্ছে, ফেলে যাচ্ছে বিকারহীনভাবে। সামাজিক দূরত্ব থেকে জন্ম নিচ্ছে মানসিক দূরত্ব। মানুষ মানুষকে ঠকাচ্ছে অমানবিকভাবে, মহামারীপূর্ববর্তী সময়ের চেয়েও অনেক বেশি। নিজের জীবন বাঁচাতে মানুষ হয়ে পড়ছে ক্রমশ আত্মকেন্দ্রিক। এরই মধ্যে মানবিকতার দৃষ্টান্তও কম নয়। বিশ্বসংকটে অমানবিকতার চিত্র যেমন দেখা গেছে, তেমনি দেখা যাচ্ছে মানবিকতার আবাহন। এসব সংকট কি করোনাপরবর্তী সময়েও থাকবে? বিশ্বের জাতিসমূহের মধ্যে করোনা মোকাবেলায় যে সাম্য এখন দেখছি তা কি পরবর্তীতেও থাকবে?
কিন্তু প্রশ্ন হলো কতটা পরিশুদ্ধ হয়ে উঠবে মানুষ ও তার মানসিকতা। আদৌ কি সে পরিশুদ্ধ হবে নাকি করোনাপূর্ব সময়ের চেয়েও বেশি বিষাক্ত হয়ে উঠবে চিন্তার জায়গা থেকে?
ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে মানুষ ক্রমশ প্রকৃতিভুক হয়ে উঠেছিল। এর সাথে যোগ হলো আধিপত্যবাদ। এ আধিপত্যবাদ ভোগবাদী সমাজব্যবস্থারই অমোঘ ফলশ্রæতি। আধিপত্যবাদের আবার নানা ধরন। আঞ্চলিক আধিপত্য, বৈশ্বিক আধিপত্য, ধর্মীয় আধিপত্য, সামাজিক আধিপত্য, জাতিগত আধিপত্য, অর্থনৈতিক আধিপত্য, বর্ণবাদী আধিপত্য আরও কত কী। প্রতিটির লক্ষ্য কিন্তু মানুষই। মানুষই লড়েছে মানুষের বিরুদ্ধে। মাঝখানে বলির পাঁঠা হয়েছে প্রকৃতি। একটি যুক্তিনির্ভর, জ্ঞানভিত্তিক, বিজ্ঞানমনস্ক, প্রগতিশীল মানবিক পৃথিবী গড়ার সংগ্রামই মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রার লক্ষ্য হয়ে উঠার কথা ছিল। কথা ছিল, ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত, ধর্মান্ধতাহীন, বর্ণভেদহীন, প্রকৃতিবান্ধব ও বিজ্ঞানমনস্ক একক একটি মানবসমাজ গড়ে তোলার। করোনাপরবর্তী সময়ের পৃথিবী কি পূর্ববর্তী সময় থেকে অধিকতর মানবিক হবে? হবে প্রকৃতিবান্ধব, ধর্মান্ধতাহীন সকল প্রকার সামতের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত একটি একক সমাজ?
করোনার বিরুদ্ধে জয়ী হতে সারাবিশ্বের দেশ ও জাতিগুলোর মধ্যে একধরনের সাম্য আমরা দেখতে পাচ্ছি। অভিন্ন শত্রæর বিরুদ্ধে লড়ছে সকল দেশ, সকল জাতি। এ যুদ্ধে বিজ্ঞান রয়েছে পুরোভাগে। বর্ণবাদহীন, কুসংস্কার-ধর্মান্ধতাহীন, প্রকৃতিবান্ধব, আধিপত্যবদহীন, বৈষম্যহীন, প্রগতিশীল নতুন একটা মানবসমাজ রেখে করোনা মহভামারী বিদায়ের পথ ধরুক, এ আমাদের প্রত্যাশা। মানুষই ঠিক করে নিক সে ক্ষত মুছে সামনে এগুবে নাকি প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে সভ্যতার উল্টোরথে চড়বে।
যাই হোক, নির্দ্বিধায় বলায় যায়, করোনা এক নতুন পৃথিবী রেখে যাবে। রেখে যাবে নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গী। কিন্তু ক্ষমতার লড়াই, আধিপত্য কায়েম, ধর্মীয় গোঁড়ামি, বর্ণবাদ, আত্মকেন্দ্রিকতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য আগের চেয়ে কমবে, এ কথা বলার সময় এখনও আসেনি। মানুষ নিজেদের স্বার্থে আরো প্রকৃতিবান্ধব হয়ে উঠবেÑএমন ধারণা করারও যৌক্তিকতা এখনও স্পষ্ট নয়।
তবুও প্রত্যাশা করি, করোনা তার ক্ষতচিহ্ন দিয়ে একটা প্রকৃতিবান্ধব মানবিক পৃথিবীর ছবি এঁকে যাক। পৃথিবী তার আঘাত সারিয়ে নিয়ে আবার এগিয়ে যাক নতুন উদ্যমে সৃজনের পথে।

লেখক : রাজনীতিবিদ, মহাসচিবÑচট্টগ্রাম গণ-অধিকার ফোরাম